প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

লড়াই ও মহানবীর আদর্শ

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ

প্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২০

শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ইবরাহীম খাঁর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম টাঙ্গাইল জেলার তৎকালীন ভুঞাপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী গ্রামে, ১৮৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘ইসলামের মর্মকথা’ বই থেকে কিছু অংশ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আজ হতে পৌনে চৌদ্দশো বছরেরও আগের কথা। তখন আরবের মক্কানগরে এক কথায় অনাথার কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন এক অনাথ শিশু। নাম রাখা হয়, মুহম্মদ। শিশু বড় হয়ে মরণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর বাকি জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি, সমস্ত আনন্দ-উৎসব, সমস্ত কর্ম ও সাধনা মানুষের সেবায় নিয়োগ করেন। তাঁর চেয়ে মানুষের বড় বন্ধু এ দুনিয়ায় আর জন্মান নাই। আল্লাহ তাঁকে মানুষের ভালোর জন্যই পাঠান। এজন্য তাঁকে বলা হয় রছুলুল্লাহ অর্থাৎ কিনা আল্লাহর পাঠানো মানুষ। এই কারণে তাঁকে নবীও বলা হয়। আবার সব নবীর মধ্যে তিনি কাজে বড় ছিলেন বলে তাঁকে কেউ কেউ বলেন মহানবী। তাই আমরা তাঁর নামের আগে বলি হযরত, অর্থাৎ মাননীয়।

হযরত মুহম্মদ (দ.) কয়েকটি লড়াইয়ে শরীক হন। মানুষের দুঃখে যাঁর চোখ হতে আঁছুর ছয়লাব বয়েছে, মানুষের মঙ্গল চিন্তায় যিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গভীর ধ্যানে কাটিয়েছেন, তিনি আবার তলোয়ার হাতে যুদ্ধে গেলেন এ কেমন কথা, কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন। সংক্ষেপে এর উত্তর যে, মানুষের ভালোর জন্যই তিনি লড়াইয়ে নেমেছেন।

মহল্লায় যদি হঠাৎ পাশের জঙ্গল থেকে বাঘ এসে বাসিন্দাদের উপর হামলা করে, তখন মহল্লার অতি বড় ধার্মিককেও তছবী ছেড়ে বন্দুক হাতে দাঁড়াতে হয়। মানুষের সমাজেও অমন মন্দ মানুষ মাঝে মাঝে দেখা যায়। তারা ভালো মানুষদের ক্ষতি করে। হয়তো ভালো মানুষদের মেরে কেটে দুনিয়ার পিঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। তারা উপদেশ শোনে না, উপকার পেয়েও থামে না। একমাত্র লড়াই ছাড়া তাদের হাত হতে সমাজের নিরীহ মানুষদের বাঁচানোর আর কোন পথই থাকে না। মহানবী যখন প্রথম ইছলাম প্রচার শুরু করলেন তখন মক্কার বেশীর ভাগ লোকই ক্ষেপে উঠলো। তাঁরা বলল ঃ আমাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষেরা যেসব দেব-দেবীর পূজা করে গেছেন, তাদের বাদ দিয়ে মুহম্মদ একমাত্র আল্লাহর এবাদত কায়েম করতে চায়, লোকটা তো ভাল নয়। ওকে শাস্তি দাও।

এক বুড়ী রছুলুল্লাহর পথে রোজ কাঁটা গেড়ে রাখত। দুই-একটা কাঁটা রছুলুল্লাহর পায় ফুটে যেত। তিনি কাঁটা খুলতেন, বুড়ী দূরে দাঁড়িয়ে হাসত। তার দিকে চেয়ে রছুলুল্লাও হাসতেন। তারপর তিনি তাঁর কাজে চলে যেতেন। একদিন ঐ পথে চলতে গিয়ে মহানবী বুড়িকে দেখতে পেলেন না। তার পরদিনও বুড়ীকে দেখা গেল না। মহানবী ভাবলেন বুড়ীর কোন বিপদ ঘটে নাই তো? তিনি খুঁজে খুঁজে বুড়ীর বাড়ি গেলেন। দেখলেন, বুড়ীর অসুখ। তিনি বুড়ীর মাথার কাছে বসলেন, তার শুশ্রুষা করলেন। বুড়ী ভালো হয়ে রছুলুল্লাহর আপন হয়ে গেল। এমনিভাবে মহনবীর মধুর ব্যবহারে, তাঁর অমূল্য উপদেশে মক্কার কতক লোক মদ-জুয়া ছাড়ল এবং এক আল্লাহর এবাদত স্বীকার করে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।

মক্কার বাকি লোকেরা তখন বৈঠক বসিয়ে ঠিক করল; মুহম্মদকে তো বললাম, যত টাকা চাও দেই; আমাদের সবার উপরে সর্দার হতে চাও, তাই করি, তবু তোমার ওই আল্লাহর কথা ছাড়। কিন্তু সে আমাদের কথায় রাজী হলো না। এখন দেখা যাচ্ছে, আস্তে আস্তে লোক ওর কথা কবুল করে ওর সঙ্গে যোগ দিয়ে ওই আল্লাহর কথা বলা শুরু করেছে। ওর দল আরো বড় হওয়ার আগে এখনি ওদের সবার কাল্লা কেটে এ আপদ দূর করতে হবে। মহানবী বললেন, গালি দিয়েছ সয়েছি, নিন্দা করেছ নীরবে শুনেছি, মারধর করেছ, ক্ষমা করেছি। কিন্তু এখন আমাদের খুন করে আল্লাহর নাম মিটিয়ে দিবে, এ হয় না। আল্লাহ এক, সমস্ত মানুষ ভাই ভাই এই সব মহাসত্যই ইছলামের বাণী; আমাদের কাল্লা কেটে সেই মহাসত্যের দীপ নিভিয়ে দিবে এ আমরা হতে দিব না; দরকার হয় তার জন্য আমরা লড়াইয়ের ময়দানে জান দিব।

এমনি নানা রকম অবস্থায় পড়ে মহানবী বাধ্য হয়ে সত্য রক্ষা ও আত্মরক্ষার জন্য দুশমনদের সামনে তলোয়ার খুলে দাঁড়ালেন। অন্যের রাজ্য জয় করে রাজা হওয়ার জন্য নয়, অন্যের ধন কেড়ে নিয়ে ধনী হওয়ার জন্য নয়, কেবল ধর্মের সত্য রক্ষার জন্যই যে মহানবী লড়াই করেছিলেন তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বদরের ময়দানে। মাত্র ৩১৩ জন মুছলমান প্রায় এক হাজার দুশমনের মোকাবিলায় যখন তলোয়ার খুলে দাঁড়াল, তখন অনেকে মনে করল ঝড়ের মুখে শুকনো কুটার মত বুঝি আজ মুছলমানেরা দুশমনের সামনে উড়ে যায়। সে বিপদে মহানবী আকাশের পানে দুই হাত তুলে বললেন, হে প্রভু, “হে দয়াল আল্লাহ! আজ আমাদের বিজয় দাও’ বিজয় দাও। কারণ, আজ আমার এই সঙ্গীদলসহ যদি আমাকে দুশমনের তলোয়ারের তলে মাথা দিতে হয়, তবে এ দুনিয়ায় তোমার নামের মহিমা কীর্তন করার আর কেউ থাকবে না।”

বদরের লড়াইয়ে মুছলমানেরাই জিতল, দুশমনেরা পরাজিত হয়ে ভেগে গেল। কিন্তু বদরের পরাজয়ে যে অপমান, তার কথা দুশমনরা ভুলতে পারল না। তারা ফের মুছলমানদের আক্রমণ করার জন্য দলে বলে জুটে এল। এবার তাদের সঙ্গে এল একদল নারী; তারা লড়াইয়ের ময়দানে গান গেয়ে সঙ্গী যোদ্ধাদের পাগল করে তুলল। তাদের গানের একটুখানি নমুনা:
প্রভাত তারার কন্যা আমরা সবে,
মখমল পরে করি মোরা বিচরণ,
বরি লই যারা জয়ী হয় আহবে,
লাথি মারি তারে ফিরে যে হারি রণ।

ওহোদের ময়দানেও তুমুল সংগ্রাম শুরু হল। এ যুদ্ধে মুছলমানদের মধ্যে অনেকে শহীদ হল। মহনবী নিজে ভয়ানকভাবে আহত হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারবে না দেখে দুশমনরা ময়দান ছেড়ে চলে গেল। তখন মহানবীর সঙ্গীরা এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়াল। দেখল, দুশমনেরা নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে আঘাতে তাঁর দাঁত ভেঙ্গেছে, তাঁর কপাল ফেটেছে, তাঁর মাথা জখম হয়েছে, তাঁর মুখম-ল বেয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছে। তাঁর যোদ্ধাদল বিদায় হওয়ার আগে তিনি তাদের একত্র করে নির্দেশ দিতেন; ‘খবরদার। শিশু-নারী-বৃদ্ধ এদের উপর জুলুম করো না, ফলবান গাছ কেট না, উট-ভেড়া-বকরী মের না, পানির কুয়া-ফোয়ারা নষ্ট করো না। পরাজিত দুশমনদের উপর অত্যাচার করো না, নিহতদের লাশের অবমাননা করো না, তাদের অঙ্গচ্ছেদ করো না।’

লড়াইয়ের নানা অবস্থার ভিতর দিয়ে মহানবীর মহান জীবনের মহান আদর্শ এমনিভাবে বারবার ফুটে উঠেছে।

লেখকের ‘ইসলামের মর্মকথা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো