প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

স্মৃতি-বিস্মৃতির নদী

ফাল্গুনী পান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০২০

কয়েকদিন ধরে বেশ একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি। অবশ্যই আমি সেই সামাজিক প্রিভিলেজড অংশটার মধ্যে রয়েছি। তাই এই দুর্দিনেও সুখের ঘোরের অন্দরে চলাফেরা করছি নির্দ্ধিধায়। ৯ বছর বয়সে আমি গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে হাজির হই। সাথে হারিয়ে যায় কত কত সম্ভাবনাময় স্মৃতি, কত মাটি মাখা অভিজ্ঞতা।

হিংলো নদীর পাড়ে আমার ঘর। এ নদী খুব একটা কেউ চেনে না। না চেনাটাই স্বাভাবিক। বাংলার অলিগলিতে এরকম কত যে নদী আছে কিংবা ছিল, তার হিসেব আমাদের শহুরে জীবনে থাকে না। আমার মামার বাড়ি যেতে হতো হিংলো পেরিয়ে। শুধু হিংলো পেরোলেই হতো না। হিংলোর পর ছিল কানা নদী, তারপর অজয়। কানা নদী আজকের টপিক।

নদীর যে ছবিগুলো আমাদের চোখে ভেসে আসে, ‘কানা’ সেই ছবির মধ্যে পড়ে না। কানা নদী হিংলোর শাখা নদী, আমাদের গ্রামের ঠিক আগেই হিংলো থেকে বেরিয়ে গিয়ে পড়েছে আবার অজয়ে। হিংলো পেড়িয়ে আম বাগান, সবুজ মাঠ, শরের ঝোপ পেরিয়ে তারপর রাস্তায় পড়তো কানা নদী। আমার বয়স তখন নয়ের কম, মায়ের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যেতাম মামার বাড়ি, কখনও সখনও বাবার সাইকেলে চেপে। বাবার সঙ্গে এলে হিংলো পেরিয়ে প্রথমে আমাদের মাঠ দেখে আবার সাইকেলে উঠতাম।

হিংলোতে তখন সারা বছর জল থাকতো, খুব সামান্য হলেও থাকতো। সেই জল তিড়তিড় করে বয়ে আসতো কানা নদীর শরীর বেয়ে। কানা নদী চওড়ায় হাত আষ্টেকের বেশি হবে না। ঘন শরঝোপের মধ্যে থেকে খুব সামান্য সময়ের জন্য সে উন্মুক্ত হতো, আবার হারিয়ে যেত শরঝোপের অন্তরালে। সে সামান্য সময়েই সে লৌকিক সৌন্দর্যে আমার মননে চিরস্থায়ী রয়ে গেছে। স্বচ্ছ কাচের মতো গোড়ালি ডোবা জলের নিচের সূক্ষ্ম বালির মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সিলিকা পড়ন্ত বেলার আলোতে শুকতারার মতো চকচক করতো। সেই বালিতে পা দিলে পা ডুবে যেত, আর ছোট্ট ছোট্ট মাছ ছুটে বেড়াতো এদিক ওদিক।

পা ঘষে ঘষে কিছুটা এগিয়ে যেতাম, আবার ফিরে আসতাম। ঘন শরঝোপ অন্ধকার করে দিত চারদিক একটু এগোলেই। স্বচ্ছ জল আঁজলে ভরে খেতাম কিছুটা, তারপর আবার ফিরে আসতাম মায়ের কাছে। জ্যামিতির সমকোণের মতো ভূমি বরাবর বয়ে যেত কানা নদী, আর লম্ব বরাবর আর একটা স্রোত বয়ে যেত অজয়ের দিকে। বর্ষা কালে যখন খুব বান হতো তখন এই কানা নদীর নদীপথ বরাবর হিংলো আর অজয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। সেটা কেমন দেখতে তা দেখিনি অবশ্য। দেখা সম্ভবও হতো না, তখনকার নদীর বন্যার চরিত্র এখনকার তুলনায় অনেক আলাদা ছিল।

প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার তখনও শুরু হয়নি, নদী থেকে বালি তুলে বিক্রি করার দালাল চক্রও তখন ছিল না। ফলত নদীখাত ছিল গভীর, বালিপূর্ণ। আর বান হলে দূর থেকে নদীর গর্জন শোনা যেত। ভয় পেত তাতে। যাই হোক, যে বছর হিংলো অজয়ের জল মিশে যেত সে বছর সাময়িক ভাবে চাষের ক্ষতি হতো খুব। সে কারণে কোনো একসময় পঞ্চায়েত থেকে কানা নদী থেকে অজয় নদীতে জল যাওয়ার যে সরু রাস্তাটা ছিল সেই রাস্তায় লকগেট তৈরি করা হয়। আমি যখন কানা নদীকে দেখছি তখন এই লকগেট অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। দুটো বড় বড় মোটা কাঠের দরজা, আর পলেস্তরা খসে যাওয়া ইঁট বের হয়ে যাওয়া একটা শরীর যার সারা গা বেয়ে শিশু বট গাছ উঠছে, কিছুটা লতিয়ে এসে তারপর সোজা হয়ে। আরও অচেনা বড় ছোট লতানো গাছ সেই লকগেট জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে।

কানা নদী থেকে একটা সরু জলরেখা লকগেটের ভেতর দিয়ে শান্‌ বাঁধানো চাতাল বরাবর শান্ত ধীর গতিতে বেয়ে চলছে অজয়ের পানে। ওটুকুর মধ্যে কত যে পাখি ছিল তার ইয়াত্তা নাই। লকগেটের দরজা, ইটের শরীরে বেশ কিছু গোসাপও জড়িয়ে থাকতে দেখতাম কখনও। ধীর পায়ে লেগে থাকতো মামার বাড়ি যাওয়ার তাড়া। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাতাম অজয়ের বুকে। ‘মানুষের আয়ু মানুষের জীবনের ভুল মাপকাঠি’ একথাটা বোধহয় নদীর জীবনের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। কানা নদী আর নেই। একটা কালো কাদা মাখা, কালো জল জমে থাকা ডোবাতে পরিণত হয়েছে।

কানা নদীর নদীপথ বুজে গেছে। বৃষ্টি হলে ওই ডোবা মতো জায়গায় শুধু জল জমে থাকে। সেই লকগেটের কপাট কেউ খুলে নিয়ে গেছে। বাঁধানো শান্‌ ভেঙে সেখানেও জমেছে শুধু কাদা। যার উপর দিয়ে গুরুগম্ভীর আওয়াজে সময়ে অসময়ে বালি ভরা ট্রাকটর চলে যায়। গোসাপগুলো কোথায় গেছে জানি না, সেই শিশু বট গাছ আর যৌবনে এসে পৌঁছায়নি।

সেদিন রাতে একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। এবছর খুব বন্যা হয়েছে। আবার অজয় হিংলোর জল মিলে মিশে হয়ে গেছে একাকার। বালি জমেছে কানা নদীর বুকে। বানের জল ধুয়ে দিয়ে গেছে কানা নদীর এতদিনের জড়তা। ভেনিসের ডলফিন কিংবা শান্তিনিকেতনের পাখি আমার আমার অবচেতনে এই স্বপ্ন এঁকে দিয়ে গেছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু স্বপ্ন থেকে যখন আমার ঘুম ভাঙলো তখন আমার চোখের কোণাগুলো ছিল ভিজে, আর একটা প্রচণ্ড ব্যথা জড়ানো আনন্দে ‘কানা’র জলের মতো তিড়তিড় করে ছটফট করে উঠেছিলাম আমিও।

লেখক: শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিভাগ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়