ড.আহমদ শরীফ

ড.আহমদ শরীফ

লাল পতাকার নিচে সাংস্কৃতিক আন্দোলন

শেষ পর্ব

মহসিন শস্ত্রপাণি

প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০১৯

আর তিনটি উদ্যোগের কথা বলে আমি এ আলোচনা শেষ করতে চাই।

এক: ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’। ২৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে এই ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিলো ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৮ সালে, ওই সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের এক সাধারণ সভায়। এতে সরাসরি কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠিতে যুক্ত নন এমন বিশিষ্ট প্রগতিশীল লেখক–শিল্পী–বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। বাংলাদেশ লেখক শিবির ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ঐক্যবব্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলো। এটাই ছিলো বাংলদেশে এমন প্রথম উদ্যোগ। [স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৬ সালের সম্মিলিত একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ঘটনা। সেটাও ছিলো বাংলাদেশে সম্মিলিতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের প্রথম সার্থক উদ্যোগ। সে উদ্যোগে ‘পিকিংপন্থী’ বলে পরিচিত ঢাকার প্রায় সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ও লেখক–শিল্পী–সাংবাদিক–বুদ্ধিজীবী, এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও সামিল হয়েছিলেন। নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন ছাড়া বরুদ্দীন উমর– এর সম্পাদনায় প্রতিরোধের একুশ নামে একটা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিলো। বলা বাহুল্যই হবে যে, এ উদ্যোগে ‘মস্কোপন্থী’ ধারার কোনো লেখক–শিল্পী–বুদ্ধিজীবী অংশ নেয়নি।

লেখক শিবির–এর সভাপতি ড.আহমদ শরীফ ও সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার কবির স্বাক্ষরিত এক আহ্বানে (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৭) সাড়া দিয়ে ঢাকার ১৩টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা ২ জানুয়ারি ১৯৭৮ এক বৈঠকে মিলিত হয়। ওই বৈঠকে ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে ‘ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচী’ প্রণয়নের জন্য ১৩ সদস্যের একটি সাব–কমিটি গঠিত হয়। ১৫ জানুয়ারি সাব–কমিটির সভায় মহসিন শস্ত্রপাণি উত্থাপিত ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীর খসড়া সাধারণ সভায় উপস্থাপনের জন্য অনুমোদিত এবং এর পরের দিন ১৬ জানুয়ারির সাধারণ সভায় গৃহীত হয়। ওইদিন ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ২৩ সংগঠনের সমন্বয়ে। এই সংগঠনগুলো হচ্ছে– বাংলাদেশ লেখক শিবির, উন্মেষ সাহিত্য–সংস্কৃতি সংসদ, দুর্জয় সংস্কৃতি সংসদ, সমষ্টি, নাট্যফৌজ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ছড়া সংসদ, উচ্চারণ সাহিত্য চক্র, সুকান্ত একাডেমী, গণ–সংস্কৃতি পরিষদ, দেশকাল, ভাষা সমিতি, ঢাকা শিশু নাট্যম, অস্বীকার, বহুবচন নাট্যগোষ্ঠী, শিরোনাম গোষ্ঠী, উদয়ন সংঘ, চলচ্চিত্র কর্মী শিবির, আরণ্যক, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, সাহিত্য ক্লাব, চলচ্চিত্রকার সংসদ এবং কিংশুক সাহিত্য গোষ্ঠী। পরে ধ্রুবতারা সংস্কৃতি সংসদ, পল্বব সাহিত্য চক্র, নয়া সমাজ ও অগ্নিবীণা সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ যোগ দিলে ফ্রন্টভুক্ত সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭টি।

ওই সাধারণ সভায় ২০১ সদস্যের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন ড. আহমদ শরীফ। কোষাধ্যক্ষ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আর পাঁচ সদস্যের সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন– আবুল কাসেম ফজলুল হক, নরেন বিশ্বাস, মহসিন শস্ত্রপাণি, নাজমুল হক নান্নু ও শাহরিয়ার কবির।

ড. আহমদ শরীফ চেয়েছিলেন একটা সম্মেলনের মধ্যেই এই ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ সীমিত রাখতে। কিন্তু কয়েকজন তরুণ অনেকটা জেদ ধরে একটা সংস্কৃতিক ফ্রন্ট গঠন করার পক্ষে মত দেয়। শেষ পর্যন্ত ওই তরুণদের একগুঁয়েমী তিনি মেনে নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে মনে মনে নিশ্চয় হেসেছিলেন এই ভেবে যে, না ঠেকলে এদের শিক্ষা হবে না। সত্যিই আমরা ঠেকে শিখেছি।

ড. আহমদ শরীফ প্রধানত ছিলেন উদারনীতিক মানবপ্রেমী। প্রতিবাদ ও দ্রোহ ছিলো তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তিনি লাল পতাকার রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থক ও অনুরাগী ছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি বিশেষ কোনো রজনৈতিক কেন্দ্রের সদস্য বা সমর্থক ছিলেন না। তিনি সাধারণভাবে লাল পতাকার সংগ্রাম সমর্থন করতেন আবার তার বিবেচনামতো অকপটে যে কোনো ভুল–ত্রুটির সমালোচনাও করতেন। শোষক শ্রেণীর কোনো অংশের প্রতিই তাঁর কোনো রকম আস্থা বা সমর্থন ছিলো না। অথচ তিনি ফ্রন্ট–এর ঘোষণাপত্রে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’, ‘সম্প্রসারণবাদ’, ‘আগ্রাসী শক্তি’, ‘মুৎসুদ্দি শ্রেণী’, ‘সামন্তবাদ’ ইত্যাদি রাজনৈতিক দলিল ও প্রচারপত্রের শব্দাবলী ব্যবহারে আপত্তি করেননি। এতে ব্যক্তিগতভাবে আমি একইসাথে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম।

যাহোক, ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিক ফ্রন্ট’, ১৯৭৮ সালের ৭–৮–৯ এপ্রিল, যে সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছিলো ও সার্থক করে তুলেছিলো তেমনটা বাংলাদেশে পূর্বে বা পরে আর দেখা যায়নি। তিনদিনের এ সম্মেলনের প্রথম দিন, উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। ঢাকার ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সম্মেলনে যোগদানকারী লেখক–শিল্পী–সংস্কৃতিকর্মীদের কমিটির পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন সাংবাদিক মাশির হোসেন। ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন–শাহরিয়ার কবির এবং আলোচনা করেন– আবুল কাসেম ফজলুল হক, নরেন বিশ্বাস ও মহসিন শস্ত্রপাণি।

এরপর দ্বিতীয় অধিবেশনে ৪টি ও দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে ৫টি– এই দুই অধিবেশনে মোট ৯টি প্রবন্ধ পঠিত হয়– প্রবন্ধ সাহিত্য, গল্প–উপন্যাস, কবিতা ও ছড়া, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা, নাটক ও যাত্রা, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এবং শিল্পী–সাহিত্যকদের সাংগঠনিক ভূমিকা বিষয়ে। প্রবন্ধ পাঠের এই দুই অধিবেশনের প্রথম দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন নূরুল হুদা মির্জা, দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন ও তৃতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা প্রতিনিধিরা [ বিশেষকরে লেখক শিবির, উন্মেষ ও গণ–সংস্কৃতি পরিষদ–এর ] তাদের এলাকার সাংস্কৃতিক তৎপরতার রিপোর্ট পাঠ করেন। তিনদিন ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, সংগীত ও নাটক অভিনীত হতো। এক সন্ধ্যায় ‘মাও সেতুং যেখানে ছিলেন’ নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়।

সম্মেলনের শেষ দিনের শেষ অধিবেশনে সামগ্রিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন ড. আহমদ শরীফ এবং আলোচনায় অংশ নেন– নূরুল হুদা মির্জা, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস। আলোচনা শেষে খসড়া ঘোষণাপত্র, নীতিমালা, কর্মসূচী ও গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয় এবং ১১ সদস্যের সম্পাদকমন্ডলী নির্বাচিত হয় এক বছরের জন্য। সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ড. আহমদ শরীফ। সহ– সভাপতি ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ম. নূরুন্নবী ও মহসিন শস্ত্রপাণি। কোষাধ্যক্ষ আমানুল্লাহ কবির। সদস্যগণ– শাহরিয়ার কবির, ইন্দু সাহা, শরীফ হারুণ, নওশের ইসলাম ও জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়।

সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের শেষে “বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে দেশের প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান” জানানো হয়।

সম্মেলন উপলক্ষে ‘সাংস্কৃতিক ঐক্য’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিলো। ‘ফ্রন্ট’–এর সম্পাদকমন্ডলীর সম্পাদনায় স্মরণিকা প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রকাশনা উপ–কমিটির আহ্বায়ক মুনতাসীর মামুন। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন রফিকুননবী। লিখেছিলেন ড. আহমদ শরীফ– ‘আর্ত মানবতার প্রতি মানবদরদীর দায়িত্ব’; ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী– ‘সংস্কৃতিতে প্রতিক্রিয়াশীলততা’; বদরুদ্দীন উমর– ‘জনগণের সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা’; নূরুল হুদা মির্জা– ‘প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়া সংস্কৃতির সংগ্রাম’; মহসিন শস্ত্রপাণি– ‘নব শক্তির বিজয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য’; আবুল কাসেম ফজলুল হক– ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দুই ধারা’; নরেন বিশ্বাস– ‘লোকনাট্য ও সঙ্গীত প্রসঙ্গ’ এবং শাহরিয়ার কবির– ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি– প্রসঙ্গ: নাটক ও চলচ্চিত্র’।

স্মরণিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিলো:

সাংস্কৃতিক আন্দোলন কেবলমাত্র শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলে জনগণের জীবন সংগ্রাম সংস্কৃতিতে যথার্থভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না। কেননা, জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বসবাস করেন গ্রামাঞ্চালে। তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আমাদের অবশ্যই টেনে নিয়ে যেতে হবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার সমস্যা মীমাংসা করা এই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। [ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই চেতনা ও ঘোষিত উদ্দেশ্য স্মরণিকার সম্পাদকীয়তেই আটকে থেকে গিয়েছে, বাস্তব করে তোলার কোনো পদক্ষেপই আমরা নিতে পারিনি।]

স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলোর মধ্যে নূরুল হুদা মির্জা ও শাহরিয়ার কবিরের রচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ এবং ভারত রাষ্ট্রকে ‘সম্প্রসারণবাদী’ বলা হয়েছিলো। আবুল কাসেম ফজলুলক হক বলেছিলেন ‘বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদ’ ও ‘সম্প্রসারণবাদ’। [স্মরণ করা যেতে পারে, ওই সময় শাহরিয়ার কবির ও ড. মুনতাসীর মামুন তাদের প্রাসঙ্গিক রচনায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ ও ভারতকে ‘সম্প্রসারণবাদী, বলে উল্লেখ করতেন। পরে অবশ্য তারা মত ও পথ পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সেবক ও প্রচারক হিসেবে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেন তা কারো অজানা নয় আর তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও প্রাসঙ্গিক নয়।]

গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট ওই সম্মেলনের পর উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো তৎপরতা চালাতে পারেনি। তার পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিলো। তবে প্রধান কারণ রাজনৈতিক। ফ্রন্টভুক্ত সংগঠনগুলোর অধিকাংশই ছিলো ছোট ছোট গোষ্ঠি। যে কটা সংগঠন ফ্রন্টের তৎপরতা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো সেগুলো কোনো না কোনো গোপন কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলো। আর ওইসব গোপন কেন্দ্র সম্মিলিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার ব্যাপারে যেমন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতে পারেনি, তেমনি বাস্তব কর্মপদ্ধতিও নেয়নি। বলা যায় তা নেবার মতো সাংগঠনিক যোগ্যতা ও বিচক্ষণতা তাদের ছিলো না, আজো নেই। ফলে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ কেন, তেমন আর কোনো উদ্যোগে তারা পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা দিতে পারেনি। এ থেকে এ সত্য আরেকবার প্রমাণিত হয় যে, সঠিক রাজনৈতিক দিশা ও নেতৃত্ব ছাড়া বুদ্ধিজীবী এবং কবি, লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিজেদের উদ্যোগে কোনো আন্দোলন যেমন প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকাশলাভ করতে পারে না, তেমনি ওইসব আন্দোলনে যেটুকু সাফল্য বা সুনাম অর্জিত হয় তা তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করে ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগায় সুবিধাবাদীরা। তরপরও ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ সম্মিলিত উদ্যোগের যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে তা কোনোমতেই উপেক্ষা করার নয়।

ফ্রন্টের দুটো ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। তার একটা হলো–১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ‘শান্তি ও সহযোগিতা’ চুক্তি স্বাক্ষর করার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদ পেয়ে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ায় আগ্রাসন চালায় এবং এক পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে ওই দেশটিতে কার্যত তার দখলদারি কায়েম করে। তার বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দা প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশেও বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছিলো আর সমর্থন জানানো হয়েছিলো কম্বোডিয়ার জনগণের ন্যায় সংগ্রামের পক্ষে। ফ্রন্টের পক্ষ থেকেও পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটা বিবৃতি দেয়া হয়েছিলো। বিবৃতির ভাষাকে ড. আহমদ শরীফ ‘একটু কড়া হয়েছে। আমি অবশ্য একটু নরম ভাষায় লিখেছিলাম’ মন্তব্য করেও ওই বিবৃতিতে ফ্রন্ট–এর সভাপতি হিসেবে স্বাক্ষর দেবার সময় তাঁর মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটেছিলো। তাঁর এই ধরনের ভূমিকার কারণেই তিনি অধিকাংশ কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের শ্রদ্ধা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।

অন্য ঘটনাটি হলো, ফ্রন্ট–এর পক্ষ থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা প্রদান। উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক শ্রেণী–সংগ্রামী, সংগীতশিল্পী ও সংগীতজ্ঞ হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্স’–এর কয়েকজন সাথী–শিল্পী সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মার্চ মাসের ২ তারিখে ফ্রন্ট–এর পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে ও্ই অনুষ্ঠানে প্রায় দুহাজার শ্রোতা–দর্শক সমবেত হয়েছিলো। আমাদের ধারণা এমন আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ সংবর্ধনা হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর পূর্বে বা পরে আর পাননি। তিনি ও তাঁর সাথী–শিল্পীরা সত্যিসত্যিই অভিভূত হয়েছিলেন। আমরাও এমন একজন শিল্পী–সংগ্রামীকে সংবর্ধনা দিতে পেরে আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছি।

দুই: ড. আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের শেষ সাংগঠনিক উদ্যোগ– ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’।

দেশের কমিউনিস্ট ও বাম প্রগতিশীল শক্তির বহু কেন্দ্রে বিভিক্তি প্রত্যক্ষ করে ড. আহমদ শরীফ অত্যন্ত বেদনাহত, আশাহত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। আলোচনা সভায় বক্তৃতায় কিংবা ঘরোয়া বৈঠকে সব সময় তিনি তা প্রকাশও করতেন ও ওই শক্তির ঐক্যের পক্ষে কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটা প্রিয় ইংরেজি বাক্য ছিলো United we stand, divided we fall.কমিউনিস্ট ও বাম শক্তির ঐক্য বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালনের ইচ্ছায় তিনি একসময় একটা রাজনৈতিক দল গঠনের কথাও ভেবেছিলেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের সাথে কিছুদিন ধরে আলাপ–আলোচনাও করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর একার কথা গুরুত্ব পাচ্ছে না, একটা দল গঠন করে চেষ্টা চালালে বামপন্থীদের ঐক্যের ব্যাপারে ইতিবাচক সুফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে তেমন কোনো সাড়া পাননি।

সে রকম আরেকটি ও তাঁর জীবনের শেষ উদ্যোগ ছিলো তাঁর মৃত্যুর মাত্র ৪৮ দিন পূর্বে, ১৯৯৯ সালের ৭ জানুয়ারি। ওইদিন তাঁর বাড়িতে ১২–১৪ জন বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীর এক বৈঠকে সমাজতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রাথমিক আলোচনা হয়। এটাই ছিলো ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’ গঠনের প্রথম উদ্যোগ [তার কয়েকদিন পূর্বে অবশ্য খুবই ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে ডেকে তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন]। একটা ঘোষণাপত্রও প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়। সেই ঘোষণাপত্রের একটা ভূমিকা রচনা করেন ড. আহমদ শরীফ। সেটাই তাঁর জীবনের সম্ভবত শেষ রচনা। তাতে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন:

“আমরা যারা বামপন্থীদের নেতা কর্মী নই, অথচ মনে প্রাণে তাদের সমর্থক… আমরা পরিণামে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মানব মুক্তিকামী প্রগতিশীল মার্কসবাদসম্মত চিন্তাশীল যুক্তিবাদী ব্যক্তিদের একটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সংঘ গঠন করতে চাই।”

এই ‘সংঘ’ গঠন বিষয়ে মতবিনিময় ও পরামর্শের জন্য তিনি বাম নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে ১৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সেদিন ওই বেঠকে উপস্থিত ছিলেন– বদরুদ্দীন উমর, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, নির্মল সেন, খালেকুজ্জামান, দিলীপ বড়ুয়া, প্রমুখ। ডা. এম এ করিম ও টিপু বিশ্বাসের উপস্থিত থাকার কথা ছিলো, তবে থাকতে পারেননি। সেদিন ড. আহমদ শরীফ সূচনা বক্তব্য হিসেবে প্রায় এক ঘন্টা ধরে ভাষণ দেন। সম্ভবত, এটাও ছিলো তার জীবনের শেষ ভাষণ।

উপস্থিত নেতারা ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’ গঠনের উদ্যোগকে সমর্থন জানান ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবার আশ্বাস দেন। [পরে তারা সে সমর্থন ও আশ্বাসের কথা স্মরণ রাখতেন কিনা সে প্রশ্নটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। পরে আমরা দেখেছি, সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধী একটা ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ তাদের অসহযোগিতার ফলে সফল হতে পারেনি।।]

ড. আহমদ শরীফ ২৪ ফেব্রুয়ারি ( ১৯৯৯ ) আকস্মিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে ‘সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘ’ গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থতার চোরা বালিতে তলিয়ে যায়।

এই ‘সংঘ’ গঠনের স্বল্পকালীন প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তারা একটা বিষয় লক্ষ্য করে একইসাথে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছেন। তা হলো, তিনি উদারনৈতিক মানবতাবাদী থেকে ক্রমে মার্কসবাদী হয়ে উঠেছিলেন এবং নির্ভরযোগ্য কর্মী বাছাইয়ের প্রশ্নে যে ধরনের সতর্কতা তিনি অবলম্বন করেছিলেন তা ছিলো অনেকটা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী বাছাইয়ের মতো।

তিন: লাল পতাকার নিচে ঢাকাকেন্দ্রিক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সর্বশেষ অভিজ্ঞতা ‘গণ–সংস্কৃতি ফ্রন্ট’।

মে দিবস উদযাপন সামনে রেখে ‘জনগণের সমাজ বদলের সংগ্রামে কার্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করে। তারা এপ্রিল মাসে গঠন করে মে দিবস উদযাপন সাংস্কৃতিক কমিটি’। যে ১৫টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা এই কমিটি গঠন করে সে সংগঠনগুলো হচ্ছে– সৃজন, গণশিল্পী সংস্থা, ধ্রবতারা, কবি সুকান্ত স্মৃতি সংসদ, সমাজ চেতনা, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আপেক্ষিক, শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদ, গণ–সংস্কৃতি পরিষদ (হাসান ফকরী), সূচনা অধ্যয়ন চক্র, প্রত্যয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন, প্রগতি সংস্কৃতি সংসদ, শহীদ আসাদ পরিষদ, গণ–সংস্কৃতি পরিষদ (ম. নূরুন্নবী) ও উন্মেষ সাহিত্য–সংস্কৃতি সংসদ। কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন গণসংগীত শিল্পী কামরুদ্দীন আবসার।

যে সংগঠনগুলো এই ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করে তাদের মধ্যে কয়েকটি ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’–এর সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ‘জোট’–এর তৎপরতা বিষয়ে তারা অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে বিকল্প পথ সন্ধানে উদ্যোগী হয়। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে গড়ে ওঠে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’। উদ্যোগ পর্বে প্রগতিশীল বলে পরিচিত কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি এ প্রক্রিয়ার সামনের কাতারে থাকলেও ক্রমে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সহযোগী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ জোটের নেতৃত্ব ও পরিচালনায় দখল কায়েম করে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করার পর সাম্রাজ্যবাদের ও দেশের শোষকশ্রেণীসমূহের স্বার্থের সেবক রাষ্ট্রের সহযোগিতা করে ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ধন্য হয় এই ‘জোট’। ‘জোট’–এর মঞ্চে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদার্পণ করায় জোট নেতারা তাদের জীবন সার্থক হয়েছে বলে তুষ্ট ও আনন্দিত হয়। ‘জোট’–এর পরিণতি এমনটা যে হবে এর সূচনা পর্বে প্রক্রিয়ার প্রকৃতি লক্ষ্য করে দু–একটা সংগঠন ও দু–একজন ব্যক্তি সে কথা পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে ওই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে অস্বীকার করেছিলেন। ঢাকার ও দেশের বিভিন্ন স্থানের এমন কিছু সংগঠন ‘জোট’–এর সাথে শিথিল বন্ধনে যুক্ত আছে, যারা নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। বুঝে–শুনেই তারা ‘জোট’–এ আছে। নানা উপলক্ষে অনুষ্ঠানে অংশ নেয় এবং রাষ্ট্রীয় অনুদানের ভাগও হাত পেতে নিতে আপত্তি করে না। আবার এমন সংগঠনও দু–একটা আছে, বিশেষকরে নাট্যচর্চায়, বিপ্লবী বুলি আওড়ে থাকে আর ‘জোট’–এ অন্যদের সঙ্গে মিলে সাম্রাজ্যবাদ–নিয়ন্ত্রিত দেশের শোষক শ্রেণীসমূহের সংস্কৃতির সেবা দেয়। ‘নাটক শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’ ধ্বনি দিয়েছে আর নিয়মিত মনোরঞ্জন করে চলেছে সমাজের সুবিধেভোগী মধ্রবিত্তের। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের কিছু বাম–প্রগতিশীল দলের মতোই বুলি ও বাস্তব কাজের এমন অসঙ্গতি– যা নির্ভেজাল সুবিধাবাদ– কেবল বিভ্রান্তি ছড়ায় না, নিষ্ঠাবান কর্মীদের হতোদ্যমও করে।

যাহোক, ‘জোট’ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ দু–একটি সংগঠন এবং জোটভুক্ত হয়নি এমন সংগঠনগুলো মিলে এই নতুন ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’ ও আরো কয়েকটি সংগঠন এ প্রক্রিয়ায় যোগ দিলে সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১। পরে আরো ৩টি সংগঠন যোগ দেয়ায় ২৪টি সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় ‘গণ–সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ ১৯৯৯ সালের ১৪ মার্চ। কনভেনশন করে ‘ফ্রন্ট’–এর পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রূপ দেবার লক্ষে ওইদিন সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। তার সভাপতি নির্বাচিত হন মহসিন শস্ত্রপাণি ও সাধারণ সম্পাদক কামরুদ্দীন আবসার। সদস্যরা হলেন– হায়দার আনোয়ার খান জুনো, ম. নূরুন্নবী, মুঈনুদ্দিন আহমদ, মফিজুর রহমান লালটু ও সামীম আরা।

‘ফ্রন্ট’ গঠনের পূর্বে ঐক্য প্রক্রিয়া চলে এক বছর ধরে। এর মধ্যে ‘নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন সাংস্কৃতিক কমিটি’ ও ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকশের ১৫০ বছর উদযাপন সাংস্কৃতিক কমিটি’র নামে অনেকগুলো অনুষ্ঠান হয় এবং প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশ ও বিবৃতি প্রদান চলে। এরপর ২০০০ সালের আগস্ট মাসে কনভেনশন করে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। সে কমিটির সভাপতি মহসিন শস্ত্রপাণি ও সাধারণ সম্পাদক কামরুদ্দীন আবসার নির্বাচিত হন। বর্তমানে ফ্রন্টের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও মজিফুর রহমান লালটু।

‘গণ–সংস্কৃতি ফ্রন্ট’–এর ঘোষণাপত্রের ভাষা ও অভিব্যক্তি পূর্বে এ ধরনের যে কোনো উদ্যোগের ঘোষণাপত্রের মতোই। কেবল অতি সাম্প্রতিক বিষয়গুলো জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়। ঘোষণাপত্রের শেষে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় এভাবে:

“পুরোগামী সাংস্কৃতিক সংগ্রামীদের সংগ্রামের “ঐতিহ্যের পতাকা হাতে আমরা…সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীরা, বর্তমানের অসহনীয় অবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং জনগণের চেতনা ক্রমাগত বিকাশের অবিরাম ধারায় নিজেদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়োজিত করার লক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছি।”

‘গণ–সংস্কৃতি ফ্রন্ট’ সংগঠিত হবার সময় বাম রাজনৈতিক শক্তি বা কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে যে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাশা করা হয়েছিলো তা পাওয়া যায়নি। তবু জনগণের সকল আন্দোলনের সাথে থাকার যে অঙ্গীকার ‘ফ্রন্ট’ করেছিলো তা বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টা সাধ্যমতো করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর টিকে থাকার ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করতে হবে অবশ্যই। কেবল টিকেই থাকেনি, এ সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনে, বিশেষকরে ‘তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র প্রায় সকল আন্দোলনে ও লং মার্চে, অংশ নিয়েছে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা খনি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি এশিয়া এনার্জি সরকারের সহযোগিতায় যে চক্রান্ত চালায় তার বিরুদ্ধে ফুলবাড়ী ও সংলগ্ন এলাকাগুলোর জনগণের সংগ্রামে ‘ফ্রন্ট’–এর কর্মীরা সাধ্যমতো যুক্ত ছিলো। এ সব ঘটনায় ‘ফ্রন্ট’–এর কর্মীরা যেমন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছে ও নতুন নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে সংস্কৃতি কর্মীদের জন্যে স্মরণ ও অনুসরণের মতো দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। এছাড়া প্রতিবছর নিয়মিত ‘আসাদ দিবস’ উপলক্ষে সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি এবং সংগীত ও নাটক অনুষ্ঠান এবং সেইসাথে বইমেলার আয়োজন করে থাকে।

রাজনৈতিক শক্তির তরফ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার ফলে মাত্র কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা ‘ফ্রন্ট’–এর তৎপরতা চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ চেষ্টা তারা আর বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারবে– তেমনটা আশা করা যায় না।

সুধীবৃন্দ, লাল পতাকার নিচে সংস্কৃতিক আন্দোলনের যে রেখাচিত্র আপনাদের সামনে উপস্থিত করলাম তাতে অসার্থকতার দিকটাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। এটাই আমাদের কালের বাস্তবতা। দুনিয়া জুড়ে লাল পতাকার সংগ্রাম সামায়িককালের জন্যে হলেও, পরাজিত হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। সেই সত্য যারা অনুধাবন করতে পারে তারা ভবিষ্যতে বিজয়যাত্রার আশা ছাড়তে পারে না। আমরাও বারবার অসার্থকতার গ্লানি ঝেড়ে ভবিষ্যৎমুখী যাত্রাকে সচল রাখার চেষ্টা কখনোই ছাড়িনি। আমাদের পূর্বে যারা পথ হেঁটেছেন তারা আমাদের প্রেরণা। আমাদের কালে যারা আশার প্রদীপ জ্বেলে রাখার চেষ্টা করেছেন তারা আমাদের শক্তি। তারাই এই যাত্রা যন্ত্রণাবিদ্ধ বর্তমানকে উজ্জ্বল ও আনন্দময় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন– এই প্রত্যয় আমাদের এতোটুকু দুর্বল হয়নি। আমাদের দেশে ও বিশ্বব্যাপী স্বদেশের শোষক ও শাসকশ্রেণীসমুহের ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণ লুণ্ঠন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণ যে সংগ্রাম চালাচ্ছেন তার মধ্যদিয়েই লাল পতাকার রাজনৈতিক শক্তি সংঘবদ্ধ হবে এবং বিচক্ষণ ও যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশ লাভ করবে অবশ্যই। আর সেই রাজনৈতিক শক্তির অধীনে ও পরিচালনায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনও পূর্ণ মাত্রায় প্রস্ফুটিত হবে– এ বিশ্বাস আমাদের এতোটুকু টলেনি। ইতিহাস এখানেই শেষ নয়, তা হতেও পারে না। যতোদিন সমাজ শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভক্ত থাকবে, শোষণ–নির্যাতন ও অবদমন থাকবে ততোদিন সংগ্রাম চলবে শোষণ–নির্যাতন ও অবদমনের ব্যবস্থার অবসান না হওয়া পর্যন্ত। জনগণের শক্তি ও সামর্থ্যরে ওপর যাদের আস্থা আছে তাদের অগ্রযাত্রা কোনো শক্তিই স্তব্ধ করতে পারে না। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
লাল পতাকার নিচে সংস্কৃতিক আন্দোলনের এই রেখাচিত্র যদি ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের আরো অনুসন্ধানে ও শিক্ষা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে তাহলেই এই এটি আঁকার চেষ্টা সার্থক হয়েছে বলে জানবো। আপনাদের সকলের মঙ্গল কামনা করি ও ধন্যবাদ জানাই।