
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ৩৪
প্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০২৫
ডা. জিয়াউদ্দিন সাহেব আজ খুব ক্ষেপেছেন। আমাদের সকলের ওপরই তিনি চড়াও হয়েছেন। শুনেছি গতকাল জসীম উদদীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসনা মওদুদের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এরপর থেকেই তার মন ক্ষ্যাপা ও বিক্ষিপ্ত।
তোমরা জসীম উদদীন পরিষদ না করে বাড্ডা সাহিত্য পরিষদ করো, আমিও তোমাদের সাথে থাকবো। এই নামটাকে তোমরা মাফ করো।
আমরা আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না, কেন তিনি একথা বলছেন। সবাই চুপ করে আছে, কেউ কোনো কথা বলছে না।
আমি বলি, আমাদের অপরাধটা কী?
তখন আমিনুল হক আনওয়ার তার চিরাচরিত স্বভাব বজায় রেখে মাটির দিকে তাকিয়ে বলেন, আমাদের সংগঠনের নাম জসীম উদদীন পরিষদ, কিন্তু জসীম উদদীনের কোন বৈশিষ্ট্য আছে এখানে? কী করি আমরা জসীম উদদীনের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য?
আমি আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, আমার এখন কী বলা উচিত।
জিয়াউদ্দিন বলেন, জসীম উদদীনের মতো গ্রামের মানুষের জীবন-যাপন, দুঃখ-কষ্ট নিয়ে তোমরা কয়টা কবিতা লিখেছ?
আমিনুল হক আনওয়ার যেহেতু একজন আধুনিক কবি, তিনি বেশ নরোম সুরেই বলেন, ডাক্তার সাহেব, তার ভাষায় ও বিষয় নিয়ে আমরা কেন কবিতা লিখবো? তাহলে বাংলা কবিতা তো পেছনেই পড়ে থাকবে। আমরা লিখবো আমাদের ভাষায়।
আমি তো দেখি সবাই শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের ভাষায় কবিতা লেখে। আপনাদের ভাষাটা তো খুঁজে পাই না।
এত তাড়াতাড়ি তো নিজের ভাষা তৈরি হবে না। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের ভাষায় যে আমাদের কবিরা লেখে, এইটাই আমাদের ভাষা।
বুদ্ধদেব বসুরা আপনাদের মাথাটা নষ্ট করে দিয়েছে।
এরপর ডাক্তার জিয়াউদ্দিন আসল কথাটা বলেন। আসলে তার এতো ভূমিকা, রাগারাগি হয়ত এই কথাটা বলার জন্যই।
সামনে জৈষ্ঠ্যমাস, আমি ঠিক করেছি এবার জৈষ্ঠ্যমাসের দ্বিতীয় সভাটা বড় করে করবো, তার নাম হবে `ফলাহার`।
সবাই ডাক্তার সাহেবের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়। কামাল উদ্দিন খান বলেন, খালুজান আমরা কি সবাই ফল নিয়ে কবিতা লেখবো?
ধুর বেক্কল। তাইলে আর আহার হবে কেমনে? ওইদিন আমরা বাংলাদেশে যত রকম ফল পাওয়া যায় সব ফলের সমাহার ঘটাবো। সব দেশি ফল, আপেল, আঙ্গুর না। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেপে, কলা এইসব তো থাকবেই, লটকন, আমলকি, বেতফল, পানিফল, করমচা, ডেউয়া, চালতা, তেঁতুল এইরকম যত দেশি ফল আছে সব জোগাড় করবো। কী পারবা না?
বিষয়টার মধ্যে নতুনত্ব আছি। আমি খুব উৎসাহ পাই, উপস্থিত সকলেই বেশ আগ্রহ দেখায়। আমিনুল হক আনওয়ার আপাদমস্তক কবি, কবিতার বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে তার আগ্রহ নেই, এই বিষয়েও নেই, এটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি, তিনিও ডাক্তার সাহেবকে খুশি করার জন্য বলেন, ভালোই হবে, একদিন আমরা পেটভরে দেশি ফল খাবো।
হেলাল মাহমুদ ও গোলাম মোস্তফা তাপস খুব আগ্রহ দেখান এবং সত্যি সত্যি জৈষ্ঠ্যমাসের দ্বিতীয় সাহিত্যসভার দিন প্রায় অর্ধশত রকমের ফলের সমাহার ঘটানো হয়। ডাক্তার সাহেবের মেজো ছেলে বোরহান উদ্দিন টুটুল দায়িত্ব নিয়ে বেশ কিছু দামি ফল সংগ্রহ করেন, পরিষদের সকল সদস্য নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী দেশি ফল নিয়ে আসেন। এরপর থেকে প্রতি বছর কবি জসীম উদদীন পরিষদ জৈষ্ঠ্যমাসে ফলাহার উৎসব করত।
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহিদ দিবস, বাংলা নববর্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কবি জসীম উদদীন পরিষদ ঢাকা শহরে ব্যতিক্রমধর্মী এবং স্বতন্ত্র ফলাহার উৎসব পালন করত। এই বিষয়টিকে এত অধিক গুরুত্ব দেবার কারণে অনেকেই পেছনে রম্যকার ডাক্তার এস জিয়াউদ্দিন আহমদের কড়া সমালোচনা করতেন। আবার অনেকেই এর মধ্য দিয়ে একটি স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে পারার জন্য তার প্রশংসাও করতেন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। অল্প সময় পরে ড. মনিরুজ্জামান যুক্ত হন, সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, আলী হোসেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদ প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ মধুমাসে ফলাহার উৎসব পালন করার জন্য জসীম উদদীন পরিষদকে বাহবা দিতেন। প্রকৃতপক্ষে ফলাহার পালনের মধ্য দিয়ে ঢাকাস্থ কবি জসীম উদদীন পরিষদ তার একটি চরিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিল।
কবি জসীম উদদীনের পরিবারের সদস্যরাও নানান সময়ে পরিষদের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছেন এবং আমরা যে যথার্থই জসীম উদদীন তথা এদেশের মাটির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করতে পারছি তা বিভিন্ন সময়ে বলতেন এবং অন্যদের অনুকরণ করতে উৎসাহিত করতেন। আমাদের অনেকেই অনুপ্রাসের সঙ্গে জড়িত হয় এবং অনুপ্রাসেরও কয়েকজন পরিষদে যুক্ত হয়। এই দুটি সংগঠন ক্রমশ একে অন্যের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
জসীম উদদীন পরিষদ ছিল গড়ে ওঠার প্রতিষ্ঠান, অনুপ্রাস ছিল বিকাশের, নিজেকে প্রচার করার জায়গা। অনুপ্রাসে কোনো নিয়মিত সাহিত্যসভা হতো না। একপর্যায়ে অনিয়মিত কবিতা পাঠের আসর হতো। সেখানে আলোচনা করা, শেখানো এই কাজগুলো ছিল না। অনেকে আসত, বড় জমায়েত হত। সবাই কবিতা পড়ত। অনুপ্রাস সব জাতীয় দিবস পালন করত। শহিদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাত, ১৪ ডিসেম্বরে রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে যেত।
জসীম উদদীন পরিষদ এইসব করত না। একনিষ্ঠভাবে পাক্ষিক সাহিত্যসভা করত, সভায় পঠিত লেখার অনুপুঙ্খ আলোচনা করত, কবি-সাহিত্যিক গড়ে তোলার কাজে অধিক মনোনিবেশ করত। অনুপ্রাসের যারা শিখতে চাইত, নিজেকে তৈরি করতে চাইত এইরকম বেশ ক`জন নিয়মিত জসীম উদদীন পরিষদে আসতে শুরু করে। তাদের মধ্যে অনিমেষ বড়াল, পলেন সরকার, মতিউর রহমান মানু, আঞ্জুমান আরা সুরমা প্রমূখের নাম মনে আছে।
ঠিক এই সময়টাতে আমার বন্ধু আহসান হাবীব পিয়াল, শামসুজ্জামান রিজভী (পরবর্তীতে গীতিকার আহমেদ রিজভী), দুলাল খান, কবীর হোসেনসহ অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি জসীম উদদীন পরিষদে যোগ দেয়। চলবে