ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদের গদ্য ‘দুই বন্ধু’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০১৯

দুই বন্ধু আপেল খাচ্ছিল। একজন নাখোসা, আরেকজন আখোসা। একজন খোসা ছাড়িয়ে খায়। আরেকজন খোসাসহই খায়। যে খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে তার হাতে চাকু। খোসা ছাড়াতে সময় লাগছে। এই ফাঁকে আখোসা একটু বেশি খাচ্ছে। নাখোসা ভাবল, খোসাখেকো শালাকে একটু থামানো দরকার।

দুই বন্ধুর কাছেই রাজনীতি, নারী আর কেলেঙ্কারি আলোচনার বিষয় হিসেবে সবচেয়ে পছন্দের। তো নাখোসা বন্ধু আখোসাকে বলল, দোস্ত, ‘রাজনীতি’ পচে গেছে। এই শব্দ আর উচ্চারণের যোগ্য নয়। আমরা ভাবছি, এই শব্দ আমরা বদলে দেব। শব্দটি তো ভুল। ‘রাজনীতি’ মানে তো ‘রাজার নীতি’ কিংবা ‘নীতির রাজা’। কিন্তু এর কোনোটাই তো এই শব্দে আর নাই। রাজা তো নেইই, নীতিও নেই। তাহলে কী করব? এখন জনতার যুগ। আমরা ‘জননীতি’ লিখব, ‘জননীতি’ বলব।

চল দোস্ত, বাঘকে আমরা ‘মামা’ বলব, কিংবা ‘হালুম’ বলব। তাহলে নিশ্চয় বাঘ কামড়াবে না।
আরে না ব্যাটা, তা কী হয়।
তাহলে আমরা ‘রাজনীতি’কে ‘কুত্তানীতি’ বা ‘কুনীতি’ বলব। যেহেতু ‘রাজনীতি’ খারাপ হয়ে গেছে। কিংবা ‘নষ্টনীতি’?
কী সব ফাজলামি শুরু করেছিস? একটা সিরিয়াস কথা কইলাম। তুই ব্যাটা একটু সিরিয়াস কিছু বল।
‘রাজনীতি’ শব্দের মানে ‘জননীতি’ হলে কী ‘রাজনীতি’র কোনো হেরফের হবে?
হবে না মানে। অবশ্যই হবে। চাকুকে যদি আপেল বলি, আর আপেলকে চাকু, তাহলে কী চাকুর স্বাদ আপেলের মতো হবে ব্যাটা? নাকি আপেলের স্বাদ চাকুর মতো হবে? আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে চাকুকে আপেল বলছি। এবার অন্তত আপেলকে আপেল বলা শুরু করি।

রাজনীতিকে ‘জননীতি’, ‘রাষ্ট্রনীতি’ বললে রাজনীতির কিছু হেরফের হবে হয়তো, কিন্তু তা খুবই সামান্য এবং ধীরগতির। শব্দটির অর্থ বদলে দিতে পারলে বরং কাজ হতে পারে, এমনকি দুনিয়াও বদলে যেতে পারে। কিন্তু একই অর্থে নতুন শব্দ গ্রহণ করে কোনো ফল হবে না। অ্যারিস্টটল ‘পলিটিক্স’ শব্দটির অর্থ বদলে দিয়েছিলেন। তারপর আমরা দেখলাম, এই শব্দের অর্থের ক্রমাগত সম্প্রসারণ দুনিয়া বদলে ভূমিকা রাখল।
দোস্ত, তুই থামবি। বহুত জ্ঞান দিছিস। আর ভালো লাগছে না।
আক্ষরিক বিবেচনায় ‘রাজনীতি’ মানে কিন্তু ‘রাজার নীতি’ই। বাংলাভাষার নিয়মে, সম্ভবত, ‘নীতির রাজা’ সংক্ষেপে ‘নীতিরাজ’ হতে পারে, কিন্তু ‘রাজনীতি’ হয় না। আমরা রাজাদের সময়ের নীতিকেও এখন ‘রাজনীতি’ বলি, এখনকার দুনিয়ার ‘রাষ্ট্রনীতি’কেও ‘রাজনীতি’ বলি, আবার ‘অফিস পলিটিক্স’কেও ‘রাজনীতি’ই বলি। এই সব বিবেচনায় ‘রাজনীতি’ মানে কিন্তু ‘রাজার নীতি’ ‘প্রজার নীতি’ ‘নীতির রাজা’— সবই বোঝায়। ‘জননীতি’, ‘গণনীতি’, ‘রাষ্ট্রনীতি’— সবই ‘রাজনীতি’। এইভাবে এই শব্দের অর্থ সম্প্রসারণ কিংবা অর্থ বদল ঘটতে থাকুক। দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ঘটতে থাকুক। তা যত তাড়াতাড়ি ঘটবে ‘রাজনীতি’কে ‘জননীতি’ বলার যে উদ্দেশ্য তা তত তাড়াতাড়ি সফল হবে।
নাখোসা এবার আখোসাকে বলল, দোস্ত, এবার থাম। এই একটা টুকরাই আছে। নে, আপেল খা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী