শিমুল বাশার

শিমুল বাশার

শিমুল বাশারের গদ্য ‘লেখালেখি, বইমেলা ও জীবনের গ্লানি’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০

পেশাগত কারণে বইমেলায় যাদের হাতে বই দেখি, তাদের ইন্টারভিউ নিতে আগায়া যাই। জানতে চাই, কি বই কিনেছেন? বেশিরভাগ সময়ই উত্তর আসে, কিনিনি। এটা আমার নিজের লেখা উপন্যাস। একজন লেখককে পাঠক ভেবে অবমূল্যায়ন করে ফেলায় আমি লজ্জায় মরে যাই। আমি পাঠক খুঁজি, লেখক নয়।

গেল বইমেলায় এক সহকর্মীর অনুরোধে একজনের ইন্টারভিউ নিতে হয়েছিল। যার এক মেলাতেই চারটি বই বেরিয়েছে। আমি খুব বিরক্ত হইছিলাম ওই লেখককে দেখে। পরে উনার কাছে জানতে চাইছিলাম, পরলোকগত হওয়া লেখক এবং কলকাতার লেখক বাদে বাংলা ভাষার পনেরো জন লেখকের নাম বলেন। উনি ছ’জনের নাম বলতে পারছিলেন। বাংলার ঘরে ঘরে এই যে লেখক সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই আমাদের সৃজনশীল প্রকাশক সমাজের।

নব্বইয়ে লেখক হবার বাসনা নিয়ে অনেক তরুণকে ঢাকায় আসতে দেখেছি। কোথায় হারিয়ে গেছেন তারা, কে জানে! শৈশবে এক অচেনা লোক আমাদের গ্রামের বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। তিনবেলা ভালো ভালো খাবার দিতেন আমার মা। শিক্ষিত লোক, সুন্দর করে কথা বলতেন। পকেটে কলম আর হাতে ডায়েরি থাকত সবসময়ে। তিনি লেখক পরিচয় দিতেন। গ্রামের লোকেরা তাকে সমীহ করতো।

আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আমার মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে পায়ের ছাপ না রেখে এভাবে মরে যাওয়া ঠিক হবে না। জীবনের গ্লানি, বঞ্চনার কথা বরং কিছু লিখে রেখে যাই। এই ভেবে ছোটগল্প লেখা শুরু করেছিলাম। একটা গল্প লেখা হয়ে যাবার পর কী যে শান্তি লাগতো! সেই শান্তি বারবার পাবার নেশা হয়ে গেল। সারারাত লিখতাম। একবার বসলে শেষ না করে উঠতে পারতাম না। ভোর হয়ে যেত। তখন খুব ভালো গল্পের কাগজ ছিল আনওয়ার আহমেদের ‘রূপম’। সেখানে গল্প ছাপতে দিছিলাম।

উনি ডাকযোগে লেখার প্রশংসা করে একটা চিঠি পাঠিয়ে দেখা করতে সময় দিয়েছিলেন। যেদিন দেখা করার কথা সেদিন আমার বিসিএস লিখিত এক্সাম ছিল। আমি সকালে ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম। একটা বইয়ের দোকানের ঠিকানা দিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে এক লোকের কাছে তার নাম বলতেই রেগে গেলেন। বললেন, তাকে ক্যানো খুঁজতেছো?

আমি বললাম, দেখা করতে চাই।
জানতে চাইলেন, তুমি কি তারে চেনো?
আমি বললাম, না।
বললেন, আসো... এই বলে উনি আমাকে চা খাওয়াতে আজিজ মার্কেটের দোতলায় মালেক মামার চা’স্টলে নিয়ে গেলেন। খুব প্রশংসা করলেন আমার পাঠানো গল্পটার। সেটি ছিল আমার লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গল্প। জানতে চাইলেন, কি করি। বললাম, কিছু করছি না। আপাতত বিসিএস দিচ্ছি। আজ পরীক্ষা। উনি খুব বকাঝকা করলেন আমাকে। বললেন, এসব কারণেই লেখালেখি সবাইকে দিয়ে হয় না। পরীক্ষা রেখে আমার কাছে ক্যানো আসছো?

পরে আমার মন খারাপ দেখে বললেন, যাও পরীক্ষা দিয়ে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। বিকেলে আবার এলাম। উনি সবার সাথে আমাকে গল্পকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। পরে বললেন, এ সংখ্যায় তোমার গল্পটা নিতে পারবো না। তুমি বরং আগের সংখ্যাটার সব গল্প পড়ে একটা রিভিউ লিখে দাও। পরের সংখ্যায় তোমার গল্পটা আসবে। এ সংখ্যায় রিভিউটা দেব। পরে সন্ধ্যায় জানালেন বাসায় ফিরবেন। তার শরীর খারাপ লাগছে। রিকশায় তাকে বিদায় জানালাম।

রাত ৯টার দিকে তখনো আমি আজিজে আড্ডা দিচ্ছি। খবর পেলাম, আনওয়ার ভাই মারা গ্যাছেন। এরপর অনেকদিন আমি আর কিছু লিখতে পারি নাই। সেই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। ভাইবাও খুব ভালো হয়েছিল, কিন্তু টিকিনি। পরে সাংবাদিকতা করতে এসে লেখার সময় পেলাম। পত্রিকাতে কাজ করতাম। বেতন ছিল খুব কম। চলতো না। পরে সাহিত্য পাতার সম্পাদক শামসুল ইসলাম ভাই আমার গল্প নিয়ে পড়াশোনা ও আগ্রহ দেখে বললেন, ভালো গল্প লিখতে পারলে টাকা দেব।

লেখা শুরু করলাম আবার। প্রথম গল্পটাই উনি ছাপলেন। বিলও দিলেন হ্যান্ডসাম। আরো চাইলেন। এরই মধ্যে একাধিক ছোটকাগজ আমার গল্প ছাপতে শুরু করলো। সে সময় যাদের সাথে আমি লিখতাম তাদের বই প্রকাশ হতে শুরু হলো। আমি বই বের করার কথা তখনো ভাবিনি। লেখার পর যে শান্তিটা মনে পেতাম, আমার কাছে সেটাই ছিল আসল। লেখা হয়ে যাবার পর কয়েকবার পড়া শেষে মনে হতো, কিছুই হয় নাই। তবে ইসলাম ভাই খুব খুশি হতেন গল্প পেয়ে। তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে আমার গল্প ছেপে বিল করে দিতেন।

তখন যেসব বন্ধু বই বের করেছিলেন তাদের বইটা আমি সেই টাকায় কিনতাম। ভালোই লাগতো। তবে সেসব বন্ধুর যে বেদনার জায়গাটা দেখেছিলাম তা মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। খুব ভালো গল্প হবার পরও বই বিক্রি হইতো না। তিনশো কপি বিক্রি না হলে প্রকাশক খুব বিরক্ত হতেন। তাই সেসব লেখকেরা নিজে কাউকে উপহার দিয়ে, কখনোবা নিজে কিনে নিয়ে প্রকাশকের মান রাখতেন। কী বঞ্চনা! নিজের লেখা অবশেষে নিজেকেই কিনতে হচ্ছে! পাঠকের জন্য লিখে পাঠক না পেয়ে প্রকাশকের কাছে ছোট হতে হচ্ছে।

মন খারাপ নিয়ে বইমেলায় আসা বন্ধুদের কাছে গিয়ে বলে বলে বই বিক্রি করতে হচ্ছে। কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে, বই কেমন চলছে? তখন মিথ্যা বলতে হচ্ছে বন্ধুদের। আহা, লেখার কত গ্লানি! পরে কিছু বন্ধুদের কাছে জানলাম তাদের বই ছেপে প্রকাশকরা আর ঝুঁকি নিতে চান না। যদি কেউ কনফার্ম করতে পারে অ্যাটলিস্ট তিনশো কপি বিক্রি হবে, তবেই প্রকাশ করবেন। আহা, পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকরা কত নতুন লেখকরে যে ঘুরান! বইমেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও বই বাজারে আসে না। অথচ আসার কথা এ মেলাতেই। বিষণ্ণ হয়ে অবশেষে তারা ঘুরে বেড়ায় বইমেলায়। লিটলম্যাগ চত্বরে গিয়ে দাঁড়ায়া থাকে।

প্রকাশকরে ধর্ণা দিতে গেলে প্রকাশক গড়িমসি করে। লস খাবে আশঙ্কা জানায়। লেখককে বাধ্য করে মৌখিক চুক্তিতে আসতে যে, বইটির বিক্রির দায়িত্ব লেখক যেন নিজেই নেয়। কোনো কোনো তরুণ লেখকের কাছ থেকে অগ্রিম তিনশো কপির টাকাও নিয়ে রাখে প্রকাশক। লাভ দিয়েই প্রকাশকের যাত্রা শুরু হয়। গেল একযুগে আজিজ মার্কেটের বহুত টাউটকে এ ব্যবসায় নামতে দেখছি। বহুত ভালো লেখককে লেখা ছেড়ে দিতেও দেখেছি। এবার বইমেলায় গিয়ে দেখলাম, সেসময়ের এক বন্ধু মেলায় আসছে। জানতে চাইলাম, বই বেরিয়েছে নাকি? বললো, তার নিজের স্টলে ঘুরে যেতে। সে এখন প্রকাশক হয়ে গেছে।

আমি ভাবতাম লিখতে পারা আমার একটা গুণ। সবার এ গুণ থাকে না। মানুষের জন্য লিখবো একদিন ভালো কিছু। এসব বইমেলা কেন্দ্রিক টাউট প্রকাশক, যারা বইমেলার বাইরে নিজেদের প্রকশনাটি নিয়ে যাবার কোনোই ক্ষমতা রাখে না, যাদের কোনো সম্পাদনা পর্ষদই নাই, সেসব টাউটের কাছে আমার লেখার মান যাচাইয়ের ভার দেব আমি? বুঝতে হবে, এদেশে কাশেম বিন আবু বকরের বই সবচেয়ে বেশি কেন বিক্রি হয়। এসব টাউট প্রকাশকরা এতই টাউট যে, তাদের সারাবছর বই বিক্রি করতে হয় না। বই বের করলেই লাভ। প্রতিবছর মেলাতে যে পরিমাণ বই বের হয়, সেই গুগোবর পড়ে দেখার সময় প্রকাশকের নাই।

ভালো-মন্দ দিয়েতো আর বিজনেস হয় না। বই প্রকাশেই লাভ। অথচ তরুণদের অনেকেই কিন্তু ভালো লিখছে। প্লিজ, বই বের করার কথা আমাকে বলবেন না। ঠ্যাকায় পড়ছিনি? সাহিত্যের দায় অন্য যে নিতে চায়, নিক। আমার সাহিত্য করার দায় নাই। মনকে শান্তি দিতে চাই। লিখে মনকে ফ্রি করতে চাই। বই বের করতে চাই না। আমি আমার ঘরের সব বই বের করে ফেলছি অনেক আগেই। তেলাপোকা আর ইঁদুরের বংশ বিস্তার হয়।

যারা বইমেলায় এসে আমাকে সাংবাদিক হিসেবে বই উপহার দেন, তারা জানেন না, আমি তাদের বইটি রাইজারের ওপর ফেলে রেখে চলে আসি। এক পাতাও পড়ি না। সাহিত্যের বই বের করার চেয়ে এসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, রাজনৈতিক তেল মারা টাউট লেখক শ্রেণিটি তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য। কারণ তাদের এটলিস্ট উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী