ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘আমার প্রথম কর্মস্থল’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০

এক.
৮৮ সালের কথা। এমএ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন চাকরি দরকার। দরকার মানে ভীষণভাবে দরকার। এতদিন একটা ঠিকানা ছিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবেরুনী হলের ২০৬ নম্বর রুম। খেয়ে না-খেয়ে সারাদিন হৈহৈ রৈরৈ করে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বিশ্রামের জন্য নিশ্চিন্ত আশ্রয়। কিন্তু সেই আশ্রয়টা এখন আর নেই। একজন টোকাই, মুটে, মজুর— তাদেরও একটা আশ্রয় থাকে। সেই অনিশ্চিত আশ্রয়টুকু তারা তাদের জীবনযাপনের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। কিন্তু আমার এরকম একটু আশ্রয়ও নেই। কারণ ওদের ওই জীবনের সঙ্গে জীবন কাটানোর সুযোগ আমার হয়নি। ফলে শতভাগ উদ্বাস্তু যাকে বলে আমি তাই হয়ে পড়লাম। এমনকি ১৯৮৮ সালে আমার পৈত্রিক জমিজমা, ভিটেমাটি মেঘনায় তলিয়ে গেছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এখন এক শতাংশ জমিও আমাদের নেই। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন এক আত্মীয়ের পোড়াবাড়িতে থাকে। সেখানেও আমার জন্য নিশ্চিন্ত কোনো আশ্রয় ছিলনা। সুতরাং একান্ত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই একটি চাকরি আমার চাই-ই।

বিজ্ঞাপন দেখে কাকরাইলে এলিকো-র অফিসে গেলাম চাকরির জন্য। প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হলো। তার ভাবসাব দেখে মনে হলো, আহারে, এমন একটি চাকরি যদি পেতাম, মানবজীবন সার্থক হয়ে যেত। কিন্তু নোয়াখালির এক্সেন্টে তিনি যা শোনালেন তার মর্মার্থ হলো, এটা কোনো চাকরি না। আপনাকে আমরা বেতন দেব না। এই অফিসে আপনার বসার জন্য কোনো চেয়ার-টেবিলও থাকবে না। আপনি ইনসিওরেন্স করাবেন। তার উপর কমিশন পাবেন। যত বেশি মানুষকে আপনি ইনসিওরেন্স করাতে পারবেন, কমিশনও তত বেশি পাবেন।

আমি বললাম, কাদের কাছে আমাকে যেতে হবে? আমি তো কাউকে চিনি না।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনি কাদের কাছে যাবেন সেটা আমি কী করে বলব। আপনি আপনার আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাবেন। পরিচিত লোকজনদের কাছে যাবেন। আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে যাবেন। পরিচিতদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে যাব।

ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনে আমার ভিমরি খাওয়ার দশা। তাকে সালাম দিয়ে সেই যে আমি আসলাম আর কখনো ইনসিওরেন্সমুখি হইনি। কারণ আমি জানি, আমার দ্বারা আর যাই হোক না কেন, ইনসিওরেন্সে চাকরি করা সম্ভব নয়। তবে এখন জরুরি হলো থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা। সেই ব্যবস্থা যেনতেন রকম হলেও চলে।

দুই.
এর মধ্যে ইত্তেফাকের বিজ্ঞাপন কলামে খুব ছোট করে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। টঙ্গীর শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ে একজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। যথাসময়ে গিয়ে দেখি, টঙ্গী বাজার পার হয়ে হাতের বাঁ দিকে টঙ্গী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ওখানে আয়োজন করা হয়েছে লিখিত পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার এবং মৌখিক ক্লাস পরীক্ষার। আমি রীতিমত অবাক। কোন অক্সফোর্ড ক্যামরিজ এমআইটিরে বাবা, এত আয়োজন! কিন্তু পরে দেখলাম ক্যান্ডিডেটদের সংখ্যা চল্লিশের উপরে। তাই এই আয়োজন। এবং শেষপর্যন্ত ওই স্কুলে চাকরি হলো। টঙ্গী বিসিক স্ট্রিটের ভেতরে এই স্কুল। নাম শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রহমান স্যার। অতি সহজ-সরল ভালো মানুষ। স্কুলের সভাপতি হাসান উদ্দিন সরকার বলে দিয়েছেন, আমার চাকরি এমপিওভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে যেন স্কুল থেকে মাসে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু মাস শেষ হতে তো এখনো এক মাস লাগবে। এই এক মাস আমি কী করে চলব।

টঙ্গী বাজারের পরে স্টেশনরোড। বাস থেকে এখানে নেমে হেঁটে বা রিকশায় রেল ক্রসিং পার হয়ে কিছুটা ভিতরে স্বল্প জায়গার মধ্যে স্কুলটি। সাথে সরকারি প্রাইমারি স্কুল। শিল্প ও শ্রমিক অধ্যুষিত এই অঞ্চলে আর কোনো স্কুল নেই। শিল্পকারখানার বিচিত্র শব্দ ও বিভিন্ন জায়গায় থেকে থেকে এবং থেমে থেমে ধুয়া নির্গত হওয়া এই অঞ্চলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মালবাহী ট্রাক ও কভার ভ্যান ছাড়া গণপরিবহণ এখানে তেমন নেই। রিকশা, ঢেলা গাড়ি, স্কুটারের বাইরে মাঝেমধ্যে মালিকদের দামি গাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। কখনো কখনো এই সব গাড়ি থেকে এই অঞ্চলের জন্য খুবই বেমানান নারী-পুরুষদের বিপুল অহঙ্কার আর বিচিত্র ভাব নিয়ে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। গাড়ি থেকে বাইরে যখন তারা পা রাখেন তার যে শিল্প ও সতর্কতা এবং চারদিকের মনুষ্যেতর মানুষগুলো কীভাবে তাদের দেখছে এই সংক্রান্ত সচেতনতা আমি মাঝেমধ্যে উপভোগ করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জীবন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতি করেছি, সংগ্রাম করেছি। এখানে এসে খুব কাছে থেকে দেখলাম, আমাদের এই রাজনীতি ও সংগ্রামের সুদূরবর্তী কোনো ইঙ্গিতও এদের কাছে পৌঁছেনি। মালিকদের বিরুদ্ধে এদের ক্ষোভ আছে তা একান্তই বাহ্যত। অধিকন্তু শত শত বছর ধরে এদের দেহে মনে মননে অস্তিত্বে দাস্যবৃত্তির যে সংস্কৃতি স্থায়ী হয়ে আছে তার মধ্যেই এরা স্বস্তি পায়, সুখে থাকে। মালিক পক্ষের ওইসব নর-নারীদের দেখলে শ্রমিকদের এই দাস্যবৃত্তি প্রদর্শন বহুবার দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।

শিল্প ও শ্রমিক অধ্যুষিত এই অঞ্চলে আর একটি বিষয় দেখার সুযোগ আমার হয়েছে, তা হলো ফাঁকি ও আদায়ের প্রতিযোগিতা। স্থানে স্থানে এখনে আছে চায়ের দোকান, পান-সিগারেটের দোকান, খাবারের দোকান। কিছুটা পুবদিকে গেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি বাজার। শ্রমজীবী মানুষেরা এইসব দোকানে ও বাজারে কেনাকাটা করে এবং সর্বদাই দুটাকা পাঁচ টাকা দশ টাকা কী করে ফাঁকি দেওয়া যায় তার চেষ্টায় থাকে। শতভাগ মানুষ তা করে সেটা বলা যাবে না। তবে করে এবং তার সংখ্যাটাই বেশি। এদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বালাই তেমন নেই। সাফল্যের সঙ্গে ঠকাতে পারলে গর্ববোধ করে এবং নিজেদের মধ্যে এই সাফল্যের বয়ান দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। শ্রমজীবী এইসব দরিদ্র মানুষের সঙ্গে ব্যবসার তাৎপর্যও বোঝে দোকানিরা। কী করে এদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে হয় এবং দশ টাকার স্থলে বারো টাকা এবং ফাঁকির টাকার ডবল হিসাবের ফাঁকিতে উসুল করতে হয় তার ব্যাকরণ এদের খুব ভালোভাবে জানা। আর যারা ব্যবসার এই হিসাব জানে না তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়। ওখানেই আমি দেখেছি বাকিবক্কার জটিল সমীকরণ। শ্রমিকেরা বাকিতে নেবে, এটা প্রায় স্বীকৃত। কিন্তু সেই বাকির মধ্যে লভ্যাংশ এবং তার মধ্যে সুদাংশ কীভাবে কড়ায়গণ্ডায় আদায় করতে হয় তার সহজাত হিসেবে দোকানিরা যারপর নেই দক্ষ। শেষপর্যন্ত ঠকানোর সকল কৌশল ব্যর্থ হয় শ্রমিকদের এবং দোকানধারারই দিনদিন ফুলেফেঁপে ওঠে আর শ্রমিকরা রসাতলে যায়।

অধিকাংশ সময় আমাকে চা-নাস্তা খেতে হতো ওইসব জীর্ণ হোটেলে শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা আমাকে শ্রমিকজ্ঞান করত কিংবা নিদেনপক্ষে শ্রমিকদের সুপারভাইজার। কেননা আমার গায়ের রং, উচ্চতা, দেহের পুষ্টি ও লাবণ্য তাদের চেয়ে উত্তম ছিলনা। শুধু কথা বলার ভাষা ও ঢংটা ছিল তাদের মধ্যে বেঢপ। এইটুকুকে পাত্তা দেওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না। কারণ ওইসব হোটেলে আমার তেমন কথা বলতে হতো না। সুতরাং নিজেদের মধ্যে উচ্চকণ্ঠেই তারা কথা বলত এবং সেইসব কথার মধ্যে যৌনতা ছিল মুখ্য। কোনো রকম আড়াল-আবডাল আর লজ্জাশরমের বালাই লক্ষ করিনি তাদের মধ্যে। বিশেষ করে পরস্ত্রী ও পরকন্যাদের বিষয়ে তাদের আলোচনা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যেতাম। এই স্কুলটিতে স্বল্প সময় অবস্থানে শ্রমজীবী মানুষের অন্য এক মনোদৈহিক অধ্যায়ের সঙ্গে আমি পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই। এই শিল্পাঞ্চলে নিরন্তর শব্দময়তার ভেতরে এমন এক নৈঃশব্দ্যের বোধ তৈরি হয়, এর বাইরে তা সম্ভব নয়। এই নৈঃশব্দ্য আমি নিবিড়ভাবে অনুবব করতাম।

তিন.
স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আমি পেয়েছি নিজাম সাহেব, সামাদ সাহেব, মোস্তাক সাহেব, ইদ্রিস সাহেব, আকমল সাহেব ও লতিফ সাহেবকে। আরও কেউ ছিলেন কি না মনে নেই। এদের সবাইকে আমি ভাই বলতাম। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তারা আমাকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইদ্রিস ভাইয়ের কথা আমি কখনোই ভুলব না। বেশ লম্বাচূড়া মোটাসোটা এই মানুষটি মনের দিক থেকেও ওই রকম বিশাল ছিলেন। মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকত মিষ্টি হাসি। একটি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক এত ভালো মানুষ হতে পারেন, নিজেদের মধ্যে এতটা ঐক্য ও সহনশীলতা থাকতে পারে তা অবিশ্বাস্য।

স্কুলটিতে পড়াশুনার সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল। কোনো শিক্ষককে আমি কখনোই দেরি করে স্কুলে আসতে দেখিনি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর সংস্কৃতিও তখন তৈরি হয়নি। শিক্ষকগণ নিজ নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করতেন। এদের মধ্যে আমিই ছিলাম নতুন। শিক্ষকতার কোনো অভিজ্ঞতা না থাকাতে শিখন-শেখানো কর্মকাণ্ড যে একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়, আমি তখনো তা বুঝে উঠতে পারিনি। এর মধ্যে আমাকে দেওয়া হয়েছিল নবম-দশম শ্রেণিতে ইংরেজি পড়ানোর দায়িত্ব। ইংরেজি যারা পড়ান শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার আলাদা গুরুত্ব থাকে। আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়ার ফলে আমি বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করা আমি সহসাই বুঝতে পারলাম যে ইংরেজি সব ভুলে বসে আছি। খুব কষ্ট করে, অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে গেলেও মনের মতো করে পড়ানো আমার দ্বারা সম্ভব হচ্ছিলনা। স্কুলটিতে খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলনা। কিন্তু কোন শিক্ষক ভালো পড়ান এবং কোন শিক্ষক পড়াতে পারেন না, এই বিষয়টি বুঝতে কারোই কোনো অসুবিধা হতো না। এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আমি যখন কিছুটা দক্ষ হয়ে উঠেছি তখনই আমার এখানকার পাঠ শেষ হয়।

স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু তাদের বিনয় ও আন্তরিকতা মুগ্ধ হওয়ার মতো। তারা আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা এই যুবককে তারা তাদের ভাবনা ও আবেগের আত্মীয় বলে জ্ঞান করত কি না জানি না। তবে শিক্ষকতার সেই সূচনালগ্নে আমি অনুভব করেছিলাম যে, কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীদের অপমান করা যাবে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রশংসা করার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে প্রশংসা করতে হবে। আদর ও স্নেহের ভাষায় কথা বলতে হবে এবং বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করে শাসন করতে হবে। আমার পড়ানোর এই রীতি শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করেছিল। ফলে ইংরেজি ভালো পড়াতে না পাড়লেও পাড় পেয়ে গিয়েছিলাম।

চার.
স্কুলে গিয়েই আমার ভাব হয়ে গেল সালাম সহেবের সঙ্গে। উনি এখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সুবিধা বুঝে আমি তাকে তিনটি সমস্যার কথা বললাম। এক. টাকার সংস্থান কী দুই. থাকব কোথায় এবং তিন. খাবারে কী ব্যবস্থা? সালাম সাহেব সাধ্যমতো চেষ্টা করে থাকার ব্যবস্থা করলেন স্কুলের কাছেই একটি টিনের ঘরে। কিন্তু প্রায় পরিত্যক্ত ওই ঘরটিতে খাট-চকি কিছু ছিল কি নি এখন আর মনে নেই। সালাম সাহেব সাধ্যমতো চেষ্টা করে যে আয়োজন করলেন তা কহতব্য নয়। আর টাকার বিনিময়ে একটি পরিবার থেকে খাবার আসত যার মান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হলো, ওই আজব ঘরটিতে রাতে গিয়ে চোরের মতো ঘুমিয়ে থাকা যায়, সারাদিন বা দিনের বেলা থাকা যায় না। সুতরাং স্কুলশেষে আমি কী করব। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই দপ্তরি পিওন— এদের সঙ্গে খাতির করে স্কুলে যতটা সময় থাকা যায় থাকতাম আর ওই ঘরের কথা গোপন রেখে সালাম সহেবকে পটিয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতাম। তিনিও আগ্রহী ছিলেন। কেননা তার তখন বৃহস্পতি চলছিল। তিনি প্রতিদিন তার প্রেমের আখ্যান আমাকে শোনাতেন আর আমি গভীর মমত্ব আর মনোযোগ দিয়ে তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা শুনতাম।

কিন্তু কাহাতক? সপ্তাহ দুই এভাবে কাটানোর পর মনে হলো, নাহ্, সম্ভব নয়। সালাম সাহেবই একদিন বললেন, ‘মান্নান ভাই, আপনার জন্য লজিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। থাকবেন?’ আমি বললাম, ‘আরে বলনকি? আমার স্কুলজীবন আর কলেজজীবন পুরোটাই কেটেছে লজিং থেকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও এক মাস ‘অন টেস্ট’ লজিং থেকেছি। বলেন কোথায়? তবে একটা শর্ত আছে, লজিংএ কোনো যুবতী থাকলে হবে না।’ সালাম ভাই বললেন, ‘কোনো যুবতী নেই। আপনার দুই ছাত্রী আর এক ছাত্র আছে ওই পরিবারে। বড় ছাত্রীটি এইটে পড়ে। তবে ছাত্রীর মা কিংবা অন্য আত্মীয়াদের যদি যুবতীজ্ঞান করেন তা হলে কিছু বলার নেই।’ ছাত্রীদের প্রণয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে যুবতীজ্ঞান করা নিশ্চয়ই নৈতিক নয়। কিন্তু এই নৈতিকতার বোধ তৈরি হওয়ার জন্য যতটা শিক্ষক হয়ে ওঠা দরকার আমি তখনো তা হইনি। আর এই জৈব-মানবীয় ক্ষেত্রে নৈতিকতার বোধ অনেক সময় কাজ করে না বলে আমার ধারণা। প্রায় তিরিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, আমার এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। সালাম ভাইকে বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি থাকব।’

স্কুল চলাকালে এইটের মেয়েটি আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। ওর নাম পারুল। ফর্সা, ফ্যাকাশে। স্কুলের সদা ইউনিফর্মটা ওর ওই ফ্যাকাশে রংটাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। আর এই বয়সে যে তারুণ্য থাকার কথা দেহে ও মনে, সেই তারুণ্য নেই। একান্তই নিরীহ লাজুক বিনম্র। দেখে আমার খুব মায়া হলো। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই শিশু। কিন্তু এই বয়সেই বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে যৌবনের যে কোলাহল তৈরি হয়, পারুলের মধ্যে তার সলজ্জ ইঙ্গিতমাত্র আছে। এর বেশি কিছু নয়। সুতরাং যুবতী বিষয়ক ঝুটঝামেলা সংক্রান্ত আখ্যান রচিত হওয়ার আশঙ্কা আপাতত নেই বলেই মনে হলো। এর বাইরে পারিবারিক গণ্ডিতে আর কোনো উপাখ্যান রচিত হওয়ার উপকরণ আছে কি না তা জানা নেই।

পাঁচ.
পরদিন ওই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ইটের দেয়ালে ঘেরা এক চালা টিনের ঘর। রাস্তার পাশে চার-পাঁচ শতক জমি কিনে এই বাড়িটি করেছেন গৃহকর্তা। এতেই তিনি সর্বস্ব উজার করেছেন বলে মনে হলো। এখন দারিদ্র্য সর্বত্র। স্বপ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে নিম্নবিত্ত মানুষের যে বেঁচে থাকা— এই পরিবারটি তার বাইরে নয়। এই দারিদ্র্যের মধ্যে আমাকে আশ্রয় দেওয়া সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই এক রূপ— ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে, বড় কোনো চাকরিবাকরির জন্য তৈরি করতে হবে। পারুলরা এই পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের স্কুলগামী সদস্য। ওদের বাবা প্রথম স্কুলে গিয়ে সামান্য পড়াশুনা করেছেন। সেই বদৌলতে এখন একটি ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। যে চাকরিটা তিনি করেন তার জন্য ডিগ্রির দরকার হয়না। স্কুলের কোনো একটি ক্লাসের সার্টিফিকেট জোগাড় থাকলেই হলো। এখন যেমন ফাইবে এবং এইটে পাবলিক পরীক্ষার মতো একটি পরীক্ষা হয়, সে সময় তা ছিল না। এসএসসির নিচে সব ক্লাসের সার্টিফিকেট দিতেন প্রধান শিক্ষকগণ। গৃহকর্তা সে রকম সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি নিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। তবে তিনি আপাদমস্তক ভদ্রলোক এবং চুপচাপ লাজুক ও সজ্জন মানুষ। সারাক্ষণ সংসার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। আমার সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা হতো না। কখনো কখনো মুখোমুখি হয়ে গেলে কুশল বিনিময় পর্যন্তই কথা হতো।

এখানেও আমার জীবন প্রীতিকর হয়নি। পারুলদের এই ছোট বাড়িতে আরও দুইঘর ছিল। টিনের চালায় ভাড়াটে। অনেক মানুষের এই বাড়িটিতে টয়লেট ছিল একটি। ফলে প্রয়োজনের সময় বলতে গেলে কখনোই খালি পাওয়া যেতো না। কিছু শারীরবৃত্তীয় কাজ বিলম্ব সয়। যেমন বিশ্রাম, ক্ষুধা, যৌনকর্ম ইত্যাদি। কিন্তু কখনো কখনো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া এতই জরুরি হয়ে পড়ে যে বিলম্ব ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতা সম্ভবত সবারই আছে। কেন যেন ওখানে এমন অভিজ্ঞতা আমার বেশি হয়েছে। হয়তো অপ্রতুলতার অনুভব মানুষের প্রয়োজন বাড়িয়ে দেয় বলেও হতে পারে। বাইরে মহিলারা নিশ্চিন্তে তাদের মতো থাকছে। কারো দিকেই তাদের পরোয়া নেই। গায়ের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে তাদের তেমন সংকোচ নেই। আমার মতো এই কালো আর খাট এবং কুজো হয়ে হাঁটা প্রাণীটিকে তারা কিছুমাত্র পরোয়া করছে না। আর তাদের পরোয়া করতে করতে আমার অবস্থা শোচনীয়। ছাগল ও কুকুরের আবাসের মতো খুপরিটিতে সংকোচে, দ্বিধায়, লজ্জায় আমি যারপর নেই কোণঠাসা হয়ে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফুরন্ত উদার পরিবেশ থেকে, আলবেরুনী হলের বিপুল আড্ডা আর প্রাণময় বন্ধুসান্নিধ্য থেকে আকস্মিক এই পতন আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে রেখেছিল। ফলে অপরিচিত পারিবারিক জীবনের সব কিছুকেই আমার কাছে অপরিচ্ছন্ন, দীন-হীন ও ক্ষুদ্র বলে ঠাওর হতো। জলের মাছ ডাঙ্গায় ওঠে এলে যে অবস্থা হয় আমার অবস্থা ঠিক তেমন হয়ে ওঠে। তবে গোসল করার জায়গাটা ছিল খুবই সুন্দর। তুরাগ নদীর পাড়ে। সেই সময় তুরাগের জল এত স্বচ্ছতোয়া ছিল যে এখন কেউ ভাবতেই পারবে না। স্নানের ওই সময়টা আমার জন্য ছিল আনন্দের। শৈশবে জলের সঙ্গে যে জীবন কাটিয়ে ছিলাম, তুরাগের তীরে এলে আমার সেই জীবন নানা রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠত। ঘাটে একটু নির্জনতা পেলেই আমি দুর্দান্ত হয়ে উঠি। স্নানার্থী অন্য কেউ না এলে জলের সঙ্গে আমার অফুরন্ত শৈশবে ফিরে যাই। দুঃসহ সংকীর্ণতার মধ্যে প্রবেশ করার আগে যতটা পারি নিজেকে ছড়িয়ে নিই এখানে। পারুলদের মা কোন জাতের মানুষ, আমি কখনোই সেটা বুঝতে পারিনি। ওদের যখন পড়াতাম তখন এই মহিলা সারাক্ষণ খেয়াল রাখতেন। আড়াল-আবডাল থেকে সন্দেহের মন নিয়ে তক্কে তক্কে থাকতেন। আমার খুব অস্বস্তি হতো। তিন মাসের কিছু বেশি সময় ওই বাড়িতে আমি ছিলাম। অবাক কাণ্ড হলো, এই সময়ে তিনি কখনোই বসে আমার সঙ্গে কথা বলেননি, আমার কুশলাদি ও পয়-পরিচয় জানতে চাননি। যে সারল্য ও মুখরতা কিংবা সারল্য ও মৃদুভাষিতা মানুষকে মধুর করে তোলে তার কিছুই ওই মহিলার মধ্যে ছিল না। একটি শিশু কন্যাকে নিয়ে তিনি
কেন এত শঙ্কিত ছিলেন তার রহস্য আমার জানা হয়েছে অনেক পরে। যে কটা দিন ওই বাড়িতে আমি ছিলাম, সে কটা দিন বাইরের মানুষ হিসেবেই ছিলাম, আশ্রিতের অমর্যাদা নিয়ে ছিলাম। একসময় বুঝতে পারলাম ওদের একজন মামাতো ভাই মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে আসে। পারুলকে নিয়ে তার আগ্রহ ছিল। এই বাড়িতে আমার সর্বক্ষণের উপস্থিতি তার জন্য সুখকর ছিল না। খুব ধার্মিক এই মামাতো ভাইটি ধর্মকর্ম নিয়ে আমার নিরূৎসাহ কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। ‘মাস্টর নমাজ পড়ে না, এইডা অইল।’ তার এই আদর্শ পরিবারটি, বিশেষ করে ওদের মা খুব সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছিলেন। এর সঙ্গে এই ধারণাও তার হয়েছিল যে, লোকটা নামাজ পড়ে না, ধার্মিক নয়, সুতরাং নৈতিক মানুষও নয়। সে যে কোনো অনৈতিক কাজ করতে পারে। শুরু থেকেই মহিলাকে এভাবে সন্দেহপ্রবণ করে তোলার পিছনে মামাতো ভাইটির ইন্ধন থাকতে পারে। আমার সঙ্গে তার হার্দিক সম্পর্কের অন্তরায়ও সম্ভবত তৈরি করেছিল ওই মামাতো ভাইটি। এই পরিস্থিতি থেকে আমি যখন অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তার কিছু দিনের মধ্যেই কাপাসিয়া ডিগ্রী কলেজে আমার চাকরি হয়। টঙ্গী বিসিক স্ট্রিটের শহীদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ে আমার অধ্যায় শেষ হয়। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক সালাম সাহেবের বদৌলতে স্কুলটির সঙ্গে এখনো আমার সম্পর্ক আছে।

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০