সুশ্রুত এবং ক্যালকাটা হার্ট সেন্টার
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯
আজ সকালে বাসার পাশে সুশ্রুত আর ক্যালকাটা হার্ট সেন্টারে গিয়েছিলাম চিকিৎসার প্রয়োজনে। দুটোই চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রথমটি চোখের, দ্বিতীয়টি হৃদরোগসহ সাধারণ চিকিৎসা কেন্দ্র। দুটো চিকিৎসা কেন্দ্রই ঘটনাচক্রে চিকিৎসা নিতে গিয়ে আমি মুগ্ধ। প্রথমটি সম্পর্কে প্রথম বলা যাক।
বছর দশকে হবে, মাদ্রাজের শঙ্কর নেত্রালয় গিয়েছিলাম একজনকে নিয়ে তার চোখের চিকিৎসার জন্য। শঙ্কর নেত্রালয়ের নামডাক খুব, মুগ্ধ হবার মতো বহু কিছুই হয়তো আছে। কিন্তু সকালে গিয়ে লাইন দেয়া, চারশো টাকা জমা দেয়া, কিছু পরে সেসঙ্গে সামরিক শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে চলা। মন্দ ছিলে না, ভালো লেগেছে। চিকিৎসকরা খুব আন্তরিক। কিন্তু মুগ্ধ হতে পারিনি তেমনটা সব মিলিয়ে। ঠিক তার কিছুদিন পর কলকাতায় আমার বন্ধুর বাসায় রয়েছি। মূলত বেড়াতে যাওয়া। হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠার পর একদিন সকালে চোখে সামান্য ব্যথা। সকালে চা খাচ্ছি, শ্রীলেখা হঠাৎ বললো, চোখ নিয়ে এমন করছো কেন, কী হয়েছে? বললাম, তেমন কিছু না, সকাল থেকে সামান্য ব্যথা। চিকিৎসক বন্ধু ধূর্জটি চোখের চিকিৎসক নয়। শ্রীলেখা বললো, নাস্তা খেয়ে নাও, তোমাকে চোখের ডাক্তার দেখিয়ে দিচ্ছি। বললাম দরকার নেই, সমস্যা তেমন হলে ঢাকায় দেখাবো। ধূর্জটি বললো, মাদ্রাজের শঙ্কর নেত্রালয় ঘুরে এসেছো, শ্রীলেখা যেখানে নিয়ে যেতে চায় ঘুরে দেখে এসো।
নাস্তা খেয়ে শ্রীলেখার সঙ্গে রওয়ানা হলাম। শ্রীলেখাদের বাসা যে রাস্তায়, তার একদিকের শেষপ্রান্তে সুশ্রুত নামের এই চিকিৎসা কেন্দ্র। ধূর্জটি-শ্রীলেখার বাসা থেকে দু’তিন মিনিটের রাস্তা। খুব বড় নয়, দুটা ভবন চিকিৎসা কেন্দ্রের। মনে হয়, একটা সাত আটতলা তলা হবে। ভিন্নটি একতলা। শ্রীলেখা আমায় তিনতলায় নিয়ে গেল। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আমার নাম লেখানো হলো। নাম লেখানোর কিছু পরে আমার ডাক পড়লো। প্রচুর ছেলেমেয়েরা কাজ করছে হাসপাতালে, রোগীও কম নয়। আমাকে একজন চিকিৎসকের কক্ষে নিয়ে বসানো হলো। সেখানে আরও রোগী আছে। চিকিৎসক সবাইকে কাছে ডেকে যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিটা রোগীর চোখ দেখছেন। আমাকে দেখা হলো, পাঠানো হলো আরেকটি কক্ষে। সেখানে আমার চোখের অবস্থা বা পাওয়ার পরীক্ষা করা হলো। সেটা হয়ে গেলে আমাকে আবার বাইরে সব রোগীদের অপেক্ষা করার জায়গায় বসানো হলো। দু’চোখে একটা ড্রপ দেয়া হলো। বলা হলো, কিছু সময় অপেক্ষা করতে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রথম চিকিৎসকের কাছে আবার নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি আবার চোখ পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র দিলেন চোখের জন্য একটা ড্রপ, একমাস ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসা শেষ হলো, আমাকে একটা পরিচয়পত্র দেয়া হলো। বলা হলো, পরে যখন চিকিৎসা নিতে আসব, এটা লাগবে। মনে হয়, ঘণ্টাখানেকের চেয়ে অনেক কম সময়ে আমার চোখের চিকিৎসা হয়ে গেল। বিভিন্ন তলায় তখনো বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন বয়সের বহু রোগী চিকিৎসা নেবার জন্য অপেক্ষা করছে। বহুজন আসছে দূর-দূরান্ত থেকে, কেউ বা নিকটে কোথাও থেকে।
সুশ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে দেখলাম সব রোগীর মর্যাদা সমান। কাউকে আলাদা চোখে দেখা হয় না। সকাল ৮ থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। ধনী-গরিব প্রচুর মানুষ আসে সারাদিন ধরে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য। শঙ্কর নেত্রালয়ের মতো হুলুস্থূল এখানে কম। শঙ্কর নেত্রালয়ে মনে হয় যেন আইনের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়লাম, যদিও সেটা সেখানকার পরিবেশে দরকার। কিন্তু এখানে প্রবেশ-প্রস্থান, চিকিৎসা সেবা সবটাই খুব সাবলীল। কারো আতঙ্কিত হবার, অস্বস্তি বোধ করবার কিছু নেই। সামান্য আমলাতান্ত্রিকতার প্রভাব, দায়িত্বে নিয়োজিতদের সামান্য দৌরাত্ম্য নেই। কখনো রোগীরা শঙ্কিত থাকবে না। বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বে না। যারা কর্মকর্তা কর্মচারী, তারা রোগীদের ভুল ধরাবার জন্য কেউ উচ্চস্বরে কথা বলবে না। রোগীরা কিছু ভুল করলে সেটা খুব মমতার সঙ্গে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সবই হবে নিয়মের মধ্য দিয়ে। কাউকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে না, ক্ষমতাহীন বলে দরিদ্র রোগীরা ক্ষমতাবানদের পিছনে পড়বে না। বিশেষ জরুরি কারণ ছাড়া কাউকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হবে না। দেয়া হলে গরিব বা ধনী দুজনকেই দেয়া হবে।
শঙ্কর নেত্রালয় অবশ্যই প্রশংসা পাবার যোগ্য। শঙ্কর নেত্রালয় সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা কম, মাত্র ছয় ঘণ্টার। মনে আছে, সেবার আমার রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য শঙ্কর নেত্রালয়ে নিয়েছিলে চারশো টাকা, বছর বছর সেটা বাড়ে। সুশ্রুত তার শুরু থেকে পঞ্চাশ টাকা নিচ্ছে এখানো তাই। সাতদিনের মধ্যে আর একবার এলে আর টাকা নেয়া হবে না। তবে এটা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। যদি জটিল কোনো ব্যাপার থাকে, যদি অস্ত্রোপচার থাকে তাহলে আবার তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন খরচ আছে। যেমন ওষুধ কেনা, চশমা বানানোর টাকাটা আলাদা। সেটা শঙ্কর নেত্রালয়েও তাই। সব জায়গাতে তাই। সুশ্রুত চিকিৎসালয়ে আমি দশ বছরে প্রতিবার পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে আসছি। শুধু একবার বারোশো টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়, চোখের একটা ছিদ্র লেজার দিয়ে বন্ধ করার জন্য। বলা হলো, সেখানে মানে সুশ্রুতে না করে বাইরে আমার পছন্দ মতো কোথাও করাতে পারি। আমি সেখানে মানে সুশ্রুতে করালাম। ঢাকায় এসে জানালাম, সেটা করাতে নূন্যতম তিন হাজার টাকা লাগতো বারডেমে।
সুশ্রুতে আমাকে কখনো আগের কাগজপত্র নিয়ে যেতে হয় না। আমার নামে রক্ষিত ফাইলে সব কাগজপত্র প্রয়োজনমতো জমা আছে গত দশবছর ধরে। আমি কলকাতা গেলে প্রয়োজনমতো চোখের চিকিৎসার জন্য সেখানে যাই। যে সামান্য চিকিৎসা আমি সেখানে নিয়ে থাকি তা ঢাকাতেও নিতে পারি। আমার অনেক প্রিয় মানুষরা চোখের চিকিৎসক এবং অধ্যাপক। আমাকে তারা চিকিৎসা দেন খুব আন্তরিকতার সঙ্গে। টাকা পয়সা নেন না, বরং কখনো পারলে চা কফি খাওয়ান। কিন্তু সুশ্রুত আমার মনটাকে জয় করে নিয়েছে। এদের চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগীদের সঙ্গে আচরণ, প্রতিটা কর্মীর ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে রাখে। কর্মীদের সকলের বয়স বেশি নয়, কিন্তু সকলের আচরণ, দায়িত্ববোধ, কর্মতৎপরতা আমাকে মুগ্ধ করে। সবচেয়ে যা মুগ্ধ করে, চিকিৎসক আর কর্মচারী কারো মুখে বিরক্তির ভাব নেই, কেউ রগচটা নয়, কেউ উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলে না। মন দিয়ে রোগীদের সমস্যাটা বুঝতে চান। বহু রোগী দেখেন একজন চিকিৎসক, কম করে পাঁচ ঘণ্টা একনাগাড়ে কিন্তু সামান্য বিরক্তির চিহ্ন নেই কপালে। চিকিৎসক নন, কর্মচারীরাও বিরক্ত নন।
আমি নিশ্চিত, কেউ যদি এরা রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কঠোর ভাষায় কিছু বলে, তার চাকরি থাকবে না। অন্য কোথাও চাকরির জন্য প্রশংসাপত্র পাবে না। প্রত্যেকে তারা দায়িত্ববান কিন্তু সদাচারণে পারদর্শী। সকলের প্রতি সম্মান রয়েছে তাদের, মানুষ হিসেবে সকলকে দেখতে শিখেছেন। বহুকিছু শিখবার আছে এদের কাছ থেকে। মনে মনে স্বপ্ন দেখি, কবে এমন একটা চিকিৎসালয় আমাদের দেশে হবে! এটা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, সেবামূলক একটা ট্রাস্ট। একজন মানুষ তার স্বপ্ন দিয়ে এটা গড়ে তুলেছেন। তিনি এখন আর বেঁচে নেই। বছর দু’তিনেক হবে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে এখনো। শনিবার গিয়েছিলাম, চোখটা দেখাতেই। গতবার চশমাটা নিয়েছিলাম, সেটা ঠিক আছে কিনা দেখিয়ে নিলাম। আর চোখের অন্য একটা অসুবিধার জন্য ড্রপ দেওয়া হলো সঙ্গে।