ইরফান শেখের গদ্য ‘পুরান বই বাজারের ফিরিস্তি’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২৫
জাহানারা ইমামের বই আনিসুজ্জামানও বিক্রি করেন নাই, মোহাম্মদ আজমও বিক্রি করেন নাই। এসব চোরাই বইয়ের ক্রেতা আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করেন।
বাংলাদেশে পুরাতন বই বিক্রি হয় নীলক্ষেতে। কোভিড মহামারির পর নীলক্ষেতের ডিজিটাইজেশন হয়। টিকে থাকার জন্য প্রথমবারের মতো পুরানো বইয়ের বিক্রেতারা অনলাইনে আসে। নীলক্ষেতে যারা পুরনো বই কিনতে যেত তারা ছিল নির্দিষ্ট ঢাকা দক্ষিণ এলাকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাসিন্দা। এদের জনসংখ্যা ৩-৫ লাখের বেশি হবে না। কিন্তু মহামারির পর এই দোকানগুলো অনলাইন হলে ক্রেতা রাতারাতি ৫ লাখ থেকে বেড়ে ৫ কোটিতে ঠ্যাকে।
অনলাইন মার্কেটে কোনো ব্যারিয়ার নেই। যশোরের নিশিমনি থেকে শুরু করে উত্তরার পদ্মলোচনের কাছে প্রথমবারের মতো পুরানো বইয়ের বাজার উন্মুক্ত হয়। চাহিদা বেশি, যোগান কম। পুরান বইয়ের দাম যায় বেড়ে। অন্তত ৭ থেকে ৮ গুণ। এত বেশি বাড়ে যে, নতুন ও পুরাতন বইয়ের মাঝে ব্যবধান দাঁড়ায় বড়জোর ৫০ টাকা।
এত বড় প্রাইজ রেঞ্জে নতুন এক শ্রেণির ক্রেতার আমদানি হয় যারা বেছে বেছে প্রাচীন বইপত্র খোঁজে। মানে, বইয়ের বয়স ১০০ বছর বা তার বেশি হলে অতিরিক্ত দাম দিতে শুরু করে। বইতে যদি আবার রবীন্দ্রনাথ বা শেখ মুজিবের স্বাক্ষর থাকে তাহলে তো কথাই নেই! দাম বেড়ে হয় ২০ হাজার টাকা।
নীলক্ষেতের পুরনো বই ব্যবসায়ীরা এতসব বোঝে না। তারা লেখক, সময়, এডিশন, কোনটার কত দাম, এসব বোঝে না। তারা সাহায্যের জন্য শিক্ষিত বেকার যুবকদের শরণাপন্ন হয়। ২ বছরের মধ্যে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা উনাদের সাহায্য করতে গিয়ে, উনাদেরকেই মার্কেট থেকে রিপ্লেস করে। যে কারণে আপনি নীলক্ষেতে গিয়ে এখন আর লুঙ্গি মুস্তফা বা শাহজাহান চাচাকে খুঁজে পান না।
অন্যসব কালেকশন যেমন তেমন, কিন্তু পুরনো বই আর পাণ্ডুলিপির কালেকশন হলো একটা মরণব্যাধি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য। কেন এটা মানসিক ব্যাধি, সেটা পরে আলাপ করছি। আপাতত এই পুরান বই বাজারের ফিরিস্তি শুনুন।
পুরান বই কালেকশনের বাতিক অনেক বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়তে থাকে। আমি নিজের চোখে রুবাইয়াত বই দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হতে দেখেছি। কিন্তু পুরান বই তো উৎপাদন করা যায় না। বাজারে নতুন মাল জোগান দেবার একমাত্র উপায় খোলা থাকে, দেশের শতবর্ষী লাইব্রেরি ও কালেকশনগুলো ডাকাতি করা।
শিক্ষিত-তরুণ পুরাতন বই বিক্রেতাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট চক্র মাফিয়া হয়ে ওঠে। তাদের কাজ হয় দেশের ব্রিটিশ আমলের কলেজের লাইব্রেরি কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ করা, তাদের ঘুষ দেওয়া। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি, কারমাইকেল লাইব্রেরি, ব্রজমোহন কলেজ, সরকারি গুরুদয়াল লাইব্রেরি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ লুট করে ফেলা হয়। রাতারাতি নয়। প্রতি সপ্তাহে অল্প একটু করে। অথর্ব কলেজ শিক্ষার্থী ও কলেজ কর্তৃপক্ষের জন্য এটা করা সম্ভব হয়। যাদের সাথে বই-পুস্তকের কোনো সম্পর্কই নেই।
আমি ৫টি আলাদা গ্রন্থাগারের পরিচালনার সাথে যুক্ত। এসব দেখে আমি গ্রন্থাগারগুলোকে সাবধান করি। পুরাতন বই আলাদা করে আর্কাইভ করি। সেগুলো পাঠকদের বাসায় নিয়ে যাওয়া বন্ধ করাই এবং আলমারিতে তালা লাগাই। ২০২০-২২ সালে আমি তখন একটি জাদুঘরে চাকরি করি। সারা দেশে গণমানুষের এই ঐতিহ্যের লুটপাট এবং সামাজিক ধ্বংস দেখে আমার বুক ফেটে যায়। বই বিক্রেতাদের প্রতি আমার কোনো রাগ হয় না। আমার কষ্ট লাগে, এসব বইয়ের ক্রেতা হলো তথাকথিত লোভি সাহিত্য অনুরাগী, গবেষণা অনুরাগী শিক্ষিত মানুষেরা। যারা শিক্ষিত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু খোদা তা`আলা তাদের বিবেক দেননি।
আমি জাদুঘরের একজন সদয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রাজি করাই যে, এই বইগুলো বাঁচাতে হবে। জনগণের সম্পত্তি যতটা সম্ভব জনগণের এখতিয়ারে রাখতে হবে। ২০২২ সালে সরকারি গুরুদয়াল কলেজ ও ভিক্টোরিয়া কলেজের অনেকগুলো বই প্রতিষ্ঠানের টাকায় ক্রয় করে আমরা জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি। সরকার ও জাদুঘরের সাথে আমার বনিবনা না হওয়ায় আমি সেই বছর চাকরি ছেড়ে দেই। কাজটি সেখানেই স্থগিত হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমি যখন গণভবনে ছিলাম তখনও আমার মূল কনসার্ন ছিল রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ও দলিল বাঁচানো। খুব চেষ্টা করেও সংসদ ভবন আর্কাইভসে আমি পৌঁছাতে পারিনি। এখনও আমি শতবর্ষী লাইব্রেরিগুলো থেকে লুট হওয়া বইপত্র কিনছি, সেগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি না বানিয়ে পাবলিক স্ফিয়ারে উন্মুক্ত করছি। এই কাজে আমাকে এক-দুজন ব্যবসায়ী গাঁটের পয়সা খরচ করে সাহায্য করছে। অন্য যেসব শিক্ষিত (!) মানুষেরা জনগণের সম্পত্তি ক্রয় করে ব্যক্তিগত কালেকশন তৈরি করছে, তাদের সাথে দেখা করে অন্তত ফটোকপি করে হলেও সেসব বই এর তথ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করছি।
তথ্য হলো জ্ঞান। জ্ঞান হারিয়ে ফেলা সহজ কিন্তু কোটি টাকা দিলেও আপনি সেই সময়ের জ্ঞান পুনরুৎপাদন করতে পারবেন না। আর্টিস্টিক আর অ্যান্টিক মূল্যের কথা না-হয় বাদই দিলাম। দেশের শতবর্ষী কোনো লাইব্রেরিই আর সুরক্ষিত নেই। ক`দিন আগে আমি ঢাকা সেনানিবাস গ্রন্থাগারের বই পর্যন্ত কিনেছি। বাকি লাইব্রেরির নিরাপত্তা তো নস্যি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেননি যে, জাহানারা ইমামের বই বিক্রি করে দাও। মোহাম্মদ আজমও বলেননি। তারা পাগল নন। বাংলা একাডেমির কর্মচারীদের গলায় পাড়া দেন। জিজ্ঞেস করেন ওরা বই কী করে।























