হাতিয়ার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বারবার জন্ম হবে
তুহিন খানপ্রকাশিত : মে ১২, ২০২০
এই বছর ঠাকুররে নিয়া কিছু না লেইখা বাঁইচাই গেছি মনে হয়। আমি তো আদতে বাঁইচা বাঁইচা চলতে চাওয়া মানুষই। তো, বেকার সময়গুলারে নানারকম অবজার্ভেশনে কাজে লাগাইতেছি। পর্যবেক্ষণে দেখলাম, অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর ঠাকুর-প্রসঙ্গে নারীরা বেশি সরব; পক্ষ-বিপক্ষ দুইদিকেই। এইটা গুড সাইন। ঠাকুর বাঁইচা থাকলে খুশি হইতেন।
রবীন্দ্রপ্রেমী নারীরা রবীন্দ্রনাথরে একটা `অ্যানার্কিবিরোধী`, `সৌম্য সুন্দর` বা মৈত্রেয়ী দেবীর চোখ দিয়া পুরান `কবিগুরু`র ইমেজেই দেখতেছেন। বিরোধীরা একটু কনফিউজিড; উনারা রবীন্দ্রনাথরে মোস্টলি নারীর জন্য ক্ষতিকর বস্তু হিশাবে দেখাইতেছেন। নারী নিয়া রবীন্দ্রনাথের চিন্তা খুব উন্নত যে, তেমন না; কিন্তু নারীবাদীদের তৃতীয় জোয়ারে আইসা রবীন্দ্রনাথ মেবি একটু সেফ পজিশনেই আছেন এখন। দ্বিতীয় জোয়ারের মোস্টলি লিবারেল হিউম্যানিস্ট বা মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্টরা তো এখন আর অত `কুল` না, ফলে ঠাকুরের নারীভাবনা এখন আর অত সমালোচিত না। এই জন্মদিনে অনেকদিন পর আবার এইসব নিয়া আলাপ দেখলাম।
রবীন্দ্রপ্রেমীরা `সাম্প্রদায়িকতা` শব্দটারে ঝালাই করেন তার প্রতি জন্মদিনেই, এইটা ফলে নতুন কিছু না। তবে, এরা দেখলাম সলিমুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে এক ধরনের সংঘবদ্ধ প্রচার চালাইতেছেন, এই মর্মে যে— উনি রবীন্দ্রবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মানুষ। সলিমুল্লাহ খানের জন্য আফসোস লাগে। ওনার শাহবাগী সতীর্থরা প্রায়ই ওনারে নানারকম প্যারা দেয়। জ্ঞানী লোকের এই বিপদ।
নজরুলের নোবেল রবীন্দ্রনাথ চুরি করছে, নজরুলরে রবীন্দ্রনাথ বিষ খাওয়াইছে— এইসব গল্প প্রতিবারই দেখি। সম্ভবত ফেসবুকের বদৌলতে এগুলা টিকে যাবে। এই গল্পগুলা নিয়া হাসাহাসি করেন যারা, সেই জ্ঞানী মানুষদের বিপক্ষে দুই কথা বইলা বিপদে পড়তে আমি নারাজ। কিন্তু, গল্প বা মিথ নিয়া নতুন চিন্তা তো খুব নতুন কোন বিষয় না; অনেক পুরান বিষয়। এইসব রবীন্দ্রবিরোধী গল্পের উৎস হিশাবে আমাদের প্রগতিশীল লোকেরা `সাম্প্রদায়িকতা`র দোষ দেন। অথচ, আমাদের বাপ-দাদা যারা এইসব গল্প শুনাইছেন, উনারা একইসাথে আবার দরদ নিয়া `আমার সোনার বাঙলা`ও গাইতেন। এই যমিনের আদি বাসিন্দা যদি কাউরে বলতে হয়, তাইলে সেইটা ব্রিটিশদের অধীনে, হিন্দু জমিদারদের জন্য কামলা খাটা আমাদের দাদা-পরদাদারাই। যদি এইসব গল্পের উৎস স্রেফ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হইত, তাইলে যে হারে রবীন্দ্রবিরোধী গল্প দেশে চালু আছে, তাতে অন্তত গ্রামের স্কুলগুলায় এতদিনে জাতীয় সংগীত বন্ধ হইয়া যাওয়ার কথা।
একটা অস্থির সময়ের কালেক্টিভ স্মৃতি থিকা এইসব মিথের জন্ম। এর পিছনে বাঙলাদেশের মানুশের অনেক অনেক দিনের বঞ্চনা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ আর মাজলুমিয়াতের ইতিহাস আছে। পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি ক্যান ঝাপ দিয়া পড়ছিল, আমাদের প্রগতিশীপ বুদ্ধিজীবীরা তা বলতে পারেন না তো। বিদেশি লেখকদের বই পইড়া জানতে হয়। ওনাদের মুখস্ত বুলি— সাম্প্রদায়িকতা। ওনারা পশ্চিমের আলোয় এতই আলোকিত হইছিলেন, দেশীয় যেকোন অনাচাররে `সাম্প্রদায়িকতা`র লেন্সে না দেখলে সুখ পাইতেন না। তো, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তাই হইছে। ওনারা ভাবছেন, সাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু, পাকিস্তান আন্দোলনের আসল কারণ কী ছিল, ভারত বা বাঙলা ভাগে কোন কোন বুড়া খোকাদের হাত ছিল, সেগুলা তো এখন আমরা নতুন কইরা জানতেছি। ফলে, মিথরে খালি সাম্প্রদায়িকতা ভাবা ভুল। মিথ একটা জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আশা, আকাঙ্ক্ষা ও যন্ত্রণার প্রতিনিধি। আর বাঙলাদেশের মোসলমান ও নমঃশুদ্রদের রাজনৈতিক যন্ত্রণার ইতিহাসে, রবীন্দ্রনাথরে আনফরচুনেটলি, নানা অর্থেই, আমরা মিত্র হিশাবে পাই নাই।
যে যন্ত্রণা থেকে বাঙলাদেশের মানুষ দুই দুইবার আলাদা দেশ বানাইছে, সেই যন্ত্রণার মানচিত্র রবীন্দ্রনাথের অবস্থান একটু বেকায়দারই। মহাভারতের ঋষী রবীন্দ্রনাথ, কোলকাতার সাম্প্রদায়িক সেক্যুলারিজমেরও বড় চরিত্র রবীন্দ্রনাথ। এগুলা ওনার পলিটিকাল পজিশন, নানা কারণে নিতে হইছে। তাতে ওনার লেখকসত্তা বা চিন্তক হিশেবে ওনার গুরুত্ব কমে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ খালি কবি বা লেখক, আজিজের চিপায় ঘোরাঘুরি করা সাহিত্যিক না। তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক। ফলে, রাজনৈতিকভাবে তারে ব্যাখ্যা বা মোকাবেলা করা তো জরুরি। আর তা করতে গেলে দেখা যায় যে, সাহিত্যিক হিশাবে, বাঙলা ভাষার একজন বড় প্রতিভা হিশাবে, প্রাচ্যের দার্শনিক হিশাবে বা আরো বহু হিশাবে উনার গুরুত্ব হয়ত আকাশসমান; কিন্তু বাঙলাদেশের মানুশের রাজনৈতিক দর্শনে রবীন্দ্রনাথরে পুরাপুরি আঁটানো বা রিভাইভ করা মুশকিল। নানা কারণেই, এইটা খালি ভক্তি দিয়া পারবেন না। রাজনীতিতে ভক্তি চলে না।
দেখেন আয়রনি, এদেশের শাহবাগি-সাম্প্রদায়িক প্রগতিশীলদের গুরুও রবীন্দ্রনাথ। মহা মুশকিল। তাইলে, এই শাহবাগী প্রগতিশীলদের কালচারাল সাম্প্রদায়িকতার পিছনে রবীন্দ্রনাথরে উনারা কাজে লাগাইছেন। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু চোখ-কান খোলা রাখা ছেলেরাও `ছায়ানট` কী জিনিশ বোঝে, ওদের নিয়া হাসাহাসি করে। তো এদেশের সাম্প্রদায়িক প্রগতিশীলদের গুরু যে রবীন্দ্রনাথ, তার বিরুদ্ধে তো হাসাহাসি করাই লাগবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইজ ডেড। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ আর দুনিয়ায় আসবেন না। কিন্তু যুগে যুগে নানা ধরনের মানুষের আইডিওলজি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিশেবে উনার নতুন নতুন জন্ম হবে। এক রঠার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে আরেক রঠা। এই সার্কেল যদ্দিন চলবে ততদিন উনি জিন্দা থাকবে। আপনি যদি ঠাকুরভক্ত হন, তাইলে কোন ঠাকুরের আপনি ভক্ত, ঠিক করেন। বড় মানুশ, আনফরচুনেটলি, এইভাবেই জিন্দা থাকে।
























