ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদের গদ্য ‘চিন্তার স্বাধীনতা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১২, ২০১৯

সবাই খালি চিন্তার স্বাধীনতা চায়। যার দিনমান হাগু হয় না, সারা দিন তা নিয়েই চিন্তা করে— কখন হবে, কেন হয় না, কী করলে হবে— সেও চিন্তার স্বাধীনতা চায়। যে চিন্তাই করতে জানে না, সে-ও চিন্তার স্বাধীনতা চায়। কী তাজ্জব!

আর যে চিন্তা-ভাবনা করতে জানে, সেই ‘হরিদাস পালে’র কত ভাব, দেখুন না? কবি জ্যোতির্ময় নন্দী তাকে দেখেই বলেছেন, ‘যেন সারা দীন-দুনিয়ার যাবতীয় দায়ভার তারই বৃষস্কন্ধে কেউ চাপিয়ে দিয়েছে; যেন সে পটল তুললে দুনিয়া এতিম হয়ে যাবে।’ যেন দার্শনিক ভলতেরের চেয়েও তিনি বড় কিছু। যেন ‘অন্যের মতামতের সাথে একমত না হলেও সেই মতামত রক্ষায় জীবন তো দেবেনই’, পারলে জিহাদও ঘোষণা করবেন। আফসোস! ভলতেরের বান্ধবী ইভলিন বিয়াত্রিস হলের মতো কেউ তার জীবনীটা লিখবেন না।

চিন্তা না করার স্বাধীনতা কবে চাইবে মানুষ? চিন্তা না থাকা মানে মৃত্যু। যে মরে নাই, তার চিন্তারও বিরাম নাই। বেঁচে থাকলে পাগলেরও চিন্তা থেকে মুক্তি নাই। মাথায় তারও অবিরাম চিন্তা খেলা করে। এই খেলা কত আর ভালো লাগে?

একজন দার্শনিকের কথা মনে পড়ছে। রেনে দেকার্ত। ‘কোগিটো এরগো সাম।’ ‘আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই অ্যাম।’ ‘চিন্তা করি বলেই আমি আছি।’ চিন্তা নাই, মানে অস্তিত্বই নাই।

এই যে চিন্তার বাইরে যেতে না পারা, এটাও তো একটা পরাধীনতাই। কী একখান সভ্যতা, সে আপনাকে চিন্তাহীন জীবনের কথা ভাবতেই দেবে না। এ কেমন কারাগার! চিন্তার কারাগার। মানবসভ্যতা, মানবজীবন ও মানব-মস্তিষ্ক যেন চিন্তাকে অনিবার্য করে তুলেছে। আপনি চিন্তা করতে পারেন না কিংবা পারলেও আপনি কোনো চিন্তাই করবেন না— এই রকম একটা অবস্থার কথা ভাবতেই কিন্তু আপনি ভয় পেয়ে যান। আমিও। সমাজ ও সভ্যতায় ঊনচিন্তার মানুষ মানবেতর হিসেবে গণ্য; বলদ, ভোদাই, হেয়, নীচ এবং অন্যের ব্যবহার্য হিসেবে গণ্য। জানি, চিন্তামুক্ত হওয়ার কথা যখন ভাবছি, তখনই ধুরন্ধর কোনো চিন্তাবাজ হয়ত আমাকে-আপনাকে দাস বা যন্ত্র কিংবা পশুর মতো ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখে জিবের পানিতে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।

ভারতীয় সন্যাসী— সব ছেড়েছুড়ে পরবর্তী জীবনে দার্শনিক— উপ্পালুরি জাদুরাপ্পা কৃষ্ণমূর্তি এই চিন্তাময় জীবন পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। চিন্তা দিয়েই ভাঙতে চেয়েছিলেন চিন্তার বেড়াজাল। পারেননি শেষতক, কিন্তু হাল ছাড়েননি শেষতক।

এই যে, আমাদের ঋত্বিকদা (ঋত্বিক ঘটক) কইলেন, ‘ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ ভাববে ভাবতে, ভাবা প্র্যাকটিস করতে করতে উপ্পালুরির মতো হঠাৎ যদি ভাবনায় এসে যায়— ভাবব না আর, ভাবনার দেয়াল ভেঙে ভাবাভাবির গোষ্ঠি কিলিয়ে বেরিয়ে যাব। তখন?

চিন্তা না থাকার স্বাধীনতার প্রশ্নে কিন্তু সুচিন্তা, দুশ্চিন্তা আর কুচিন্তা— সব বোধহয় সমান, সব একাকার। চিন্তা না থাকার আরাম কবে পাব? কবে? কবে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী