লতিফ জোয়ার্দারের গদ্য ‘মরার আগে মরব না’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৩, ২০২০

আপনি ভাবছেন, আপনার আলোর প্রদীপ ম্লান হয়ে আসছে। আপনার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনার কাছে সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছে। হঠাৎ করেই এমন চিন্তা আপনার। নিজের এই ফুরিয়ে যাবার চিন্তায় আপনি ঘুমুতে পারছেন না। না পারার বেদনা, না থাকার বেদনা আপনাকে ঘুণপোকার মতো করে খাচ্ছে। এমন যে আপনার খুব বেশিদিন হয়েছে, তা কিন্তু নয়! মোটকথা হলো, আপনার জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি বাধাগ্রস্থ করেছে একটি ভাইরাস। যা খালি চোখে দেখা যায় না। তার কাছে পুরো পৃথিবী নতি স্বীকার করেছে আজ। আর এই নতি স্বীকার করার কারণে মানুষ তাকে জয় করতে পারছে না। করোনার ভয়াল থাবায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সভ্যতা। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়ছে। করোনার কাছে কোনো বিভক্তি নেই। করোনার কাছে কোনো সাদা কালো নেই। করোনার কাছে কোনো ধনী-দরিদ্র নেই।

আপনি ভাবছেন, আপনি যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তবে আপনাকে ভাবতে হবে, আপনি একদিন এই পৃথিবীতে ছিলেন না। আবার আপনি থাকবেন না। তখন হয়তো অন্য কেউ ছিল। সেই মানুষটিও ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুচিন্তা করতো। তবে কেন আপনি আপনার কথা ভাবছেন। তবে কেন আপনি আমিত্ব নিয়ে আছেন। এখানে কেউ আপনার নয়। এখানে আমি বলে কিছু নেই। আপনি পৃথিবী নামক একটা সুন্দর পিকনিক স্পটে বেড়াতে এসেছেন। আবার ফিরে যেতে হবে আপনাকে। মোটকথা, করোনাকে ডোন্ট কেয়ার করুন। মৃত্যুকে ডোন্ট কেয়ার করুন। স্বাভাবিক থাকুন। আর একটা ছোট্ট ভাবনা মাথায় রাখুন, কালে কালে মহামারি এসেছে। আবার আসবে। কেউ থাকবে, আবার কেউ চলে যাবে। তাই বলে মরার আগে মরবো না। নিয়ম মেনে চলে, যতক্ষণ থাকতে পারি। ততক্ষণ সুস্থ থাকবো আমরা, ভালো থাকবো আমরা।

দুই.
মা বললো, ক্যারে, আর কতদিন করোনা থাকপি? এ কথার উত্তরে মাকে আমি কী বললো, ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার কথার উত্তর না পেয়ে মাকে বেশ বিমর্ষ দেখালো। হঠাৎ করেই মায়ের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম আমি। ততক্ষণে মা আমার সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। মাকে বললাম, সামান্য একটু বসো।

আর বইসি কি হবি।
কেন, তোমার প্রশ্নের উত্তর শুনবা না?
না রে, তোর উত্তর আর আমার শুনতি হবিলা। তুই কবু কলেরার কতা। তুই কবু গুটি বসন্তের কতা। সেই সব দিনের কতা মনে হলি, একুনো বুকের মদ্যি কাঁইপি কাঁইপি উটে। প্রতিদিন ঘুম থেকি উইটি শুনি, উত্তর পাড়ায় তিনজন মরিছে। গুয়ালবাথানে দুইজন। এমন কুনু দিন নাই যে, কুনু পাড়ায় কেউ মরে নাই। এবারও কী সে রকম হবি। আমার মনে হয় তার বেশিই হবি।

আমি বললাম, এসব কথা বলছো কেন মা?
তালি শুন, তখুন তো এত মানুষ ছিলি না। আর এখুন মানুষে মানুষে গিজগিজ করে। আর ছুঁয়াচি রোগ কারুক বাদ দিবি নানে। নামাজ কালাম পইড়ি আল্লাহ ডাকেক। সে ছাড়া কেউ রক্ষা করার নাই।

আমার মায়ের বয়স এখন পঁচানব্বই বছর প্রায়। একজীবনে কলেরা দেখেছে, গুটি বসন্ত দেখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। সেই মা যখন বলে, মানুষ মইরি চুচা হইয়ি যাবিনি, তখন চিন্তা এমনিতেই আসে। বুকে বেদনার বাসা বাঁধে করোনাকাল।

মায়ের সাথে কথা বলার এই সময় আমি কিছুটা অন্যরকম হয়ে যাই। করোনাকাল নিয়ে প্রতিদিন লিখি আমি। নিজের কথা, অন্যের কথা। কারো কারো না বলা কথা। অসংখ্য ভয়ার্ত মানুষের মুখ চোখে ভাসে আমার। এত এত জনসংখ্যার দেশ আমাদের। এত মানুষের চিকিৎসা সেবা দেবার মতো ব্যবস্থা আমাদের নেই। যদিও সরকার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় মিনু এলো। একসাথে সাতাশ বছর চলছি আমরা। একটা দীর্ঘদিন পথ হেঁটেছি আমরা। কত অভাব অভিযোগ একসাথে পারি দিয়েছি আমরা। কিন্তু এমন দিন আমাদের সামনে আসেনি। করোনার সাথে যুদ্ধ করছি এখন। অভাবের সাথে যুদ্ধ করছি এখন। জানি না আর কতদিন আমাদের এভাবে চলতে হবে।

মনে হলো, মা আমার এবার উঠবে। কিন্তু কি মনে হয়ে যেন আবার একটু বসলো। হ্যাঁ রে শুনতিছি মেলা রিলিফ আইছে। কিন্তু সেই রিলিফ গরিবেক না দিয়ে চেয়ারম্যান মেম্বার নেতারা মাইরি খাচ্ছে নাকি? তালি বুঝ, এদেশে সরকার ঠিকই সবকিছ দিচ্ছে কিন্তু কিছু মানুষ ছাড়া কেউ পাচ্ছেলাকো তা।

তখন টিভিতে খবর চলচ্ছে। শেখ হাসিনা তখন নিম্নবিত্ত মানুষের কথা বলছে। আমার এ দেশে কেউ না খেয়ে মরবে না। যাদের এখন কোনো ইনকাম নেই। যারা সাহায্য চাইতে পারবে না। আমি তাদের ঘরেও খাবার পৌঁছে দেব।

ততক্ষণে মিনু ঘর থেকে চলে গেছে। শেখ হাসিনার কথা শুনে মনে হলো, মা আমার কিছুটা আশায় বুক বাঁধলো। একা একা কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরুলো। তখন শুধু আমার কানে এলো, আমাদের ঘরে খাবার পৌঁছানো আগেই যদি ফসলের মতো ঘাসে খেয়ে ফেলায় ধান। আমরা যারা আছি আল্লাহপাক ঠিকই বাঁচাবি আমারে মান।

তিন.
বারবার করোনা নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে পারছি না। যখন সংবাদপত্রে চোখ রাখি। যখন টিভি স্কিনে পুরো বিশ্বের করোনা আক্রান্ত মানুষের ছবি দেখি, তখন আর গল্প লেখা হয় না। তখন কবিতারা সব পালিয়ে যায়। একবার চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো, এমন পৃথিবীর কথা আপনি কখনও কল্পনা করেছেন? না করেননি। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ এখন মৃত্যুর বিভীষিকায় পুড়ছে। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে স্বজনেরা। যেখানে বিশ্ব মোড়ালেরা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তবে মানুষের বাঁচার আকুতি। মানুষের বাঁচার প্রচেষ্টা। মানুষের বুকের সব হাহাকার। নিশ্চয়ই পৌঁছাবে তার কাছে।

তবে আমি আর কেন জানি লিখতে পারি না। আর কেন জানি লিখতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন লিখবো। এখনো বাজার ঘাটে লোকজন গুম গুম করছে। আমি যে এলাকায় থাকি সেখানে খুব বেশি মানুষের মধ্যে করোনা ভাবনা নেই। এখানে প্রতিদিন মাছের আড়তে মানুষ গিজগিজ করছে। সারাদিন সবজির আড়াতে হাজার হাজার মানুষ আসা যাওয়া করছে। খাদ্য গুদামে শত শত লেবার ট্রাক ডাইভার আসা যাওয়া করছে। গ্রামের মসজিদগুলো লুকিয়ে জামাত হচ্ছে। তরুণেরা তিনজন এক মটর সাইকেলে করে ফিল্ডিং মারছে। তখন কিছু মানুষ ঘরে থেকে কোনো লাভ হবে না।

তবে সব মানুষকে ঘরে রাখতে হবে, যাদের ঘরে খাবার নেই, সেই সমস্ত ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে গরিব মধ্যবিত্ত কেউ বাদ যাবে না। নইলে বিশ্বাস করুন, আমরা করোনার থাবা থেকে কেউ রক্ষা পাব না।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক