
সাংবাদিকতার গহীনের আখ্যান রাশেদ মেহেদীর ‘দ্য জার্নালিস্ট’
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : আগস্ট ০২, ২০২৫
আজকের কর্পোরেট দুনিয়ায় একজন সাংবাদিক যেন এই যুগের রানার। যে কিনা সকল মানুষের জন্য খবরের বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-প্রেম, স্মৃতি, আবেগ কিংবা শোকের বার্তা নিয়ে সেই যুগের ছুটে চলা রানারের মনের খবর জানতে পারতো কেবল পথের তৃণ। কিন্তু কর্পোরেট শৃঙ্খলে আবদ্ধ আজকের সাংবাদিকের মনের খবর কেউ রাখে না। যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকের জীবন আবর্তিত হয়, তাকে যে কর্মপরিবেশে নতজানু হয়ে কাজ করতে হয়, সেসব বিষয় বিস্তারিত উঠে আসে না কোনো প্রবন্ধে কিংবা গবেষণায়।
আমাদের কথাসাহিত্য নানা বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। দেশের মেধাবী কথাসাহিত্যিকরা তাদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন বিবিধ বিষয়ে। কিন্তু দুঃখজনক যে, সেসব কথাসাহিত্যে সংবাদকর্মীর সুখ-দুঃখ আনন্দ-অনুভূতির ভাষাচিত্র তেমনভাবে কেউ আঁকেননি। অথচ এ বিষয়ে কথাসাহিত্যে চরিত্র সৃষ্টির সুযোগ ছিল। প্রবন্ধ কিংবা গবেষণায় খটোমটো শব্দের বুননে সংবাদকর্মীর অন্তর্হনের আনন্দ-বেদনা প্রকাশের চাইতে কথাসাহিত্যে চরিত্রের ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ করলে পাঠকের সহানুভূতি সহজেই অর্জিত হয়। সেই চেষ্টাই করেছেন কথাসাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী তার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘দ্য জার্নালিস্ট’য়ে।
সাংবাদিকদের সবসময়ই ভাবা হয় ক্ষমতাধর। অথচ বাস্তবতা হলো, পারিপার্শ্বিক হিসাব-নিকাশের শৃঙ্খলে আবদ্ধ সাংবাদিকের অক্ষমতার কথা মুখ ফুটে কেউ বলে না। সাংবাদিক কিসের পাওয়ারফুল? কোথায় পাওয়ার? এই দেশে একজন চিকিৎসক মার খেলে দেশজুড়ে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ার মার খেলে কনস্ট্রাকশন কাজ বন্ধ হয়। আইনজীবী মার খেলে কোর্ট-কাচারি অচল হয়। গাড়ির ড্রাইভার মার খেলে রাস্তা গাড়িশূন্য হয় যায়। অথচ সাংবাদিক মার খেলে কিছুই হয় না। এই বাস্তবতা নির্মম, সন্দেহ নেই। আরসব পেশার মানুষের চেয়ে সাংবাদিকের ওপর হামলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কারণ, হাজারও মিথ্যার ভেতর থেকে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে জাতির সামনে উপস্থান করেন সাংবাদিক। কাজটি দুঃসাহসিক, এরপরও এই দুঃসাহসের জন্য সমাজের কেউ সাংবাদিককে বাহবা দেয় না। বলা চলে, সমাজের উপেক্ষার দৃষ্টি সবসময় সাংবাদিকের ওপর তাক করা থাকে।
আবার এমনও দেখা যায়, সাংবাদিকতার আড়ালে কিছু মানুষ প্রতিমুহূর্তে ঘটিয়ে চলে নানা অপকর্ম। অথচ সমাজের উপরিতলে তারা সাংবাদিকের মুখোশ পরে থাকে। মূলত এসব বিষয় চরিত্রের ভেতর দিয়ে শব্দচিত্রে এঁকেছেন রাশেদ মেহেদী। তার কৃতিত্ব হচ্ছে, এই কাহিনি নির্মাণে তিনি গতানুগতিক কথাসাহিত্যের কাহিনি-বিন্যাসকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করেননি। ‘দ্য জার্নালিস্ট’ পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে, গল্পের ভেতরে বসে নয়, কেউ যেন ওপর থেকে আলো ফেলে দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের কর্মপরিবেশ, কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি, পেশাদার সাংবাদিকের টিকে থাকার লড়াই, জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ এবং মফস্বলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংবাদিকতা করার কায়দা-কানুন।
উপন্যাসটির গল্প শুরু হয় খ্যাতনামা সাংবাদিক, একটি টেলিভিশন স্টেশনের হেড অব নিউজ সুমিত হককে নিয়ে। কে বা কারা একটি ন্যুড ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে। ধারণা করা হলো, ভিডিওতে যাকে দেখা যাচ্ছে তিনিই সুমিত। ঘটনা এমন পর্যায়ে গড়াল যে, শুধু টেলিভিশনের হেড অব নিউজের পদ নয়, দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তও নিতে হলো তাকে। সেই চাঞ্চল্যের মধ্যেই খুন হলেন একটি জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধি রূপালি বণিক। সেই হত্যাকাণ্ডের ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে ঘটনাস্থলে পাঠানো হলো সুমিতের সহকর্মী তুখোর সাংবাদিক কল্যাণ কবীরকে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রূপালী বণিক খুনের তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করলেন কল্যাণ কবীর। কিন্তু সেই প্রতিবেদন সুমিতের অসহযোগিতায় আর আলোর মুখ দেখল না। আপসহীন সাংবাদিক কল্যাণকে শেষপর্যন্ত উঁচু পাহাড়ের গভীর খাদের সামনে দাঁড়াতে হলো। পাহাড়ের চূড়া থেকে কল্যাণ কবীর নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা কক্ষে আবার হাসিমুখে এসে দাঁড়াতে দেখা গেল সুমিত হককে।
উপন্যাসের কাহিনিপ্রবাহ কেবল সুমিত আর কল্যাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ যেন এক বহুমাত্রিক ও সমান্তরাল কাহিনিজট। কাহিনির বিষয় হিসেবে একদিকে পাঠক দেখতে পাবেন টেলিভিশন স্টেশনের সহকর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও রেষারেষি, মালিকের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্ক, মফস্বল সাংবাদিকতার ঝুঁকি আর এর পেছনের রাজনৈতিক পটভূমি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ; আরেক দিকে উঠে এসেছে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া সাংবাদিক নামের কিছু সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের কনটেন্ট ক্রিয়েটরের কথা, ডিপ ফেইক ভিডিও বানিয়ে একটা শ্রেণি কিভাবে মানুষকে বিপন্ন করে তুলছে।
উপন্যাসটির গভীরে গেলে জানা যাবে কেন একজন পেশাদার ও স্বনামধন্য সাংবাদিক নিজের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে আর ভোটে জিততে অপেশাদার ও ভুঁইফোড় সাংবাদিকদের দরজায় ধরনা ধরেন, কিভাবে একজন সাংবাদিকের ভাগ্য তার কাজের ওপরে ভিত্তি করে নয় বরং অফিসের বাইরে কোনো মদের আড্ডার টেবিলে নির্ধারিত হয়। জানা যাবে, কেন কল্যাণরা নিরুদ্দেশ হয় আর সুমিতরা বারবার প্রবল ক্ষমতা নিয়ে ফিরে আসে, কেন রূপালি বণিকরা খুন হয় আর সুমিতরা শেষপর্যন্ত আপোস করে টিকে থাকে। সাংবাদিকতা নিয়ে যাদের মনে নানা জিজ্ঞাসা, তাদের সব প্রশ্নের খোরাক রয়েছে ‘দ্য জার্নালিস্ট’ এ।
তবে পাঠক হিসেবে পড়তে গেলে উপন্যাসের যে রস সেখানে কিছুটা ঘাটতি পেতে পারেন অনেকে। সমস্ত বিষয়টা যেন দেখা হয়েছে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের চোখে, প্রতিটি ঘটনা লেখা হয়েছে সংবাদের আদলে। এখানে আবেগের চেয়ে বাস্তবতার কঠিন-কঠোর শব্দের আনাগোনা বেশি। একজন সাংবাদিকের বিপদে পড়ার গল্প আছে, কিন্তু সেখানে বাড়তি আবেগের হাহাকার নেই। দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে একজন সাংবাদিক যেমন সংবাদ প্রতিবেদনের মতোই কাটখোট্টা হয়ে দাঁড়ায়, উপন্যাসের কাহিনির আবর্তনও সেভাবেই এগিয়েছে। কিন্তু সর্বোপরি সাংবাদিকতা জগতের গহীনের যে কালো দিকগুলোর ওপরে আলো ফেলেছেন রাশেদ মেহেদী, সেই দিকগুলো সাধারণ মানুষের জানার বাইরের অন্য আরেক জগৎ। এই জগৎকে বুঝতে হলে পড়তে হবে ‘দ্য জার্নালিস্ট’।
১১০ পৃষ্ঠার ‘দ্য জার্নালিস্ট’ উপন্যাসটি ২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদশিল্পী সোহানুর রহমান অনন্ত। প্রকাশক: অক্ষর প্রকাশনী। উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয়েছে সাংবাদিকতার বাতিঘর হিসেবে খ্যাত দুই সাংবাদিক তোয়াব খান ও গোলাম সারওয়ারকে।
রাশেদ মেহেদী সম্পর্কে
রাশেদ মেহেদী স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার ছোটগল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘গনি আদমের ক্যাম্পাস’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসটি পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। এরপর প্রকাশিত হয় আরও দুটি উপন্যাস ‘রাজপথের মহাকাব্য’ ও ‘কংক্রিটের কালোবিড়াল’।
অনলাইন সাহিত্য সাময়িকী লিটবাংলায় litbangla.com তার লেখা বাংলায় প্রথম সাইবার পাঙ্ক থ্রিলার ‘থ্রি চিয়ার্সমেটাভার্স’ প্রকাশিত হয়। পিডিএফ ফরমেটে তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ফেসবুকে দেখি চাঁদ’ ২০২৪ সালে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তিনি দেশের প্রথম রিয়েল টাইম বাইলিংঙ্গুয়াল (বাংলা-ইংরেজি) ভিউজ পোর্টাল ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ www.viewsbangladesh.com এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, একুশে টেলিভিশন ও সমকালে কাজ করেন।