
প্রতীকী ছবি
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ৩৩
প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২৫
নবীনগরে সফল অনুষ্ঠান করে কনকের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ঢাকায় এসে অনুপ্রাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়। এরই মধ্যে দৈনিক নব-অভিযান পত্রিকা অনুপ্রাসকে একটি পাতা দিয়ে দেয়, সেই পাতাজুড়ে অনুপ্রাসের সদস্যদের কবিতা ছাপা হয়। নব-অভিযানের সাহিত্য সম্পাদক কবি শেখ শামসুল হক, তিনিই মূলত অনুপ্রাসের প্রধান সংগঠক। সামসু ভাইয়ের চেষ্টাতেই আমরা পাতাটি পাই। অনুপ্রাসের সাহিত্য পাতা দেখার দায়িত্ব পান কবি আমিনুল হক আনওয়ার, তাকে সহযোগিতা করি আমি, সাঈদ আখন্দ এবং আরও কয়েকজন।
প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে আমরা শান্তিবাগে অবস্থিত নব-অভিযান পত্রিকার অফিসে যাই। অনুপ্রাস পাতার জন্য কবিতা বাছাই, মেকাপ ইত্যাদি করার পাশাপাশি সাংগঠনিক অনেক কাজই সেখানে হয়, সেই সঙ্গে তুমুল একটা সাহিত্য-আড্ডাও হয়ে যায়। আস্তে আস্তে শান্তিবাগের ওই বিল্ডিংটি হয়ে ওঠে অনুপ্রাসের মূল কার্যালয়। কনকও প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে ওখানে চলে আসে।
এক বৃহস্পতিবার সকালে কনক আমার বাসায় আসে। আমরা নগর বিহারে বেরিয়ে পড়ি। মহাখালী, বনানী, ফার্মগেইট, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, ইত্তেফাক ভবন, মতিঝিলের এলাহী চেম্বার এইসব জায়গাগুলোতে আমরা তখনকার দিনে ঘোরাঘুরি করতাম। খিদে পেলেই খুঁজতাম আশপাশে কোনো আত্মীয় বা চেনা-জানা কেউ আছে কিনা। মতিঝিলের এলাহী চেম্বারে কনকের চাচাতো ভাই রতন চাকরি করতেন, তার ওখানে গেলে তিনি আমাদের খাওয়াতেন। সেদিন আমি কনককে নিয়ে যাই ঠাঁটারি বাজারে, মনিরদের বাসায়।
মনির ও কনক দুজন দুজনকে অপছন্দ করত, ওরা ঝগড়া করত না কিন্তু দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলত। এর মূল কারণ আমি। মনিরের সঙ্গে যখন আমার ঘনিষ্ঠকাল চলত তখন কনক দূরে সরে যেত আবার কনকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে মনির দূরে সরে যেত। এটাই ছিল ওদের দ্বন্দ্বের কারণ।
দুপুরে দাদির হাতের রান্না খেয়ে আমরা তিনজন ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছি। তখন এক যুবক দোতলায় উঠে আসেন। যুবকের নাম হুমায়ূন। মনির তাকে হুমায়ূন ভাই বলে ডাকছে, কাজেই সেই সূত্রে তিনি আমাদের মামা স্থানীয়। এক দুই কথায় জেনে যাই তিনি আমার মেজো মামার সামসময়িক এবং তারা পরস্পরের পরিচিত। হুমায়ূনের বাড়ি রতনপুর গ্রামে। তিনি ইউএনডিপিতে চাকরি করেন। কথাটা শুনে আমি তার প্রতি আগ্রহী হই।
আপনি জাহাঙ্গীর নানাকে চেনেন?
ইডা কী কও? হিলা আমার মামা অয় না।
ও।
তুমি বখতিয়ার মামারে চিনো নি?
চিনি না, নাম শুনেছি। জাহাঙ্গীর নানার ছোটো ভাই।
হ।
আমি তো আপনাদের অফিসে যাই।
কার কাছে যাও।
জাহাঙ্গীর নানার কাছে।
হেইডা আমার অফিস না। আমি চাকরি করি জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্রে, দুইটা বিল্ডিং পরে।
কি চাকরি করেন আপনে?
করি ছুডুখাডো একটা। কওন যাই তো না। একদিন আইয়ো আমরার অফিসো। বখতিয়ার মামার লগে তোমার পরিচয় ঐছে নি?
না, হয় নাই।
কও কি? ইলাঐদ্দো আসল মানুষ। অনেক বড় অফিসার। একদিন আইয়ো, তুমারে ইলার কাছে নিয়া যামু।
আমি বোকার মতো একটা প্রশ্ন করি হুমায়ূন মামাকে। বড় অফিসার হৈতে কী যোগ্যতা লাগে? এম, এ পাশ?
হিডা দো লাগেঐ। আর ভালো ইংরেজি জানা লাগে।
আপনার বখতিয়ার মামা কি ভালো ইংরেজি জানেন?
কও কী তুমি ভাইগ্না। বখতিমার মামা আইট্টা গেলে জুতার তলাথ্যাইক্কা ইংরাজি আওয়াজ বাইর অয়।
বলেন কী?
বিশ্বাস অয় না? হিলারে দেখলেঐ বুঝবা।
এরপরের মাসে আমি যখন জাহাঙ্গীর নানার কাছে টাকা আনতে যাই তখন ঠিকানা খুঁজে জাতিসংঘ তথ্য কেন্দ্রের অফিসে ঢুকে পড়ি। ঢুকেই দেখি হুমায়ূন মামা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। তিনি আমাকে দেখে দিগন্ত বিস্তৃত একটা হাসি দিয়ে বলেন, বাদল, আইছো। আসো।
এরপর আমাকে একটি লাইব্রেরিতে বসিয়ে রেখে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। তার অনুপস্থিতিতে আমি বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করি। মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দেই এমন একটি শান্তির ও জ্ঞানের জগতে আমাকে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফিরে এসে বলেন, বাদল, আইয়ো। বখতিয়ার মামারে তোমার কথা কইছি। তার অফিসঘরে তোমারে নিয়া যাইতাম কৈছে।
আমি হুমায়ূন মামার সঙ্গে তথ্য কর্মকর্তা কাজী আলী রেজার অফিসে ঢুকি। তিনি আমাকে যথেষ্ঠ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন। তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ইউএন ডেটলাইন আমাকে নিয়মিত পাঠানোর জন্য ঠিকানা নেন এবং জাতিসংঘের ঢাকা অফিস থেকে প্রকাশিত নানান রকম বই, ম্যাগাজিন উপহার দেন।
আমি কবিতা লিখি জেনে খুব খুশি হন এবং দেশের অনেক প্রধান কবির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে তা জানান। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল আমি আমার একজন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছি। পরবর্তী জীবনে নানান বিষয়ে রেজা ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করেছি, তিনি সব সময় আমাকে সুপরামর্শ দিয়েছেন। হুমায়ূন মামাকে তিনিই চাকরি দিয়েছিলেন একজন ম্যাসেঞ্জার হিসেবে তবে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী চাকরি। কয়েক মাস পরেই তার চাকরির চুক্তি শেষ হয়ে যায়।
বখতিয়ার ভাইকে আমি প্রথম দিন থেকেই নানা না ডেকে ভাই ডাকি। কারণ তিনি বয়সে তরুণ, উচ্চশিক্ষিত, সুদর্শন এবং ভীষণ বন্ধুবৎসল। জাতিসংঘের একজন অফিসার কতটা চৌকষ হতে পারে তা বখতিয়ার ভাইকে দেখে শিখেছি। পরবর্তী জীবনে এতোটা স্মার্ট আর কোনো বাঙালি অফিসার দেখিনি। শুধু দেখতেই তিনি স্মার্ট নন, যে কোনো বিষয়ে খুব গুছিয়ে এবং গ্রহণযোগ্য করে কথাও বলতে পারেন। বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই তারা অসামান্য দখল। তাকে ভাই ডাকতে ডাকতে জাহাঙ্গীর নানাকেও জাহাঙ্গীর ভাই ডাকতে শুরু করি।
যেহেতু কনক আর আমি ঢাকা শহর চষে বেড়াই, একদিন কনককেও বখতিয়ার ভাইয়ের অফিসে নিয়ে যাই। তবে তার সঙ্গে কনকের কেমিস্ট্রি মেলেনি। প্রমিত উচ্চারণে জ্ঞানের কথা, বিশ্ব পরিস্থিতির কথা, নানান বিষয়ের তাত্বিক মতবাদ ও সেসবের বিশ্লেষণ, এইরকম আলাপে কনক সুবিধা করতে পারেনি বলেই এই অফিসগুলোতে আমার সঙ্গে যাওয়ার তেমন কোনো আগ্রহ দেখাত না। চলবে