অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ

স্মরণ: দুই শিক্ষক

মুয়ীন পারভেজ

প্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০১৯

আমাদের শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ মারা গেলেন। শহরে আসার পথে ১ নম্বর গেইটের কাছে গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন ২২ সেপ্টেম্বর। শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর পরশু সন্ধ্যায় তাঁরে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হইছিল। রাত দশটার দিকে সেখানে মারা যান।

মোহাম্মদ শাহ সার সম্ভবত বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস পড়াইতেন আমাদের। বিষয়শিরোনাম পরিষ্কার মনে নাই। ছিলাম একলষেঁড়ে ছাত্র, নিয়মিত ফাঁকি দিতাম ক্লাসে। বছরশেষে যথারীতি হইলাম ‘ডিসকলেজিয়েট’। পরীক্ষায় বসা বারণ। কেরানি বললেন, ‘কিছু তো করার নাই।’ হতাশ হইয়া পড়লাম, পরে সাহসে বুক বাইন্ধা ঢুকলাম মোকাদ্দেসুর রহমান সারের খাসকামরায়। সার একটি বইয়ের বাথটাবে তখন মুখ ডুবাইয়া আছেন। সেলাম দিয়া দাঁড়াইলাম।
‘কী চাস?’ মুখ তুইলা তাকাইলেন সার।

সংক্ষেপে নিবেদন করলাম রাজ্যহারা হইবার কাহিনি। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাইকা সার উঠলেন চেয়ার ছাইড়া, ‘চল আমার সাথে।’ আমারে নিয়া সার গেলেন মোহাম্মদ শাহ সারের দরবারে। তিনি বিভাগীয় প্রধান হইলেও একসময় মোকাদ্দেস সারের ছাত্র ছিলেন। স্বয়ং গুরুরে সামনে উপস্থিত দেইখা তিনি আর আপত্তি করলেন না। ছাড়পত্র পাইলাম তৎক্ষণাৎ। কারও একটুখানি অনুকম্পার হিমেল পরশ পাইলেই শিশির জমতে থাকে চোখের পাতায়, শৌচাগারে গিয়া সেদিন কাঁদছিলাম অনেকক্ষণ।

মোকাদ্দেস সার ছিলেন খুব সুরসিক ও সপ্রতিভ। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়াইতেন। ক্লাস তো নয়, মনে হইত মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখতেছি! কানে এখনও বাজতেছে, গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে বলতেছেন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ‘হি ওয়াজ অ্যাবসলিউটলি সাইলেন্ট অ্যাবাউট গড।’ বইলা সাঁচি-স্তূপের মতো নীরব কিছুক্ষণ। ঈশ্বর নিয়া মাথাব্যথা ছিল না সে-সময়, থাকলে সারের এই ক্ষণিক নীরবতার মানে হয়তো বুঝতে পারতাম।

প্রথম বর্ষের প্রথম দিকের ক্লাসে একদিন। উজ্জয়িনী-প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘এক বিখ্যাত কবির কবিতায় উজ্জয়িনীর কথা আছে। কেউ বলতে পারিস?’
পড়াশোনায় তো মনোযোগী ছিলাম না কোনও কালে, কিন্তু উত্তরটা কাকতালীয়ভ‍াবে জানা ছিল বইলা লাজুকতা বিসর্জন দিয়া দাঁড়াইয়া গেলাম, ‘‘রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ কবিতায়।’’
‘কয়েক লাইন কইতে পারবি?’ সারের মুখে হাসির আভা।
‘দূরে, বহুদূরে’ বইলা শুরু করলাম আবেগমাখা স্বরে, উজ্জয়িনীপুরে আইসা থামলাম। ‘প্রথমা প্রিয়া’র কথা সারই বলতেছিলেন, কিন্তু তখন আমার হয়তো কৌতূহল ছিল সহপাঠিনীদের সারিতে, তারা এই গর্দভরে একটু নেকনজরে দেখতেছিল কি না!

ইতিহাস খুব পছন্দের বিষয় হইলেও ক্লাসশেষে প্রায়শ ছুইটা যাইতাম দোতলায়, বাংলা বিভাগের বারান্দায়। বান্ধবীবেষ্টিত কবিবন্ধু ফুয়াদ হাসানের সাথে সেমিনারকক্ষে আড্ডা দিতাম, সদাশয় আলম ভাইয়ের কাছ থেকে কবিতার বই নিয়া পড়তাম, কখনও-বা জরিপ চালাইতাম, ‘আচ্ছা, বলো তো কে তোমাদের প্রিয় শিক্ষক?’ রুমা, মুক্তা, মহিউদ্দিন ও আরও অনেকেই প্রথমত ময়ুখ চৌধুরীর কথা বলত, তবে শেষবিচারে মহীবুল আজিজের দিকেই পাল্লা ভারী থাকত। এসব জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকতাম বইলা নিজের বিভাগের সাথে তেমন ভাবভালোবাসা হয় নাই আমার, পড়াশোনা তো দূরের কথা।

থাকতাম উত্তর ক্যাম্পাসে, বিলের ধারে এক কটেজে। কাছাকাছি ছিল পুরাতন শামসুন্নাহার হল। হলের সামনে চৌরাস্তার মোড়ে আইসা ক্যাম্পাসগামী বাস ধরতে হইত। এক শীতার্ত সকালে মোড়ে দেখি দাঁড়াইয়া আছেন মোকাদ্দেস সার ও মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী সার। চোখে পড়তেই মোকাদ্দেস সার বললেন, ‘কই যাস? ওদিকে তো মেয়েরা থাকে!’ আমারে আচমকা বিব্রত কইরা মজা নিতেছেন তিনি, মিটিমিটি হাসতেছেন স্বল্পবাক পাটোয়ারী সার।

শিক্ষার্থীবান্ধব হইলেও মোকাদ্দেস সারের সাথে আমার অন্তরঙ্গ আলাপের কোনও স্মৃতি নাই। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক শহিদ গিয়াসউদ্দিন আহমদরে নিয়া নাতিদীর্ঘ গদ্য লিখছিলেন মোকাদ্দেস সার, ‘ভোরের কাগজ’-এ। কাগজ কাইটা সে-লেখা যত্ন কইরা রাইখা দিছিলাম ঘরে। আছে এখনও।

মোহাম্মদ শাহ সারের প্রসঙ্গে বলতে গিয়া দিল্লি চইলা গেলাম। এ আমার এক দোষ—কলমবিরিষের দড়ি মুঠো-আলগা হইয়া যায় যখন-তখন। দুজন শিক্ষকই আজ প্রয়াত। তাঁদের উদ্দেশে প্রণাম।

লেখক: কবি