ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা বিদ্বেষ এবং বাস্তবতা

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯

ডিবিসি নিউজ রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টে কী পরিমাণে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। রোহিঙ্গাদের কারণে নাকি ইয়াবা, ধর্ষণ, ছিনতাই আর চাঁদাবাজি বেড়েছে কক্সবাজারে। রোহিঙ্গাদের কারণে শাকসবজি ও নিত্যপণ্যের দামও নাকি অস্বাভাবিক। স্থানীয়রা নাকি কাজ ও ব্যবসা হারাচ্ছে রোহিঙ্গাদের কারণে।

রোহিঙ্গার আসার পূর্ববর্তী সময়ে আমার কক্সবাজার ভ্রমণের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ২০১৫ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে সর্বশেষ কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ইয়াবা প্রসঙ্গতেই আসি প্রথমে। রিক্সা, ভটভটি, সিএনজি/ট্যাক্সি যেটাতেই চড়ি না কেন, বাহনে ওঠার পর চালকের প্রথম কথাই থাকত, মামা কি লাগব? ইয়াবা লাগব নাকি? চম্পা ৬০ টাকা, R7 ১৫০-২০০ টাকা।

ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির ব্যাপারে বলতে গেলে শহরের একটু ভেতরে চিপাচাপায় কমদামি হোটেলগুলোতে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা উঠলে তাদের জিম্মি করে স্থানীয় গুণ্ডামাস্তান তাদের সর্বস্ব লুট করে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা অহরহই ঘটে আসছে। এছাড়া নির্জন স্থানে কাউকে একা পেলে ছিনতাইয়ের ঘটনা তো আছেই। আর পণ্যের দামের কথা নাই বা বললাম। দুশো টাকার ফতুয়া পাঁচশো টাকা। পঞ্চাশ টাকার স্পঞ্জের স্যান্ডেলের দাম ২৫০ টাকা। ১৫০ টাকার সানগ্লাস ৪০০ টাকায় বিক্রি করা তো খুবই সাধারণ ঘটনা। এসব কিন্তু বাঙালিদের দ্বারাই ঘটা। ২০১৫ তে কিন্তু রোহিঙ্গারা ছিল না, একটা বিরাট সিন্ডিকেটের দ্বারাই এসমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসতো। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে থাকতো।

কিন্তু ২০১৯ এ এসে সব দোষ রোহিঙ্গাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাদক, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এসব কিন্তু রোহিঙ্গা আসার পর থেকে বাড়েনি। ওসব আগে থেকেই ছিল। শুধু কোনো জনগোষ্ঠীর উপর দোষ চাপিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগটা তখন ছিল না। এবার আসি শাকসবজি, মাছ-মাংসের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ক্রাইসিস বা সংকট তৈরি হলে লুটপাট ও মূল্যবৃদ্ধি হয় না। উত্তরায় যদি টানা দুইদিন গ্যাস না থাকে তাহলে ৮০ টাকার তেহারি ৩০০ টাকায় বিক্রি হবে। সিডরের সময় ইস্কাটন দিলুরোডে টানা দুইদিন বিদ্যুৎ ছিল না, ৫ টাকার মোমবাতি ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বিশাল এক জনগোষ্ঠী বিপদে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারে। চাহিদার সাথে যোগানের সংকট কিছুটা তো থাকবেই। কিন্তু এই সংকটকে পুঁজি করে দেশীয় সিন্ডিকেট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ালে সেটার কারণ হিসেবে রোহিঙ্গাদের ঘাড়ে বন্দুক রাখাটা কতটুকু হাস্যকর ও অযৌক্তিক সেই বুঝ যদি ডিবিসি নিউজের থাকতো তাহলে রিপোর্টে এসব বলে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে তারা নিয়োজিত থাকত না।

আর কিছু মূর্খ আছে এসব রিপোর্ট দেখে বা পড়ে তাদের মগজধোলাই হয়। এবং এসব শেয়ার দিয়ে রোহিঙ্গা বিদ্বেষী সম্মতি উৎপাদনে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। অনেক মূর্খ আবার একটা ভিডিও ফুটেজ শেয়ার দিচ্ছে যেখানে দেখা যাচ্ছে একদল রোহিঙ্গা পুলিশের সদস্যদের সাথে উচ্চবাচ্য করছে। সেটা শেয়ার দিয়ে মূর্খরা ক্যাপশন দেয় ‘যাদের বিপদে জায়গা দিলাম, তারাই আজ আমাদের সাথে কি করছে!’

একজন আছে হিরক রাজ্যের রাণী। তার নোবেল পাওয়ার খুব শখ। সেই শখের বশে তিনি রোহিঙ্গাদের জায়গা দিলেন ঠিকই কিন্তু নোবেল আর পেলেন না। ফলে উনার প্রতিহিংসা বরাবরের মতোই নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো, এখন তিনি রোহিঙ্গাদের হজম করতে পারছেন না। আরেকদল আছে যারা নামে মুমিন, কামে রুমিন। রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে তাদের জায়গা দেয়ার জন্য সম্মত হয়েছিল। কিন্তু আশ্রয় দেয়া মাত্রই তারা দলে দলে ছুটলো রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও বিয়ে করার জন্য। মানবতা এই আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিল। অথচ ডিবিসি নিউজের সেই রিপোর্টের নাম `মানবতা দেখিয়ে বিপদে`।

হিরক রাজ্যের রাণী ও তার রুমিনসুলভ মুমিন জনগণ যদি মানবিকতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিত, তাদের সাথে নূন্যতম মানবিক আচরণ যদি করা হতো, তাহলে ওই ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে যেই আচরণ দেখা গিয়েছে সেটিও দেখতে হতো না।

 

মনের জানালা বিভাগে প্রকাশিত কোনো লেখার জন্য ছাড়পত্র কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। এটি পাঠকের অনুভূতি ব্যক্ত করার একটি প্ল্যাটফর্ম।