স্বামী বিবেকানন্দের গদ্য ‘মা, আমায় মানুষ কর’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০২০

স্বামী বিবেকানন্দের আজ জন্মদিন। ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি ভারতের উত্তর কলকাতার ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের এক উচ্চবিত্ত কায়েস্ত দত্ত হিন্দু বাঙালি পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘মা, আমায় মানুষ কর’ লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

আমি চাই a band of Young Bengal (একদল বাঙালি যুবক); এরাই দেশের আশাভরসা-স্থল। চরিত্রবান, বুদ্ধিমান পরার্থে সর্বত্যাগী এবং আজ্ঞানুবর্তী যুবকগণের উপরই আমার ভবিষ্যৎ ভরসা—আমার idea (ভাব)গুলি যারা work out (কাজে পরিণত) করে নিজেদের ও দেশের কল্যাণ-সাধনে জীবনপাত করতে পারবে।

‘আত্মানো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আমাদের জন্ম, কি করছিস্‌ সব বসে বসে? ওঠ্‌—জাগ, নিজে জেগে অপরকে জাগ্রত কর্‌, নরজন্ম সার্থক করে চলে যা। ‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত।’

টাকায় কিছু হয় না, নামেও হয় না, বিদ্যায়ও হয় না, ভালবাসায় সব হয়—চরিত্রই বাধাবিঘ্নরূপ বজ্রদৃঢ় প্রাচীরের মধ্য দিয়া পথ করিয়া লইতে পারে।

আমাদের এখন এমন ধর্ম চাই, যাহা আমাদিগকে মানুষ করিতে পারে। আমাদের এমন সব মতবাদ আবশ্যক, যেগুলি আমাদিগকে মানুষ করিয়া গড়িয়া তোলে। যাহাতে মানুষ গঠিত হয়, এমন সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রয়োজন।

যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই মনে হয়, পৌরুষ বা বীরত্বের উপরই সব কিছু নির্ভর করে। ইহাই আমার নূতন বাণী।

নেতা কি বানাতে পারা যায়? Leader (নেতা) জন্মায়। লিডারি করা আবার বড় শক্ত—দাসস্য দাসঃ, হাজারো লোকের মন যোগানো। ঈর্ষা, স্বার্থপরতা আদপে থাকবে না—তবে leader (নেতা)। প্রথম by birth (জন্মগত), দ্বিতীয় unselfish (নিঃস্বার্থ); তবে leader (নেতা)। ...‘প্রীতিঃ পরমসাধনম্‌’।

‘শিরদার তো সরদার’, মাথা দিতে পার তো নেতা হবে। জগৎ উচ্চ নীতির জন্য আদৌ ব্যস্ত নয়, তারা চায় ব্যক্তি! তারা যাকে পছন্দ করে, তার কথা ধৈর্যের সহিত শুনবে, তা যতই অসার হউক না কেন—কিন্তু যাকে তারা পছন্দ করে না, তার কথা শুনবেই না। এইটি মনে রেখো এবং সেইমতো লোকের সহিত ব্যবহার করো। … যদি শাসন করতে চাও সকলের গোলাম হয়ে যাও। এই হল আসল রহস্য।

বিশ্বজগতে এই মানব-দেহই শ্রেষ্ঠ দেহ এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষ সর্বপ্রকার জীবজন্তু হইতে, এমনকি দেবাদি হইতেও উচ্চতর। মানুষ অপেক্ষা উচ্চতর আর কেহ নাই।

যতক্ষণ মানুষ প্রকৃতিকে অতিক্রম করিবার জন্য সংগ্রাম করে, ততক্ষণ তাহাকে যথার্থ ‘মানুষ’ বলা চলে। এই প্রকৃতির দুই রূপ—অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিঃপ্রকৃতি।

আমার আদর্শ বস্তুতঃ অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এইঃ মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সর্বকার্যে সেই দেবত্ব-বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে।

লক্ষ লক্ষ নর-নারী পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, ভগবানে দৃঢ়বিশ্বাস-রূপ বর্মে সজ্জিত হইয়া দরিদ্র পতিত ও পদদলিতদের প্রতি সহানুভূতিজনিত সিংহবিক্রমে বুক বাঁধুক এবং মুক্তি, সেবা, সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যের মঙ্গলময়ী বার্তা দ্বারে দ্বারে বহন করিয়া সমগ্র ভারতে ভ্রমণ করুক।

সকলের সঙ্গে মিশতে হবে, কাউকে চটাতে হবে না। All the powers of good against all the powers of evil. (সমুদয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সমুদয় শুভশক্তি প্রয়োগ করতে হবে)—এই হচ্ছে কথা।

জগতের ইতিহাস হইল—পবিত্র, গম্ভীর, চরিত্রবান এবং শ্রদ্ধাসম্পন্ন কয়েকটি মানুষের ইতিহাস। আমাদের তিনটি বস্তুর প্রয়োজন—অনুভব করিবার হৃদয়, ধারণা করিবার মস্তিষ্ক এবং কাজ করিবার হাত। … যদি তুমি পবিত্র হও, যদি তুমি বলবান হও, তাহা হইলে তুমি একাই সমগ্র জগতের সমকক্ষ হইতে পারিবে।

জগতের সমুদয় ধনরাশির চেয়ে ‘মানুষ’ হচ্ছে বেশি মূল্যবান। উদীয়মান যুবকসম্প্রদায়ের উপরেই আমার বিশ্বাস। তাহাদের ভিতর হইতেই আমি কর্মী পাইব। তাহারাই সিংহবিক্রমে দেশের যথার্থ উন্নতি-কল্পে সমুদয় সমস্যা পূরণ করিবে।

ভারতবর্ষে তিনজন লোকও পাঁচ মিনিটকাল একসঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতে পারে না। প্রত্যেকেই ক্ষমতার জন্য কলহ করিতে শুরু করে—ফলে সমস্ত প্রতিষ্ঠানটিই দুরবস্থায় পতিত হয়।

মানুষ হও, রামচন্দ্র!—অমনি দেখবে ওসব বাকি আপনা আপনি গড়গড়িয়ে আসছে। ও পরস্পরের নেড়িকুত্তোর খেয়োখেয়ি ছেড়ে সদুদ্দেশ্যে, সদুপায় সৎসাহস, সদ্বীর্য অবলম্বন কর। যদি জন্মেছ তো একটা দাগ রেখে যাও।

আমরণ কাজ করে যাও—আমি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছি, আর আমার শরীর চলে গেলেও আমার শক্তি তোমাদের সঙ্গে কাজ করবে।

স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলি থেকে গৃহীত