শামসুর রাহমান ও জুয়েল মাজহার

শামসুর রাহমান ও জুয়েল মাজহার

শামসুর রাহমান: বাংলাদেশের কবিতার আবিবি বিকিলা

জুয়েল মাজহার

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০১৯

জীবনানন্দের পর দুই বাংলা মিলিয়ে শামসুর রাহমানই `সবচেয়ে বড় কবি`। আর বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার ভাষার পুরোটাই তৈরি করেছেন তিনি একা। বাংলাদেশে আমরা আজ যে ভাষায় কবিতা লিখছি তা শামসুর রাহমানের একার হাতে তৈরি করা ভাষারই কিছুটা অদল-বদল-করে-নেওয়া রূপ। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া আসবাবকে একটুখানি সংস্কার করে অধস্থন পুরুষরা যেভাবে ব্যবহার করে আর কি!

নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের (কালেভদ্রে কিছুটা জীবনানন্দেরও) বাইরে আর-কারো-কবিতা-পড়বেই-না বলে পণ করা, পাঠ্যপুস্তকে পড়া পদ্য-ছাড়া-আর-কিছু-পড়বেই-না বলে পণ করা পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালিকে— বিশেষ করে কবিতা ও শিল্পবিমুখ বাঙ্গালি মুসলমানকে— আধুনিক কবিতা পড়িয়ে ছাড়লেন শামসুর রাহমান। সেজন্য দরকার ছিল ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, উপযুক্ত এক ভাষা তৈরি করে নেওয়া। তিনি তা করলেন— আস্তাবল পরিষ্কার করেছিলেন যেমন হারকিউলিস।

‘নিঃসঙ্গ শেরপা’ শামসুর রাহমান একাই করলেন এক অসম্ভবকে সম্ভব। আজ উল্লম্ফনবাদীরা ভাবে, এসবকিছুই— এই ঝকমকে আধুনিকতা, কবিতার এই মসৃণ পথচলা— বুঝিবা হঠাৎই আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছে। ক্রিসমাসের সময় বাচ্চারা যেমন গিফট পেয়ে এরকম কতো কিছুই না ভাবে!

বড় কবিরা— শামসুর রাহমানের মতো প্রকৃত অর্থে বড় কবিরা— কেবল কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হন না; বরং তারা ভবিষ্যকালের জন্য, অনাগত প্রজন্মের লেখার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে যান, পথরচনা করে যান; শিখিয়ে যান লীলা ও সন্তরণক্রীড়া। যেমনটি করেছিলেন মাইকেল; একাই বন-জঙ্গল কুপিয়ে, ঢেলা ভেঙ্গে মসৃণ করে, বীজ রোপণের উপযোগী করে। যেমন করেছিলেন পরে রবীন্দ্রনাথ, করেছিলেন জীবনানন্দ অন্য এক কখনো-না-দেখা আর অনাস্বাদিতপূর্ব এক জগতের পথরচনা— তার নিজেরই ‘আপন মুদ্রাদোষে’। এই কবিরা একইসঙ্গে কবি, পথপ্রদর্শক ও দ্রষ্টা।

শামসুর রাহমান চকিত ঝলকসর্বস্ব কবি নন। ছোট দৌড়ের উসাইন বোল্ট নন। বরং তিনি এক ম্যারাথন রেসার। ইথিওপিয়ার ম্যারাথন রেসার আবিবি বিকিলার মতো। যিনি জুতাহীন খালি পায়ে অলিম্পিকে ম্যারাথন রেস জিতে দুনিয়াকে চিনিয়েছিলেন নিজের জাত। শামসুর রাহমানও বাংলাদেশের কবিতায় খালি পায়ে দৌড় শুরু করা এক আবিবি বিকিলা।

অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ক্রমাগত চেঁচায় আর লাঙ্গুলতাড়না করে চলে যারা, তারা যখন-তখন যাকে পারবে তাকেই নাকচ করবে। শামসুর রাহমানের মতো বড় কবিদের অপচয়ও আছে— যে কোনো বড় কবিরই তা থাকে। তাই বলে অপচয়টাকেই বড় করে দেখে বদনাম করে যায় অনেকে। রবীন্দ্রনাথও এই অপবাদের শিকার কম হননি/হন না। কিন্তু এরা জানে না, অপচয়কে সরিয়ে নিলে যে পরিমাণ স্বর্ণশস্য পাওয়া যায় এই মহাজন কবিদের সমগ্র কাজের ভেতর, তার তুল্য কাজ গণ্ডায়-গণ্ডায় গৌণকবি হাজার বছর আয়ু পেলেও রেখে যেতে পারবে না।

আমাদের চারপাশে শামসুর রাহমানের মতো বড় কবিকে ছোট করে দেখানোর জন্য কবিনামধেয় অনেকের লাঙ্গুল-তাড়না দেখতে পাই ইদানীং। অথচ এরা জানেন না, সূর্যের এক নিমেষের আলোকপাতের সমান নয় কোটি মশালের আলো। উপকূলের অদূরে ধীরগতির কোনো সমুদ্রগামী জাহাজের পাশ দিয়ে চলা দ্রুতগামী ডিঙি নৌকার মাঝির মনে হতেই পারে, `‘এতবড় জাহাজও তো আমার ডিঙির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না।’

এটা তার দোষ নয়; ক্ষুদ্র জলসীমার মাঝি বলেই সে ভাবে এমন। বিশাল উন্মুক্ত সদানির্ঘোষময় সাগরের বিশালতা সে দেখতে পায় না বলেই তার দেখার দিগন্ত এতো ছোট। কেননা দূর থেকে আকাশের চাঁদকেও নিজের ভাতের থালাটির চেয়ে ছোটই মনে হয়। নজরুল যেমন বলেছিলেন একদা:

তিন্তিরি গাছে জোনাকির দল
চাঁদের নিন্দা করে কেবল।

কবি ও মানুষ শামসুর রাহমান, আপনাকে স্যালুট!

লেখক: কবি