শামীমা জামানের গদ্য ‘আমার শরৎবেলা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯

শরৎ আসে সেজেগুজে। স্নিগ্ধ সফেদ নির্মল সাজে। বসন্তের চেয়ে তার আবেদন কোনও অংশে কম নয়। আজ যদি সন্তানকে শরৎ বোঝাতে চাই, কোনও অনুভূতির ছোঁয়া ওকে দিতে পারবো না, কেবল ভার্চুয়াল শিউলি বা বন্ধুদের কাশবনে যাওয়া ছবি ছাড়া। অথচ শরৎ আসতো ভীষণভাবে। ঘন কাশবনে। আমাদের কচি কচি প্রাণে। শিউলির ঘ্রাণে।

সেইসব ভোরে। পথের প্যাঁচালীর দুর্গা এসে ডাকতো। ঘুমের ঘোরে। পা টিপে টিপে বের হয়ে প্রথমে খানিক পথ ঘাসের গায়ে শিশিরের চাঁদর মাড়িয়ে শরীরের যত্ন নেয়া। কিছুটা শিশির হাতে নিয়ে মুখে আলতো করে ছোঁয়ানো। দুধ খেয়ে যেমন শক্তি বোধ হয় তেমনি যেন রূপসী হয়ে উঠত ত্বক সে ছোঁয়ায়। এসবই দুর্গা মানে লিতা প্রযত্নে অ্যাডভোকেট ওয়ালিউর রহমানের কথা। সে ছিল সবজান্তা। দস্যি জ্ঞানী।

চিত্রাপাড়ের সরু ইট বিছানো রাস্তা ধরে কিছুপথ এগোলে বালিকা বিদ্যালয়। ভোরের অভিযান কেন্দ্র। যত ভোরে দারোয়ান, ঝাড়ুদার, মাসিও এসে পৌঁছায় না। অগত্যা তালাবন্ধ গেটের নিচে দিয়ে ছোট্ট শরীর দুটো পাচার হতো। মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে সেই মোহময়ী সুন্দরী! সারা গা সবুজ পত্রপল্লবে ঢাকা। গেরুয়া বোঁটার গায়ে সাদা তারাগুলো ঝিকমিক করে। আর আমাদের বিজয়ী মন চনমনে উদ্যমে নেচে ওঠে।

মাটির ফুলেল বিছানা থেকে ফ্রকের কোচর ভরে আনন্দ তুলি। ফিরতে পথে মুঠো ভরে মৃগনাভি নিঃশ্বাস নিতে নিতে কে জিতলো সেই হিসেব কষা। বারান্দার সিঁড়িতে বসে সেই গেরুয়া বোঁটায় সুঁই ফুঁড়ে যেত। এত যত্ন আয়োজনে গড়া শিউলি মালা খানিকবাদেই তার রূপরস হারাতো। তাতে কী! পরদিন আবারো মহা সমারোহে অভিযান চলতো। কোনও কোনোদিন ঘুম ভাঙতো সেই মাতাল গন্ধে। চোখ মেলে দেখতাম, একমুঠো শিউলি। বালিশের পাশে নাক বরাবর।

সুবহে সাদিকের সময় আব্বা নামাজ পড়তে যেতেন। ফেরার পথে পকেট ভরে শিউলি এনে ঘুম ভাঙাতেন। কখনো বা বেলি, গন্ধরাজ আর কাটা কাঁটা বকুল ফুল। আহা! এমন করে এখন আর কেউ ঘুম ভাঙায় না।

পাড়ার মাঝে দূরের বাড়ি থেকে লতা আর তার বোন আশা মধু ঢেলে সকলকে এক করতেন। আমরা সে মধুর টানে পায়ে পায়ে সেখানে পৌঁছে যেতাম বিশ্ব জয়ের আনন্দে। যেমন করে অপু আর দুর্গা রেললাইন অবধি পৌঁছেছিল। ছুন সায়েবা ছুন পেয়ার এক ধুন...। কাছে গিয়ে সেই ধুপ ধুনে মিশে যেতাম। প্রসাদের থালায় থরে থরে সাজানো পরিপাটি খাবারে আড়চোখে চেয়ে নেয়া। ছোট ছোট আখের টুকরোগুলো জিভের জলে গড়াগড়ি খায়। অসুরকে বধ করে হেমা মালিনী দুর্গা (তখনকার শিল্পীরা হেমা মালিনীর আদলেই দুর্গাকে গড়তো ) নারীবাদের ঝাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে। সেদিকে চেয়ে থেকে আমাদের পেলে পুষে বড় করা লিলিবুর সাবধান বাণী কানে বাজে, ‘ওদিকে চাইতে নেই। পাপ হয়।‘

কে শুনেছে কার কথা! শহরের সবগুলো পুজো মণ্ডপ ঘুরে বিচারকের দায়িত্ব যে আমাদেরই পালন করতে হতো। আর প্রতিবারই পাড়াতো পুজো মণ্ডপ হিসেবে অঞ্জলীদির দুর্গাই সেরা হতো আমাদের একপেশে বিচারে। আহা! সেই অপূর্ব সেক্সি হেমা মালিনী দুর্গা! এখনকার দুর্গারা লাইফের স্ট্রেস নিতে নিতে কেমন যেন রুক্ষ আর দাজ্জাল চেহারার। মিনিমাম প্রিয়াংকা চোপড়ার চেহারাও দিতে পারে না এরা। আহারে সেই শরতের মন কত ভালো ছিল!

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট