দার্শনিক জ্যঁ জ্যাকোয়া রুশোর একটি প্রেমের চিঠি

ভাষান্তর: আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২২

ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ জ্যাকোয়া রুশো ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে । রুশো ছিলেন প্রচণ্ড আবেগী। প্রচলিত নীতিধর্মের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। মাদাম দ্য ওয়ারেন্স এর সঙ্গে কিছুকাল বসবাস করেন রুশো। এরপর অরলিয়ন্স থেকে আসা থেরেসা নামের এক বালিকাকে দেখে মুগ্ধ হন রুশো। থেরেসাকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের পাঁচ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এরপর রুশো আকৃষ্ট হন কাউন্টেস দ্য মুদেতভ নামের সম্ভ্রান্ত এক রমণীর প্রতি। অথচ রুশো জানতেন, ওই রমণী তাকে মোটেও পাত্তা দেন না। মাবকুইস দ্য স্যঁ ল্যাম্বেয়া নামের এক পুরুষের প্রতি ছিল মুদেতভের আকর্ষণ। ১৭৫৭ সালের জুন মাসে মুদেতভকে লেখা রুশোর একটি চিঠি:

প্রিয়তমা, তুমি এসো। তোমার নিষ্ঠুর হৃদয়কে যন্ত্রণায় আমি পুড়িয়ে দিতে চাই। যেন আমার দিক থেকে আমিও তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হতে পারি। তোমাকে কেন ক্ষমা করব যখন তুমি আমার যুক্তি, মানসম্মান এমনকি জীবন পর্যন্ত অপহরণ করে বসে আছ? তোমার দিনগুলো কেন আমি শান্তিতে কাটাতে দেব যখন তুমি আমার দিন ও রাতকে দুঃসহ করে তুলেছ? হ্যাঁ, এই নিষ্ঠুর অবহেলার বদলে যদি তুমি আমার বুকে একটা ছুরি বসিয়ে দিতে, তাহলে সত্যিই তুমি খুবই কম নিষ্ঠুর হতে। দ্যাখো দ্যাখো, আমি কী ছিলাম আর এখন কী হয়েছি। দ্যখো, অধঃপতনের কোন স্তরে তুমি আমাকে ফেলে দিয়েছ! যখন তুমি আমার খুব আপনজন বলে অভিনয় করেছিলে, সেই সময়গুলোতে আমি ছিলাম সবার সেরা। আর এখন তোমার কাছ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আমি হয়েছি সবার চেয়ে ছোট। আজ আমি নিঃস্ব। যুক্তিতে, উপলব্ধিতে, শক্তি-সামর্থ সবদিক থেকেই আমি এখন নিঃস্ব। তুমি আমার সবকিছু হরণ করে নিয়ে গেছ। তোমার নিজের সৃষ্টিকে কি করে তুমি এভাবে বিনাশ করে দিলে? তোমার মাধুর্য দিয়ে যাকে একদিন পূর্ণ করে দিয়েছিলে, তাকেই আজ তুমি অযোগ্য বিবেচনা করলে কি ভেবে? যার জন্যে একদিন গর্ব করতে, তার জন্য আজ লজ্জিত হয়ো না। তোমার নিজের সম্মানের জন্যেই তোমার কাছে আমার দাবি, আমার সম্পর্কে তুমি কি ভাবো তা জানাও। আমি কি তোমার প্রেমাষ্পদ নই? তুমি কি আমার ভার গ্রহণ করোনি? তুমি কি তা অস্বীকার করতে পারো? আমরা চাই আর না-চাই, আমি যেহেতু তোমারই সেহেতু আমাকে তোমার যোগ্য হতে দাও। পালিয়ে যাওয়া সেইসব সুখের মুহূর্তগুলো স্মরণ করো, যা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। অদৃশ্য সেই আলো যা থেকে আমি আমার দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বেশি মূল্যবান জীবন পেয়েছিলাম, তা আমার হৃদয়ে আমার অঙ্গের অণু-পরমাণুতে এনেছিল যৌবনের দৃপ্ত শক্তি। আমার অনুভবের তীব্র আলো আমাকে তোমার কাছে তুলে ধরেছিল। তোমার হৃদয় যদিও অন্য তারে বাঁধা ছিল, তবুও তা কি আমার আবেগের তীব্রতায় গর্বিত হয়নি? তুমি কি প্রায়ই বলতে না, ‘আমি অনুভব করতে পারি, তুমি সবচেয়ে বেশি হৃদয়বান প্রেমিক। না, তোমার মতো করে কোনো পুরুষ কখনো ভালোবাসেনি।’ তোমার ঠোঁটের এই স্বীকৃতি আমার কত বড় বিজয় ঘোষণা করতো! হ্যাঁ, তা সত্যি। আমার আবেগে তোমাকে আমি জ্বালাতে চেয়েছিলাম।

প্রিয়তমা আমার, মধুময় এইসব মুহূর্ত জানার পর চির বিচ্ছেদের চিন্তা তার পক্ষে ভয়ংকর যে তোমার ভেতর বিলীন হতে না পারার চেতনায় কাতর। সত্যিই কি তোমার কোমল চোখ দুটো আমার দৃষ্টির সামনে আর কখনো সুমিষ্ট লজ্জায় নুয়ে পড়বে না, যা আমাকে কামনায় প্রায় পাগল করে তুলত? স্বর্গীয় সেই রোমাঞ্চে আর কি কখনো আমি পুলকিত হবো না? সেই পাগল করা, সর্বগ্রাসী, বিদ্যুতের চেয়েও তড়িৎগতির আগুনে পুড়ব না? প্রকাশের অতীত সেই মুহূর্ত কী দুর্লভ! কোন হৃদয় কোন ঈশ্বর তোমাকে পাবার পর স্থির থাকতে পারতো?