১৫ আগস্ট এবং শামসুর রাহমানের একটি কবিতা

ফজলুল হক সৈকত

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০১৯

আগস্ট মাসটি নানান কারণে বাঙালি ও বাংলাদেশিদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ; পরিবারের ১৭ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু হত্যা; কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ও আবুল হোসেনের জন্ম; হুমায়ুন আজাদ এবং শামসুর রাহমানের মৃত্যু এবং গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা— এসব ঘটনা ঘটেছে এই আগস্ট মাসে। কাজেই আমাদের সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে আগস্ট মাসের সম্পর্ক বেশ নিবিড় বলেই মনে হয়। তবে প্রিয় পাঠক, বিনয়ের সাথে জানিয়ে রাখি, আমাদের বর্তমান আলোচনাটি সীমাবদ্ধ থাকবে শামসুর রাহমানের একটি মিথ-সংমিশ্রিত কবিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনাকে উপস্থাপনের কৌশল ও নির্মিত-আবহ পরিবেশনের মধ্যে।

কবি-কথানির্মাতা শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯- ১৭ আগস্ট ২০০৬) প্রতিনিয়ত সক্রিয়তা আর সৃষ্টিশীলতার বাতাবরণে সময় পার করেছেন; প্রথম কাব্য প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০) প্রকাশের পর তাঁকে কবিতাচর্চা থেকে কখনো বিরত থাকতে দেখা যায়নি। কবিতাগতপ্রাণ এই কবি ভেতরে ও বাইরে কবিতাশিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন সবসময়; সম্ভবত এক ধরনের অন্তর্গত প্রেরণা তাঁকে তাড়না দিয়েছে কবিতার কথামালা তৈরির জন্য। রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি ক্রমাগত বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটেছেন নতুন নতুন ভাবনা ও অভিজ্ঞানকে ধরবার এবং প্রকাশ করবার তাড়নায়। পৃথিবীর তাবৎ সতর্ক কবিদের মতো তিনিও প্রাচুর্যের পথে পা বাড়ালেন নিজের আন্তরশক্তি ও অন্তর্লোককে পরিবেশন করার প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য টানে। নিজের ভাবনাবলয়কে অতিক্রম করার পাশাপাশি প্রচুর কবিতায় কেবল নিজেকেই প্রদক্ষিণ করেছেন শামসুর রাহমান; তবে আত্ম-অনুকরণ ও আত্ম-বিবরণে আগ্রহী এই কবিতা-কারিগর বেশ কিছু অসামান্য কবিতা সৃষ্টি করে আমাদেরকে তৃপ্তি দান করেছেন। অবশ্য প্রায় দুই দশক কবিতায় প্রবল প্রতিবাদ-ঝড়-উন্মাাদনা জন্ম দেবার পর চলার স্রোতে খানিকটা ধীরতায় নেমেছেন তিনি। বিশেষ করে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, ইকারুসের আকাশ, মাতাল ঋত্বিক ও উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ পর্বে (প্রথমটি ১৯৭৮, পরের তিনটি কাব্যগ্রন্থ ১৯৮২তে প্রকাশিত) তাঁর এই সৌম্যকান্তি স্বভাব প্রকাশ পায়; যেন তিনি প্রবল বাতাসে বহুকাল নৌকা চালিয়ে মোহনায় কিংবা চরের সামান্য বাধায় বিশ্রাম নিচ্ছেন খানিটা। তখন, এই আপাত বিশ্রামের কালে, কবি রাহমান, মিথ এবং কিংবদন্তির প্রয়োগের দিকে মনোযোগী হলেন। মিথের বা পুরাণের পাশাপাশি তাঁর কবিতার এই পর্বে প্রবেশ করেছে দুঃসময়ে কবির ব্যক্তিগত অস্থিরতা এবং প্রেমনির্ভরতা।

মিথকে দার্শনিকরা বলেন রূপক বা প্রতীকাশ্রিত কাহিনী। সাম্প্রতিক সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনায় মিথ কোন ধারণা-আশ্রিত বিষয়বস্তু বা দৃষ্টান্তরূপী চরিত্র। যেমন- রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’, শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ প্রভৃতি। ইংরেজিতে মিথের প্রতিশব্দ অনেক। পুরাকাহিনী অর্থে পাই লোককথা, গল্প, ঐতিহ্য, কল্পকাহিনী, উপকথা, গাথা, রূপক, প্রতীক, রূপকথা, লোককাহিনী প্রভৃতি। আধুনিক প্রয়োগে পাওয়া যায়- বিভ্রম, কাহিনী, অলীক, উদ্ভট, কল্পনা, উদ্ভাবনা, মায়া, কুসংস্কার, বানোয়াট, মিথ্যা, আষাঢ়ে, গালগল্প, আজগুবি প্রভৃতি বাংলায় কী বলব মিথকে? অভিধান বলছে, পুরাণ, পুরাকাহিনী, অতিকথা, উপকথা, উপাখ্যান, কিংবদন্তি। সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলছে, প্রধানত কোন গূঢ় রহস্যের ব্যাখ্যাপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী। আবার বলছে ‘গূঢ় অর্থপূর্ণ কাহিনী’। অর্থাৎ তা ‘পৌরাণিক’ না-ও হতে পারে; প্রাচীনকাল থেকে পুরুষানুক্রমে প্রবহমান কাহিনী, বিশেষত কোন জাতির আদি ইতিহাসসম্পৃক্ত বিশ্বাস ও ধারণা এবং নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা। মিথ বলতে যে ‘কাল্পনিক, উদ্ভাবিত বা বানোয়াট ব্যক্তি বা বস্তু’কেও বোঝায় তা-ও বলছে অভিধান।

সাহিত্যে মিথের ব্যবহার সাহিত্যের প্রায় সমান বয়সী। কিন্তু বিশ শতকের শেষ তিন দশকে মিথের ওপর থেকে আলো সরে গিয়ে সমালোচকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে জটিল জীবনের ওপর। সাহিত্যে আধুনিক এই জীবনের বহুমাত্রিক জটিলতা কিভাবে মূর্ত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য সাহিত্য বিশ্লেষকরা বিভিন্ন তত্ত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, মিথের ওপর নয়। উত্তর-কাঠামোবাদী ও উত্তর-আধুনিক ভাবুকতায় যেখানে টেক্সটের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেখানে মিথের উপযোগিতা খর্ব হওয়াই স্বাভাবিক, আর হয়েছেও তাই। তবে, উৎস পুরাকালে হলেও মিথ এখনও প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে শিল্পতাত্ত্বিক জোসেফ ক্যাম্পবেল জানাচ্ছেন, মিথ সাধারণত চার ধরনের কাজ করে। এর প্রথম কাজ হল মানবীয় রহস্যময় সত্তার আবিষ্কার এবং একে স্বীকার করে নেয়া। মানুষ এ রহস্যের মধ্যে ঢুকে, বেরিয়ে গিয়ে কিংবা সংশোধন করে এগিয়ে চলে। মিথের দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে বিবৃতিমূলক। এই বিবরণের লক্ষ্য হচ্ছে, বিশ্বলোকের সংগতিপূর্ণ ছবি বা ইমেজের ধারণা দেয়া। কিন্তু আমাদের যদি ইচ্ছা হয়, বিশ্বলোকের সুশৃঙ্খল বিন্যাসকে অগ্রাহ্য করতে পারি। এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব। অথবা যদি মনে হয়, আমরা একে পরিশুদ্ধ করে উপস্থাপন করতে পারি। মিথের তৃতীয় কাজ হচ্ছে, যে-সমাজ থেকে মিথের সৃষ্টি, সেই সমাজে বিশেষ কোনো নৈতিক মানদণ্ডের বৈধতা ও প্রতিষ্ঠা দেওয়া। এমনটা ঘটলেই গণতন্ত্রের পর্দা ওঠে। প্রতিষ্ঠা পায় আরও বড় কোনো মিথ, আর সেটা হল রাজনৈতিক আধিপত্যের, প্রতাপের। এখানে পৌঁছেই ক্যাম্পবেল অনুধাবন করতে পেরেছেন নোয়াম চমস্কির প্রাসঙ্গিকতা। কেন এ ভাবুক মার্কিন আধিপত্যবাদী ভুবনীকরণের বিরুদ্ধে এতটা সোচ্চার, সমালোচনামুখর। কিন্তু এও তো দেখা যাচ্ছে ওই মিথের বিরুদ্ধেই আবার তৈরি হচ্ছে আরেক পাল্টা মিথ। নৈতিক শৃঙ্খলার কোনো চিহ্নই আর দেখা যাচ্ছে না। মিথের চতুর্থ কাজ, জীবনের বিভিন্ন স্তরে ব্যক্তিমানুষ কিভাবে দৈনন্দিন সমস্যার জট ছাড়িয়ে আত্মগরিমা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে, সেই শিক্ষা দেয়া।

শামসুর রাহমান কবিতায় মিথের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন প্রবল সচেতনভাবে। বিধ্বস্ত নীলিমা গ্রন্থের ‘পুরাণ’ কবিতায় যদিও রাহমান লিখেছেন, ‘আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন,/তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে।’ বলে পুরাণের প্রতি তাঁর অনীহার কথা জানালেও তিনি পুরাণ দ্বারা, বিশেষত পশ্চিমি পুরাণে, প্রভাবিত হয়েছেন। নিজেকে আবিষ্কার করেছেন ল্যাজারসের পুনরুত্থানের চিত্রকল্পের বাতাবরণে। নিজের অবস্থান, বহমান সমকাল ও গোত্র-গোষ্ঠীকে এবং পরাধীনতা ও বিদ্রোহের সমূহ ব্যাপারাদিকে প্রকাশ করার জন্যই তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পুরাণে। অ্যাপোলো, টেলেমেকাস, স্যামসন, অর্ফিয়ুস, ট্যান্টালাস, আফ্রোদিতি, ইকারুস, ইলেকট্রা, ডেডেলাস প্রভৃতি পশ্চিমি চরিত্রের ছবির পাশাপাশি প্রাচ্যের রুস্তম আর চাঁদ সওদাগর স্থান করে নিয়েছে তাঁর কবিতা-নির্মাণ কৌশলের কাঠামো থেকে। পুরাণ-প্রয়োগে রাহমান মূলত ব্যক্তির মহিমা প্রতিষ্ঠার দিকেই নিজেন নজর নিবদ্ধ রেখেছেন। শামসুর রাহমানের কবিতায়, বিশেষ করে ইকারুসের আকাশ গ্রন্থে মিথের বিপুল প্রয়োগ আমরা লক্ষ্য করি।

‘ইলেকট্রার গান’ কবিতাটির ভাব ও ভাষা সংহত, প্রগাঢ় বোধ এবং অনুভবজ্ঞানের জন্য সুখপাঠ্য। কবিতাটিতে রাহমানের স্বভাবজ তারুণ্যধর্ম নয়; প্রাধান্য পেয়েছে বয়স্কতা, প্রবীণতা তাই ফলত এক ধরনের পরিপক্বতাও। স্বাধীনতালাভ-পরবর্তীকালের, বিশেষ করে পঁচাত্তরের ভীষণ-ভয়াল সময় ও সমাজ অবলোকন ও উপলব্ধি করে, দুর্দিনে দেশের-জাতির উদ্ভট দুঃস্বপ্ন আর ভয়াবহ দৃশ্যাবলি দেখে দেখে তখন কবি ক্লান্ত-উত্তেজিত এবং অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সেই অস্থির মানসিকতার বহির্প্রকাশ সত্তর দশকের শেষপাদে ও আশির দশকের প্রারম্ভে, ইকারুশের আকাশ পর্বের, কবিতাগুলিতে স্পষ্টভাবে প্রফিলিত। পাশ্চাত্য মিথ নির্ভর “ইলেকট্রার গান” কবিতাটির আরম্ভ এরকম:

শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও:
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।

কবিতাটিতে রাহমান উনিশ শো পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অসহায়ত্বের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। শান্তিহারা এক বাংলাদেশের ছবি তিনি যেন প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ছোটবেলায় শুনতাম ’শান্তির মা নাকি মারা গেছে’। আজ এই শান্তিহারা সমাজে, শত্রু পরিবেষ্টিত চারপাশে চোখ রাখলে শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। আর শামসুর রাহমানের বর্তমান কবিটাটিতে মনোনিবেশ করলে অনুভব করা যায় শান্তিহীন রাষ্ট্রভূমির প্রকৃত অবস্থা। এই কবিতায় কবি বারবার বলছেন, ‘নিহত জনক, এ্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।’ কবিতাটির পঙক্তি সংখ্যা ৭৫ আর উপরিউক্ত পঙক্তিটি সাজিয়েছেন ১৫ বার। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাকে সংখ্যার দেয়ালে আবদ্ধ করার জন্য এই আপাত প্রয়াস। ১৫ বার প্রয়োগকৃত একটি পঙক্তি বাদ দিলে মোট পঙক্তি থাকে ৬০টি; আর তখন অনুচ্ছেদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫তে।  সংখ্যার বিবেচনায়; সংখ্যামিলের খাতিরে কবিতাটির বিন্যাস-পরিপাট্য যেমন আমাদেরকে আকৃষ্ট করে, তেমনি এর বিষয়ভাবনাও পাঠকের চিন্তায় বিশেষ অনুরণন তৈরি করে।

আমরা সকলে অবগত আছি যে, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার, স্থপতি এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে (দুই কন্য: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান) হত্যা করা হয়। কাজেই কবিতাটিতে বাংলাদেশের একটি বিশেষ কালপর্বের ইতিহাস চিত্রিত হয়েছে। যদিও মনে হতে পারে, রাষ্ট্রের বা তৎকালীন সমাজের বাস্তব পরিবেশের পাশাপাশি ব্যক্তি-বন্দনা হয়েছে একটু বেশি মাত্রায়। অবশ্য কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা চরিত্রের প্রতি কোনো কবির আকর্ষণ বা ভক্তি থাকতেও পারে- তাতে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটিও রেখাপাত করতে পারে কিছুমাত্রায়। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর, স্বপ্নে বোনা গোলাপ চারা, বনদোয়েলের গানের আকুতি, অবুঝ মেয়ের বেণীর দোলা আর শিশুদের অদম্য খেলার সাহসে সেদিন সম্ভবত ছেদ পড়েছিল খানিকটা। কবি অন্তত সে রকমইতো ভাবছেন। অথচ কত মানুষ মুজিবের পায়ের ধূলা নেওয়ার জন্য, আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য একসময় ভিড় করেছে তার বারান্দায়, দরোজার সামনে; ফুলের তোড়ায় তোড়ায় আর অভিনন্দনের উষ্ণ বাতাসে নেতার ঘর যেত ভরে; তাঁর ছিটেফোঁটা হাত-প্রসারণে কত কে যে কত কী হয়ে গেল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সেই মানুষটাকে কী অসহায়ভাবেই না, যে-কোনো অবলা প্রাণীর মতো, প্রাণ দিতে হলো।

পিতৃভবনে শুনেছি অনেক চারণের গাথা,
লায়ারের তারে হৃদয় বেজেছে সুদূর মদির সুরে।
একদা এখানে কত বিদূষক প্রসাদ কুড়িয়ে
হয়েছে ধন্য, প্রধান কক্ষ ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে।

অস্ট্রেলিয়ান চিত্রশিল্পী নামাৎজিরাকে যেমন প্রকৃতঅর্থে শ্রদ্ধা করেনি, তাকে নিয়ে ব্যবসা করেছে দেশটির নাগরিকরা, তেমনি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সুবিধা ভোগের জন্য মুজিবকেও অনেকে ব্যবহার করেছে; হয়তো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার চেয়ে তাঁর কাছ থেকে কিছু পাবার প্রতিই চারপাশের মানুষের ঝোঁক ছিল বেশি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুপরবর্তী সময়ে, কবি অনুভব করছেন- প্রজাপতির মতো নেচে-বেড়ানোর আনন্দ থেকে একটি নতুন জন্ম নেওয়া জাতিকে কারা যেন ডুবিয়ে দিল বিষাদ-মাখা, বিরূপ কুয়াশায় আচ্ছন্ন আর অবিরাম কান্নার সাগরমথিত নিদ্রাহীন শয্যায়! যুদ্ধের শেষে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জয়ঢাক আজ কেবল স্মৃতি হয়ে রইল; তাঁর নামে দিকে দিকে কীর্তনের গান আজ আর প্রায় শোনা যায় না। অথচ তিনিইতো আমাদের মুক্তিদূত; পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের অসীম শোষণ আর অপশাসনের দৌরাত্ম্য থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষকে মুক্তি দিতে, বাংলাদেশ নামক একটি আনকোরা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার জন্য তাঁর যে কী ব্যাকুলতা- কী অপার উদ্যম কার্যকর ছিল, তা কি আমাদের অজানা! কিন্তু আমাদের কী দুর্ভাগ্য; রাহমানের বিবৃতিতে:

নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে
গরীয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।
বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,
নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাঁকে সহসা হেনেছে ওরা।

ট্রোজান যুদ্ধে এগামেমনন্ ছিলেন গ্রিক ফোর্সের নেতৃস্থানীয় রাজা, স্পার্টা-র রাজা টায়েন্ডেরিয়সের সহায়তায় চাচা থায়েস্টেসকে সরিয়ে তিনি মাইকেন্যার রাজা হয়েছিলেন। অ্যাট্রিয়সের ছেলে এগামেমনন্ বিয়ে করেছিল রাজা টায়েন্ডেরিয়সের কন্যা ক্লাইটেমনেস্ট্রাকে। আর এগামেমনন্-এর ভাই বিয়ে করেছিল ক্লাইটেমনেস্ট্রার বোন ট্রয়ের হেলেনকে। ট্রোজানের রাজপুত্র প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করলে তাকে (ভাতৃবধু) উদ্ধারের জন্য ট্রয় অভিমুখে অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এগামেমনন্। গ্রিক বহর নিয়ে এলিসকে অতিক্রম করতে গিয়ে এগামেমনন্ দেবী আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে কন্যা ইফিজেনিয়াকে উৎসর্গ করেছিলেন। ট্রয় থেকে ফেরার সময় এগামেমনন্ দৈবজ্ঞা ক্যাসেন্ড্রাকে, যিনি তাঁর ভাবিষ্য-বাদীতায় বিশ্বাস না করার জন্য খ্যাত ছিলেন, উপপত্ হিশেবে সঙ্গে নিয়ে এলেন। ক্লাইটেমনেস্ট্রার জ্ঞাতসারে এটি ছিল তার জন্য এগামেমননকৃত অন্তত তৃতীয় আঘাত।

এগামেমনন্ এবং ক্লাইটেমনেস্ট্রার কন্য ইলেকট্রা। ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও তার প্রেমিক অ্যাগিজথাস ইলেকট্রার পিতা এগামেমনন্ কে হত্যা করে। অতঃপর ইলেকট্রা ও তার ভাই অরেসতেস পিতা হত্যার বিচারের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পিতৃহত্যার সময় ইলেকট্রা সেখানে ছিল না। সাত বছর পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সে ভাইয়ের সহায়তায় মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। শান্ত অথচ প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ইলেকট্রা অগ্রসর হতে থাকে। পৃথিবীখ্যাত গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস রচিত ট্র্যাজেডি ইলেকট্রাতে চরিত্রটিকে মূল আকর্ষণ হিশেবে নির্মাণ করা হয়েছে। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রতিশ্র“তিশীল ও প্রতিনিধিত্বকারী কবি শামসুর রাহমান গ্রিক মিথলজি থেকে এই বিশেষ চরিত্রটিকে নির্বাচন করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যার মধ্যে এগামেমনন্- ইলেকট্রা চরিত্রযুগলের ব্যাপারাদি স্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। বর্তমান কবিতাটি তারই পরিমিত শিল্পরূপ।

কাপুরুষের মতো ঘুমন্ত-নিরস্ত্র একজন জননেতাকে হত্যা করতে; কী দুর্দান্ত সাহস না হলে- নিজবাসগৃহে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে পারে! অবশ্য কোনো সমালোচকের কিংবা সমকালীন রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, শেখ মুজিব বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করে দেশে একদলীয় সরকার ও শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে, হয়তো, নিজের অজান্তেই স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। আর সে কারণেই তাঁর জীবনের ও রাজনীতির এই ভয়াবহ ও নির্মম পরিণতি। এবং বাস্তব-পরিস্থিতি না-কি এমন হয়েছিল যে, এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার প্রার্থনা কিংবা এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ্যে প্রকাশ করাটাও তখনকার সময়ে কঠিন ছিল। পরবর্তীকালে, বছর ছয়েক পরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে পিতার রেখে-যাওয়া অসমাপ্ত কাজ এবং রাষ্ট্রগঠনের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হলেন।

শামসুর রাহমান বাংলাদেশের ওই পরিস্থিতিতে মুজিব-কন্যার গুরুভার ও দায়-দায়িত্বের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে গিয়ে, হয়তো আপন আবেগে আর কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে, রচনা করেছেন বর্তমান কবিতাটি। রাহমানের কণ্ঠে শোনা যাক সেই চিন্তার খানিটা ছিটেফোঁটা:

নিহত জনক, এ্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ
আড়ালে বিলাপ করি একা একা, ক্ষুধার্ত পিতা
তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক কারাটাও অপরাধ।
এমন কি হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি
নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়!

বছর  বছর আমরা নিয়মিত ১৫ আগস্টের জন্য শোক পালন করি। অথচ কবি দেখছেন তাঁর হত্যাকারিরা চারপাশে চেনাজগতের মধ্যে নির্বিঘ্নে ঘোরাঘুরি করছে। হত্যাকারীদের কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যে হত্যার কথা স্বীকারও করেছে। এই নির্মম ইতিহাস আর কষ্টের যন্ত্রণায় কাতর কবি লিখছেন:

যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ভোরে
মেলবো দু’চোখ দেখবো নিয়ত রৌদ্র-ছায়ার খেলা,
যতদিন পাবো বাতাসের চুমো দেখাবো তরুণ
হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করবো শোক।

মানুষের মনের অজান্তেই কেমন করে যেন মোহন বাগান কাঁটাবন হয়ে যায়! অতিথিরা কেবল হয়ে পড়ে মৃত অথবা শত্রু! আয়নায় নিজের মুখও পরিষ্কারদেখা যায় না- যেন ভাঙা আয়না। আস্থা আর নির্ভরতার জায়গা কমছে সারা পৃথিবীজুড়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মতো ব্যানারে ব্যানারে, কিংবা পোস্টারে, ফেস্টুনে লেখা কথাগুলো বাতাসে মেলাচ্ছে তাদের করুণ-ব্যর্থ সুর। মিথ্যার ডারিতে ভরে উঠছে পৃথিবী; বেঁচে থাকতেও যেন এক ধরনের ঘৃণা ধরেছে সজাগ মানুষের মনে! কেবল বমি বমি লাগে- ঘেন্নায়। জীবনানন্দের মতো, চারপাশের অশুভ নৃত্যপরতা দেখতে দেখতে, শামসুর রাহমানও গভীর গভীরতর এক অজানা অসুখে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছিলেন। জানাচ্ছেন সে কথা তিনি:

ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী
আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, গাছগাছালি
আর জানে ক্ষয়িষ্ণু স্বপ্নসম্ভব
আমার ঘরের চার দেয়াল। অসুস্থতা নেকড়ের মতো
চিবিয়ে খাচ্ছে আমার মেদমজ্জা।

অন্ধের দেশে কে দেবে অভয়? অথবা, কান পেতে থাকি দীপ্র কণ্ঠ শোনার আশায়,/ কাকের বাসায় ঈগলের গান কখনো যায় কি শোনা? প্রভৃতি কথামালায় কবি নির্মাণ করতে চান একটি পরিবারের, একটি জাতির দুর্দশার ভেতর থেকে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবার প্রবল প্রত্যয়। শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারেননি; তাবে তাঁর অগণিত ভক্ত পাঠক তা অবলোকন করেছে। যে মাটিতে জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছিল, সেই মাটিই তার দায় শোধ করেছে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঐতিহাসিক বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। মিথ ও জাতীয় ঐতিহ্যকে চেতনায় ধারণ করে কবি শামসুর রাহমান আমাদেরকে যে কথামালা শুনিয়েছেন, তা বিষয়-ভাবনা এবং পরিবেশনশৈলীর দিক থেকে সত্যিই চমৎপ্রদ এবং অভুতপূর্ব।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কলামিস্ট ও সাহিত্য-বিশ্লেষক