বাউল আবুল সরকারের প্রশ্নের উত্তর

কাজী জহিরুল ইসলাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৬, ২০২৫

বাংলাদেশের মানুষ কি বাউল সঙ্গীতের বিরুদ্ধে? মোটেও নয়। আউল, বাউল, সুফি, সাধকের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ আফগানিস্তান, পাকিস্তান বা ইরানের মতো উগ্র ধার্মিক নয়। গত বছর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরে যখন দেশে অরাজকতা তৈরির জন্য একদল মানুষ মন্দির ভাঙার পাঁয়তারা করেছিল তখন এদেশের ধার্মিক মুসলমানেরা মন্দির পাহারা দিয়ে হিন্দু ধর্মের সম্ভ্রম রক্ষা করেছে।

 

বাংলাদেশের মানুষ মূলত শান্তিপ্রিয়, নিরীহ প্রকৃতির। তারা যেচে পড়ে অন্যের অনিষ্ট করতে যায় না। তবে একটি বৃহৎ ও অল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দেশে একদল মানুষ থাকা খুবই স্বাভাবিক যারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ায়। তৌহিদি জনতার নামে এমন কিছু অসংঘবদ্ধ মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে, এর মধ্যে মাজার ভাঙার ঘটনাগুলো অন্যতম।

 

সম্প্রতি মানিকগঞ্জের এক গানের অনুষ্ঠান থেকে বাউল আবুল সরকারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আমি মনে করি, এই গ্রেফতার দুটি কারণে সঠিক ছিল। প্রথমত তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। সম্ভবত এর আগে আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছে, এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য এই ধরনের অপমান মেনে নেওয়া কঠিন।

 

এরপরও কেউ একজন তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেছে। এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ। এই রকম ঘটনায় পৃথিবীর বহু দেশে খুনোখুনি, জ্বালাও পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। কেউ আবুল সরকারকে আক্রমণ করতে যে আসেনি, এতেই বরং আমাদের অবাক হতে হয়, বাঙালি মুসলমানদের শুভবুদ্ধির তারিফ করতে হয়। বাঙালি মুসলমান কবে থেকে এতটা সভ্য হয়ে গেল!

 

পুলিশ তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করেছে, এটাও একটি ইতিবাচক ঘটনা। কারণ তিনি মূলত একটি বিশাল মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছেন। মৌমাছির কামড় তার কপালে অবধারিত ছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে `গ্রেফতার` ছিল তার নিরাপত্তা। ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য বিভাগে দাউদ হায়দারের লেখা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ কবিতাটি ছাপা হয়।

 

সেই কবিতায় তিনি নবি মুহাম্মদকে (সা.) গালি দেন। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ক্ষিপ্ত হলে দাউদ হায়দারের প্রাণ রক্ষার্থে সরকার তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে এবং পরবর্তীতে, ২১ মে তারিখে, তাকে ভারতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। আমি মনে করি, আবুল সরকারকেও সরকার নিরাপত্তা দিতেই পুলিশ হেফাজতে নিয়ে গেছে এবং নিরাপদ বোধ করলেই তাকে মুক্তি দেবে।

 

আসুন এবার একটু জেনে নেই তিনি কি বলেছিলেন। আল্লাহর ওপর কেন আস্থা রাখা যাবে না তার যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, আল্লাহ প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন তা চারবার বলেছেন এবং চারবার চারটি জিনিসের নাম বলেছেন। একবার বলেছেন, `আওয়ালুমা খালাকুল্লাহে এশক` প্রথম সৃষ্টি আমার এশক, আবার বলেন প্রথম সৃষ্টি আমার আরশ, আবার বলেন প্রথম সৃষ্টি নূর, আবার বলেন, `আওয়ালুমা খালাকুল্লাহে রুহ`, প্রথম সৃষ্টি আমার রুহ।

 

আবুল সরকার আল্লাহকে মিথ্যাবাদী হিসেবে সমবেত দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন এবং খুব আপত্তিকরভাবে হাসতে হাসতে বলেন, "এক মুখে যে দুই কথা কয় তারে মুখ কয় না হুগ কয়?" এভাবে তিনি আল্লাহকে নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করেন যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মেনে নিতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি, আবুল সরকার ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন, হয়তো এই বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞান থেকে থাকবে।

 

তিনি হয়তো হালকা রসিকতা করে দর্শকদের আনন্দ দিতেই চেয়েছিলেন। তবে তিনি যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন তার একটি সুন্দর জবাব আছে, উপস্থিত দর্শকদের কেউ সেই জবাবটি দিয়ে দিলেই হয়তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারত। আল্লাহ যদি ৪টি জিনিসের নাম প্রথম সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন সেটিও নির্ভুল হওয়া অসম্ভব নয়।

 

আমরা একথা জানি আল্লাহ `কুন` মানে `হও` বললেই, `ফায়াকুন` মানে `হয়ে যায়`। আল্লাহ তো চাইলে এক সঙ্গেই, এবং সর্বপ্রথম, এই চারটি জিনিস, এমন কী আরও অসংখ্য জিনিস, তৈরি করতে পারেন। তাহলে তো চারটিই প্রথম সৃষ্টি হতে পারে। এটা নিয়ে আবুল সরকারের এত বিভ্রান্তি থাকার তো কোনো কারণ নেই।

 

আবুল সরকারকে গ্রেফতার করার সঙ্গে বাউল সঙ্গীতের বিরুদ্ধে সরকারের বা বাংলাদেশের মানুষের অবস্থানকে মিলিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই। তিনি একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দিয়েছেন, তাই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এইরকম বক্তব্য একজন মওলানা দিলে তাকেও হয়তো একই পরিণতি ভোগ করতে হতো।

 

বিষয়টি ব্যক্তিগত অপরাধ, গোষ্ঠীগত কোনো বিষয় নয়। তবে দেশের মানুষ যদি আরও শিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন হয়তো এইরকম বক্তব্যের কারণে আর নিরাপত্তাজনিত গ্রেফতার করারও প্রয়োজন হবে না। কারণ একজন মানুষ আল্লাহকে গালি দিলেই আল্লাহ ছোটো হয়ে যায় না। যারা আল্লাহর বিশালত্বে বিশ্বাস করে তারা ওই লোকটিকে পাগল বলে একটু মুচকি হাসবে, এমন কী পাগলকে গালমন্দও করবে না।

 

সমাজের সামষ্টিক জ্ঞানের স্তর সেই জায়গায় নিশ্চয়ই একদিন পৌঁছবে। ৩০ বছর আগে এই ঘটনা ঘটলে মানুষ পুলিশে খবর না দিয়ে তাকে আক্রমণ করতো, এখন আক্রমণ না করে পুলিশে খবর দিয়েছে, এটি নিশ্চয়ই সমাজের এক ধাপ অগ্রসর হওয়ারই প্রতিফলন। যদিও অল্প কিছুদিন আগেই আমরা কবর থেকে মৃতদেহ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা দেখেছি, রাজপথে পাথর দিয়ে থেতলে মানুষ মারতে দেখেছি।

 

এই পরস্পর বিপরীতমুখি ঘটনাগুলো দেখে আমরা বিভ্রান্ত হলেও এটিই বিশ্বাস করতে চাই, মোটের ওপর সমাজ আস্তে ধীরে হলেও এগুচ্ছে।

 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক