বরবাদ সিনেমার পোস্টার

বরবাদ সিনেমার পোস্টার

স্বাধীন খসরুর গদ্য ‘বরবাদ’

প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২৫

ছোটবেলা থেকে সিনেমার পোকা মাথায় ঢুকেছিল। তখন বিনোদন বলতে শুধুমাত্র রেডিওতে গান শুনা ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাড়ির কাছে বাংলাদেশের অতি পরিচিত জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড এবং চারপাশে চা বাগান। মাধবকুণ্ডে প্রায়ই বিজ্ঞাপন ও সিনেমার শুটিং লেগেই থাকত। স্কুল পালিয়ে শুটিং দেখতে যাওয়া এবং সিনেমা দেখতে যাওয়া অনিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর কাছাকাছি সিনেমা হল ছিল বড়লেখায় একটি, জুড়িতে একটি এবং কুলাউড়ায় দুটি, লিলি ও পূবালী।

বিশেষ দিনে টেলিভিশনে সিনেমা দেখাতো। যাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল তাদের বাসায় আগে থেকেই গিয়ে বসে থাকতাম সিনেমা দেখার জন্য। তখন মফস্বলে হাতেগোণা কয়েকজনের বাসায় টেলিভিশন ছিল। টেলিভিশনে আমার প্রথম দেখা সিনেমা যতদূর মনে পড়ে ‘যাদুর বাঁশি’। তা ছিল বড়লেখা থানার ওসির বাসায়। তত্কালীন ওসির ছেলে কামরুল আমার বন্ধু। তাই ওদের বাসায় যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।

তারপর বিশেষ করে হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে আমাদের কিছু সহপাঠীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। তা হলো বিভিন্ন টাউন বা শহরে গিয়ে কে কোন বড় বা নামিদামি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি। পরবর্তী সিনেমা না দেখা পর্যন্ত ঐ সিনেমার সংলাপ বা গান থাকতো আড্ডা বা আলোচনার মুখ্য বিষয়।

তখন মনে আছে, সিলেট রেডিওতে সকাল ৮.৩০টায় প্রচার হতো সিনেমার গান নিয়ে অনুষ্ঠান ‘ছায়াছন্দ’। ছায়াছন্দের শেষ গানটি শুনে স্কুলের জন্য বের হতাম। মাঝে মধ্যে দেরি হয়ে যেত স্কুলে পৌঁছাতে। ঢাকা রেডিওতে দুপুরে শুনার চেষ্টা করতাম বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে প্রিয় সিনেমা ভাষ্যকার নাজমুল হুসাইনের হাঁ ভাই...‌আসিতেছে...

সন্ধ্যায় শুনতাম সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’। কারণ বেশিরভাগই সিনেমার গানের অনুরোধ থাকতো। বলতে গেলে তখন বিভিন্ন ধরনের বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা আর সিনেমা ছিল আমার ভাবনার জগৎকে আরও প্রসারিত করা, আরো শাণিত করার মাধ্যম। ভাবার জন্য ভাবনার জগৎকে তৈরি করা। সমাজের অসংগতি ও ইতিবাচক, নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করা। তখন সিনেমাকে বলা হতো বই। নতুন কোন বই দেখেছো বা নতুন কোন বই এসেছে?

ঐ সময় আরেকটা বিষয় ছিল যে, সিনেমা দেখা হলো ভালো লাগলে নাম, কারা অভিনয় করেছেন এবং সিনেমার ভালো লাগা গানের কথা লিখে রাখতাম। তারপর সময়ের বিবর্তনে দেশের বাইরে মা-বাবার সাথে ইংল্যান্ড চলে আসা। সময়ের পরিবর্তন, জায়গার পরিবর্তন, ভাবনার পরিবর্তন, দেখার পরিবর্তন। অভিনয় শিখে অভিনয়ের সাথে যুক্ত হওয়া, নাটক সিনেমায় অভিনয় করা। সিনেমা প্রোযোজনা করা, দেশের বাইরে আমাদের সিনেমা প্রোমোট করা আজ অবধি চলছে।

Revery Films এর ব্যানারে এই মুহূর্তে ইউকে ইলফোর্ড সিনেওয়াল্ডে তৃতীয় সপ্তাহ চলছে মেহেদী হাসান হৃদয় পরিচালিত বাংলাদেশে বর্তমানে একমাত্র ম্যাগাস্টার শাকিব খান অভিনীত সিনেমা ‘বরবাদ’। এখন পর্যন্ত আমার দেখা বাংলাদেশের বাংলা সিনেমার মধ্যে সর্বকালের Trendi, গতি ধরে রাখা, হালফ্যাশন নির্ভর একটা সিনেমার কথা যদি বলি তাহলে বলবো নির্মাতা এস এম শফির The Rain। প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওয়াসিম ও অলিভিয়া। সিনেমাটি বিশ্বের অনেক দেশে বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং করে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।

আর ‘বরবাদ’ দেখার পর বলতেই পারি দ্বিতীয় বাংলাদেশি হালফ্যাশন নির্ভর এসময়ের সবচেয়ে ট্রেন্ডি বাণিজ্যিক সিনেমা ‘বরবাদ’। এ পর্যন্ত শাকিব খান যত সিনেমা করেছেন ঢালিউড ও টালিউডে তার মধ্যে এ সিনেমা ব্যতিক্রম। তার লুক, হেয়ার স্টাইল, পোশাক সম্পূর্ণ আলাদা, চিত্তাকর্ষক Impressive। বিশেষ করে তার লুক অন্য যতগুলো সিনেমা করেছেন তার থেকে ভিন্ন, সম্পুর্ণরুপে নয়নাভিরাম। বুঝাই যায় যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছেন GYM য়ে। তৈরি করেছেন নিজেকে চরিত্রের প্রয়োজনে।

বাংলা সিনেমায় প্রথমবার দেখলাম একজন ড্রাগ এডিকটেডের চরিত্রে শাকিব খান যথেষ্ট নিখুঁত অভিনয় করেছেন। নিখুঁত এজন্য বলছি এখানে দেখানো হয়েছে সব A class ড্রাগস সেবন। এ ধরনের ড্রাগস সেবনের পরে যখন পুরোপুরি আচ্ছন্ন তখনকার শারীরিক অবস্থা ও অঙ্গভঙ্গি ছিল যথার্থ। কারণ এ ধরনের ড্রাগস সেবনের অভ্যাস না থাকলে প্রয়োজন হয় একজন পেশাদার এডভাইজারের। আমার ধারণা, নিশ্চয়ই একজন ড্রাগস বিশেষজ্ঞ ছিলেন ইউনিটে। তা না-হলে এভাবে সম্ভব হতো না।

সিনেমার প্রত্যেকটি গান শ্রুতি মধুর, সুন্দর চিত্রায়ণ। বিশেষ করে ‘আয়রে আয় চাঁদ মামা চিমটি দিয়া যারে’ গানটি বর্তমান সময়ের সবচাইতে বেশি ভাইরাল গান। কমবয়সী থেকে শুরু করে সব বয়সীদের মধ্যে আবেদন তৈরি করতে পেরেছে। গানটি কি পরিমাণ সাড়া ফেলেছে তা বুঝা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও চিত্র আর ট্রল দেখে। সিনেমার আরেকটি গ্রহণযোগ্য প্রশংসনীয় দিক ছোট চরিত্রে ভালো ভালো অভিনয় শিল্পী নির্বাচন। এ দিকটা বাংলাদেশে সব সময় উপেক্ষিত ছিল, ছোট চরিত্রে বাছ বিচার না করে যে কাউকে দাঁড় করিয়ে দেয়াই নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলা সিনেমা অযথা, অযাচিত সংলাপ নির্ভর ছিল। পেছনের পৃষ্ঠা, বর্তমান পৃষ্ঠা, শেষের পৃষ্ঠা... সংলাপ! অতি নাটকীয়তা, ন্যাকামি ছাড়া চলতোই না। তার থেকে ‘বরবাদ’ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী বলা চলে। অনেক দৃশ্য আছে সংলাপ তেমন নেই বললে চলে। অ্যাকশন দৃশ্যে অযথা চিৎকার চেঁচামেচিসহ কোনো অযাচিত সংলাপ নেই। ‘বরবাদ’ সিনেমাকে সংলাপ নির্ভর সিনেমা না বলে কম সংলাপের সিনেমা বলা যাবে। এর সাথে অনেক দিন পর বাংলা সিনেমার সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফিরছে। যেমন ‘এ জিল্লু মাল দে।’

আরিয়ান মির্জা, আদিব মির্জা ও জিল্লু চরিত্রে যথাক্রমে শাকিব খান, মিশা সওদাগর ও শ্যাম ভট্টাচার্য অনবদ্য। মামা চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মামুনুর রশীদ, ফারহান চরিত্রে যিশু সেনগুপ্ত, মন্ত্রীর ছোট ছেলে, বাবা চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু এবং উকিল চরিত্রে শহিদুজ্জামান সেলিম যথার্থ। আরিয়ানের মায়ের চরিত্রে করভী মিজানকে অহেতুক অযাচিত মনে হয়েছে। এ চরিত্রের উপস্থিতি কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি সিনেমায়। আইটেম গানে নুসরাতকে ভালো লেগেছে, নীতু চরিত্রে ইধিকা পাল মানানসই।

চোখে লেগেছে মুখে প্রস্রাব করার দৃশ্য এবং বান্ধবীর মায়ের সাথে ফারহানের দৃশ্য। একটু বেশি মনে হয়েছে, হয়তো দৃশ্যগুলো অন্যভাবে চিত্রায়ন করা যেত। সিনেমার সার্টিফিকেশন ১৮ তাতে কোনো সমস্যা নেই। পুরো সিনেমায় আরিয়ানের সংলাপের ভাষা কানে লেগেছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাষা আর আরিয়ানের ভাষা ভিন্ন।

যদিও জানি, বখে যাওয়া ড্রাগ অ্যাডিক্ট বা কর্পোরেট শিল্পপতিদের অতি আদরের সন্তান অনেক সময় এরকম সান্ডা, সাইকো হয়। সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য, মিলিয়নেয়ার্স পার্টি (কোটিপতি ও মন্ত্রী পাড়ার পার্টি), কর্পোরেট ধনীদের বাড়ি বা প্রাসাদ, লোকেশন সবকিছু ছিল যথার্থ। আগে সব সময় এদিকটা ছিল অবহেলিত, নেয়া হতো ধোঁকাবাজির আশ্রয়, সিনেমার ভাষায় চিটিং। বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে সংগীত, মেকআপ, পোশাক ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে দক্ষতার পরিচয় দৃশ্যমান।

পরিশেষে অবশ্যই বলা যায়, ‘বরবাদ’ একটি বিনোদন পূর্ণ এসময়ের সফল বাণিজ্যিক আধুনিক বাংলা সিনেমা। অভিনন্দন জানাই সিনেমার প্রযোজক সুমি এবং সফল নির্মাতা মেহেদী হাসান হৃদয়কে। জয় হোক বাংলা সিনেমার।

৩ জুন ২০২৫
লন্ডন