মিছিল খন্দকারের গল্প ‘পাথর ভাই’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২০, ২০২৫
বহু বছর পর সুস্মিতার সাথে এভাবে আবার দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। আচমকা এ সাক্ষাৎ তুমুল গ্রীষ্মের গুমোট অপরাহ্নে অপ্রত্যাশিত বাতাসের মতো করে আমার মধ্যে উড়িয়ে নিয়ে এলো স্মৃতির একদল শুকনো-আধা শুকনো পাতা, যারা কিনা সবুজে রূপ নিতে চাইছে এই সন্ধ্যায়। ফলে সেইসব দিনের ঘটনাবলি আজ একত্রিত হয়ে স্মৃতি থেকে উঠে আসছে। আর আপেক্ষিকতাবাদের সুবিধা নিয়ে বলতে চাইছে, সে অনেক বছর কিংবা অনেক জন্ম আগের কথা; হয়তো যখন ১ টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত।
স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে আমাদের দুজনের জীবনে নানা পরবির্তন এসেছে। আমি এখনকার জন্মে ঢাকায় থাকতে শুরু করেছি। একা। পড়াশুনা শেষে চাকরিতে ঢুকেছি। সুস্মিতা বিয়ে করেছে (পেশার বিষয়ে অবশ্য জানি না।) সাথে ওর হাজবেন্ড ও বাচ্চা। ছেলে। বয়স বছর দুই হবে।
পরিবর্তন এসেছে আমাদের চেহারা-বেশভূষা-কথাবার্তায়। আমার হাড্ডিসার শরীরে বসেছে মাংসের প্রলেপ। সুস্মিতা আছে আগের মতোই শান্ত ও আকর্ষণীয়। শাড়ির সাথে ফুলহাতা ব্লাউজ পরেছে। বাম হাতে স্বর্ণের চিকন দুটি চুড়ি। ডান হাতে স্মার্টওয়াচ ক্রমাগত পরখ করছে ওর হৃদয়ের গতি। চোখে কাজল দেওয়ার অভ্যাসটা এখনও আছে। কথা বলতে গেলে, যেন এক মুহূর্তে চিন্তার বহুদেশ ঘুরে খুঁজে আনে বাক্যরাশি। আর সেই হাসি।
সদরঘাট থেকে একই লঞ্চে আমরা বরিশালে যাচ্ছি। আগেই বলেছি, ওর সাথে ওর হাজবেন্ড আর শিশুসন্তান। আমি যাচ্ছি একাই। হাজবেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলল, ‘ইনিই মিথুন ভাই।’ ওর হাজবেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে হাত মেলাতে মেলাতে বললেন, ‘ও আচ্ছা। আপনার গল্প শুনেছি।’ এরপর হাত নাড়িয়ে ‘দেখা হবে’সূচক ভদ্রতার হাসি দিয়ে ‘বাই’ বলে সুস্মিতা, হাজবেন্ড-বাচ্চাসহ লঞ্চের তিনতলায় কেবিনের দিকে চলে যায়।
লঞ্চের করিডোর দিয়ে ওদের চলে যাওয়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকি আমি। এরপর দোতলার সামনের দিকটায় দাঁড়িয়ে লঞ্চঘাটের হট্টগোলে ঠাসা ব্যস্ত মানুষজনের দিকে চোখ রেখে সিগারেট ধরাতে যাই। বুড়িগঙ্গার বাতাসের বাধা পেয়ে দেশলাইয়ের প্রথম কাঠিটা নিভে যায়। দ্বিতীয় কাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে সন্তর্পণে সিগারেট ধরিয়ে প্রথম টান দিতে দিতে মনে পড়ে বহু বছর আগের সেই দিনটার কথা। মুখে কী জানি কার প্রতি এক বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটে উঠে মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।
লঞ্চঘাটের হট্টগোলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এর কিছুই তখন কানেক্ট করতে পারে না আমাকে। সামনে শূন্যদৃষ্টি ফেলে ভাবি, সুস্মিতা ওর হাজবেন্ডকে আমার কথা কী বলতে পারে? নিতুর কাছ থেকে যা জেনেছি, তাতে সুস্মিতার বলার মতো হয়তো অনেক গল্পই আছে আমাকে নিয়ে। কিন্তু এসব কি ও পার্টনারকে বলবে!
২.
আমরা সুস্মিতাদের পাড়া ছেড়ে চলে এসেছি অনেক বছর হয়। তখন আমি সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি। আর সুস্মিতা ইন্টার পরীক্ষা দেবে। আব্বুর চাকরির যাতায়াতে সুবিধার জন্য বরিশালের বাসা ছেড়ে আম্মুকে নিয়ে তিনি আবারও পাশের উপজেলা শহরে চলে যান। আর আমি চলে আসি ঢাকায়, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য।
এরও বহু বছর পর নিতুর সাথে ফের দেখা। সুস্মিতার বান্ধবী নিতু। আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। তিনজনই একই কলেজের শিক্ষার্থী ছিলাম। সুস্মিতা ও নিতু পড়ত একই ক্লাসে। নিতুর সাথে আমার দেখা হয়, কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল, তার প্রস্তুতিমূলক মিটিংয়ে, ঢাকায়। এরপর আমরা ফেসবুকে অ্যাড হই। নিতুর ফেসবুক লিস্টে সুস্মিতাকে অনেকবার খুঁজেছি, পাইনি। কয়েকবার মনে হয়েছে, ওকে জিজ্ঞেস করি, সুস্মিতা ফেসবুক ইউজ করে কি না। করা হয় না। প্রতিবারই কোনো এক দার্শনিক বোধ এসে বলে, থাক কী দরকার!
নিতু প্রথম যখন সুস্মিতার ভাবনার পৃথিবী আমার সামনে মেলে ধরে, আমার তখন নিজস্ব কোনো নতুন গ্রহের আভাস পাওয়ার মতো অনুভূতি হয়। মনে হয়, অন্য কোনো জন্মে ওই গ্রহের কোলাহলের নিকটবর্তী ছিলাম আমিও। সেই স্মৃতিই আমার কাছে এসে তুলে ধরছে আমারই ওই জন্মের কোনো বন্ধু।
ততদিনে নিতুর পরিবার ঢাকায় চলে এসেছে। আর সুস্মিতারা আগের ঠিকানায়, যেখানে রয়েছে কানাগলির কংক্রিটের চিরচেনা পথ, একপাশে কয়েকটা বুড়ো নারকেল গাছ পেরিয়ে উপগলির মাথায় আমাদের দোতলা ছোট্ট বাসা। উপগলির অপর পাশের দোতলায় এক খোলা জানালা, যার ভেতরকার অন্ধকারে অপেক্ষায় বৈদ্যুতিক সুইচ, কারও নরম হাতের আলতো ছোঁয়ায় সে জাগিয়ে তুলবে আলো। তবে এসবের নিকট-দূরত্বে এককালের আমাদের ক্রিকেট খেলার সেই মাঠটাই কেবল আর নেই। বাড়ি উঠে গেছে। আহা সেইসব বিকেল, না জানি কোথায় কোথায় এখন অনাথ হয়ে ঘুরছে কারো মনে না করার খেসারতে!
নিতুর মাধ্যমে জানলাম, কয়েক বছর ধরে সুস্মিতার সাথে ওর দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। নিতুর ফোন ছিনতাই হওয়ার পর নতুন নাম্বার নেয়। ফলে ওরা দুজন একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার পর থেকে নিতু আমাকে ডাকতে শুরু করে পাথর ভাই বলে। কিছুটা কাব্যিক ভঙ্গিতে প্রসঙ্গটা শুরু করে সে, ‘আপনি কেমন মানুষ বলেন তো, পাথর ভাই? সুস্মিতা গাছের মতো নিঃশব্দে চেয়েছে আপনাকে। আর আপনি পাখি না হয়ে হলেন পাথর! আপনি ওর ছায়াটা টেরই পাইলেন না!’
নিতুর স্মৃতি হাতড়ানো কথার আবেগমিশ্রিত টোনে প্রমিত বাংলার সাথে বরিশালের আঞ্চলিকতা মিলে এক অদ্ভূত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বলতে বলতে কী ভেবে থেমে আরও জোর দিয়ে সে বলে, “আপনি জানেন, ও আপনার জন্য কী করতো? সেই সময় ও একটা দূরবীন পর্যন্ত কিনছিল। আমি সেটা দেখে কী যে হাসছিলাম! মজাও কম করি নাই। সুযোগ পাইলেই বলতাম, ‘কী রে প্রেমে পইড়া মিথুন ভাইয়ের মনের সমুদ্রে নাবিক হতে যাইতেছিস, মনে হয়?’’
আমি অবাক হয়ে আস্তে করে কেবল বলতে পারি, ‘দুরবীন!’
নিতু বলে, ‘হ্যা। আপনার জানালার পাশে ওর জানালা। মধ্যে ঝাকড়া আমগাছের ভুবন বিস্তৃত ডাল। আপনাকে ভালোভাবে দেখায় বাধ সাধে হারামজাদা পাতারা।’ [এই ধরনের কথার প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, নিতুর স্বভাবজাত ইয়ার্কি প্রবণতা। ওই সময় আমি সাইকেল রাখতাম আমার বাসার নিচতলায় সিঁড়ির কাছে। জায়গাটা খোলা। একবার খুব ভোরে সুস্মিতাকে পটিয়ে নিয়ে এসে নিতু সেই সাইকেলের সিটে সুপারগ্লু লাগিয়ে রেখে গিয়েছিল, যাতে সকালে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় আমার পাছা তথা প্যান্ট চিরতরে সিটের সাথে লেগে যায়। অবশ্য তারা ধরা খেয়েছিল আমাদের বাড়িওয়ার মেয়ের কাছে, যে কি না ওই সময় ওদের সহযোগিতা করে (অনেক বছর পরে দেওয়া নিতু ভাষ্যমতে) আর এর সপ্তাহখানেক পরে যেচে আমাকে ঘটনাটা জানায়।]
‘সুস্মিতার কাজই ছিল পড়ার ফাঁকে আপনাকে ফলো করা। কিন্তু ও আরও আরও কাছ থেকে আপনাকে দেখতে চাইত। এজন্যই দূরবীন…,’ নিতুর কথা চালিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে প্রশ্ন করে, ‘ওর নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল, সেটা জানেন?,’ নিতুর প্রশ্নে আমি না-সূচক মাথা নাড়ি। আর তাতে সে আমার সুস্মিতার ভাবনা ও কর্মকাণ্ডকেন্দ্রিক কিছুই না জানা অজ্ঞতার প্রতি অবাক দৃষ্টিতে তাকায় আর বলতে থাকে, ‘সেসব ডায়েরিজুড়ে ছিলেন আপনি আর আপনার হাবিজাবি। জানালা থেকে দেখা আপনার সব…সঅঅব কিছু।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। বোকার মতো বলে ফেলি, ‘আমাকে নিয়ে এত কী লিখত ও?’ নিতু এতে এমন অবাক হয়, যেন পৃথিবীর অল্প কয়েকজন চূড়ান্ত হাঁদার একজনকে সে এই প্রথমবার দেখল, ‘ওমা, আপনি বিকেলে সোয়েবদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন। এরপর সন্ধ্যায় গলির মোড়ে ওদের বাসায় সামনে দাঁড়ায়ে আড্ডা দিতেন। রাতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়তেন। অনেক রাতে, আপনি জানালা দিয়ে আকাশে ভাবুকের মতো তাকায়ে থাকতেন। ঘরের দিকের দরজাটা লাগিয়ে গোপনে সিগারেট টানটেন। আর দাঁতে নখটখও কাটতেন…মনে হয়। মাঝে মাঝে বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে কী সব বই পড়তেন! আরও নানান কিছু। বলতে পারেন ও আপনাকে ভূতের… না, না… পরীর মতো ফলো করতো। সেসবই লিখত। সাথে ওর প্রেমে আইসক্রিম হয়ে গলে গলে যাওয়ার নানা আগডুম-বাকডুম।’
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যপ্রদেশ থেকে উঠে আসা এক দৃষ্টি নিয়ে বলি, ‘আমার এতসব কিভাবে দেখত ও?’ নিতু হাসে। সে হাসিতে থাকে প্রত্যাশিত তাচ্ছিল্য। এরপর নস্টালজিয়ামিশ্রিত অন্যমনস্ততা নিয়ে বলে, ‘কেন, ওর কাছে দূরবীন ছিল সেটা ভুলে গেলেন!’ আমারও স্মৃতিকাতরর ঝাপ্টা লাগে গায়ে। সংকোচমিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে জানতে চাই, ‘আমাকে নিয়ে আর কী কী করত ও?’
‘তার কী আর শেষ আছে! তিনটা ডায়েরি ভর্তি ছিলেন সেই সময়কার আপনি’, বলতে বলতে নিতু থামে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে একটা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘একবার আপনার টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন আনার ছুতোয় ও আমাকে নিয়ে আপনার বাসায় গিয়েছিল, মনে আছে?’
আমারও মনে পড়তে বেগ পেতে হয় না সেই দিনটার কথা। মনে হয়, পছন্দের কিংবা গভীর সব স্মৃতিরই আছে শিশুর মতো সদ্যগজানো দাঁত। আমি সেই দাঁতের কামড় নিয়ে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়াই। নিতু বলতে থাকে, ‘আপনার আব্বুর সাথে ওর বেশ খাতির হয়েছিল। আঙ্কেল ওর বাবার সাথে ওদের বাসায় যাইত মাঝে মাঝে। তখন ওর সাথে আঙ্কেলের গল্প হইতো। তিনি মনে হয়, ওরে বেশ পছন্দই করতেন। বাসায় যাইতে বলতেন। সেজন্যই গরিবের টেলিস্কোপ দূরবীনে দেখা ভিনগ্রহের আপনার পড়ার রুমটা দেখতে চাইছিল ও। আমার সাথে বুদ্ধি করে তাই আপনাদের বাসায় গেছিল। আপনার আম্মু তো খুশিই হইছিলেন। কিন্তু আপনি এতো বিরক্ত ছিলেন…যে কথাই ফুটল না মুখে। কেবল কপাল কুঁচকে টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন আগায়ে দিছিলেন, মিয়া। সেইটাও আমার দিকে।’
প্রশ্নের উত্তরের থোড়াই কেয়ার করে নিতু বলতে থাকে, ‘এদিকে আবার পরের দিন সন্ধ্যায় ওকে গলির মুখে পেয়ে, বাসায় যাওয়ার অপরাধে রীতিমতো কথা শুনাইছিলেন আপনি। আপনাদের বাসায় না যাওয়াই ভালো টাইপ কীসব কথাবার্তা! সেদিন রাতে সুস্মিতা কাঁদছিল। রাগে-অপমানে আপনার দিকের জানালা বন্ধও রাখছিল। সন্ধ্যায়ও গলির মুখেও যাইত না কয়েকদিন।’
কণ্ঠে খানিকটা বিদ্রুত ও জিজ্ঞাসার ঝাঁঝ নিয়ে নিতু বলে, ‘আপনি নিশ্চয়ই এসব খেয়াল করেন নাই তখন?’
আমি চুপ থাকি।
৩.
নিতুর সাথে দেখা হওয়ার পর সেদিন বাসায় ফিরে আমার মনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে স্মৃতি। বরিশালে আমাদের বাসার সেই গলি। পাড়ার ছোট্ট মাঠ। মাঠের পাশের খানিকটা ছায়াযুক্ত চারটা বাঁধানো কবর। রাস্তার পাশের কয়েকটা রুগ্ন নারকেল গাছ পেরিয়ে সুস্মিতাদের বাসা। তার পাশ দিয়ে উপগলি। এর শেষ মাথায় দোতলার পুরোটা জুড়ে থাকা এল আকৃতির করিডোরসহ ছোট্ট বাসাটা। করিডোর ও জানালার পাশে কংক্রিটের মেঝে ফুঁড়ে বড় হওয়া পুষ্ট আম গাছ। ফাঁকা দুপুরে কারো সাইকেল বেল। নিচতলার টিনশেড বাড়িতে বাজতে থাকা রেডিও। উল্টো পাশের বাসায় সকালে বয়স্ক কণ্ঠে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধা নিখিল কাকা। সন্ধ্যার রোডলাইটের আলোয় গলিতে আম গাছটার ছায়া। নিচতলায় পড়া বাদ দিয়ে টিভিতে হিন্দি গান দেখতে থাকা বাড়িওয়ালার কিশোরী কন্যা। হঠাৎ সতর্ক করে দেওয়া তার মায়ের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর। দোতলার বাড়ির নির্জন রেলিংহীন শ্যাওলা ধরা ছোট্ট ছাদ। ছাদে শুকাতে দেওয়া বাড়িওয়ার মেয়েদের সালওয়ার-কামিজ। আহা, কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পরও নিতে ভুলে যাওয়া সেইসব স্বল্পকালীন একা-দুখি কাপড়েরা।
ছাদে বাড়িঅলার মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া সেই বিব্রত-কিশোর, নেড়ে দেওয়া কাপড়ের হাত নাড়া কলেজ-ফেরত যাকে ঘরের আগে ডেকে নিত ছাদে। কোনো কোনো গভীর রাতে গলির রাস্তায় খুব শিউলি ফুল পড়ে থাকত। সেই ঘ্রাণ আর দৃশ্য নিষ্ঠুরভাবে উপেক্ষা করে সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত প্রাইভেটে। আরও কত সব ঘটনার নস্টালজিয়ার মধ্যে সুস্মিতার জন্য জেগে ওঠা প্রতিকারহীন তাৎক্ষণিক বিষণ্ণতাও কি মিশে যায় না!
৪.
ওইসব দিনগুলোতে মূলত রাতজাগার তাড়া থাকত। ক্লাসের পড়া শেষে গভীর রাতে বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা গল্প-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পৃথিবী তার হৃদয় খুলে ধরত আমার কাছে। যার অপেক্ষা ক্রমে আমাকে নিশাচর করে তোলে। জানালার পাশেই পড়ার টেবিল-চেয়ার-বেতের ছোট্ট বুকশেলফ। ঘাড় উঁচু করে জানালার বাইরে তাকালেই আকাশ। আমার রাত্রিকালীন সঙ্গী। মাঝে মাঝে হুট করে সুস্মিতাকে ওর জানালায় যে দেখতাম না, তা না। কিন্তু তা ওই পর্যন্তই।
বিকেলের ক্রিকেট খেলা শেষে সন্ধ্যায় আমাদের একটা ক্ষণকালীন আড্ডা ছিল। পাড়ায় আমাদের ক্লাসমেটদের সাথে বছরখানেকের সিনিয়ন ও জুনিয়রেরাও ওই আড্ডায় থাকত, পেত পাড়াত-বন্ধুর মর্যাদা। ওইসব আড্ডার অনেকটা জুড়ে ছিল কলেজের মেয়েদের নিয়ে আলাপ। ফাঁকে কখনও কখনও এসে পড়ত পাড়ার মেয়েদের প্রসঙ্গ। আমাদের বন্ধু আকবর যে কি না দুইবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর রণেভঙ্গ দেয়, তার গল্পের বিরাট অংশজুড়ে থাকত পাড়ার মেয়েরা এবং তাদের কোনো কোনো ঘটনার বিন্দুকে মনের মাধুরি মিশিয়ে সিন্ধুতে পরিণত করা সব গল্প। একই গল্প একাধিকবার বলার ক্ষেত্রে প্রতিবারই নতুন নতুন ডালপাতা পেতে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার আগে থেকে ভাঁজ করে রাখা গোছানো উত্তর পাওয়া যেত। কিন্তু আকবরের সেসব গল্প বিশ্বাসের সুতা কেটে আমাদের মনের অবিশ্বাসে ডালে এসে ঝুলে থাকত ঘুড়ির মতো।
এভাবে কোনো এক আড্ডায় আকবর যা বলে তার সারমর্ম দাঁড়ায়, সুস্মিতার সাথে ওর প্রেম ছিল। কিন্তু সেটা কয়েক মাস স্থায়ী থাকার পর ভেঙে যায়। এবং বিষয়টা অবশ্যই অবশ্যই গোপন রাখতে বলে আমাদের। আমরাও গোপন রাখার কথা না দিয়ে পারি না।
ততদিনে জানালায় ঘন ঘন সুস্মিতার উপস্থিতি, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার মুখে গলিতে নিয়মিত দাঁড়িয়ে থাকা আমার মধ্যে খানিকটা খটকা তৈরি করতে থাকে। তখন অবচেতনে কিছুটা কৌতূহল আর আগ্রহ উঁকি দিয়ে তা আকবরের গল্পের সত্য-মিথ্যার কুহকে মিলিয়ে গিয়েছিল কি না, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। তবে নানাসব ঘটনার এভাবে দ্রুতও কখন যে ওই পাড়ায় দেড় বছর কাটিয়ে ফেলি তা বলতে গেলে আবারও আপেক্ষিকতাবাদের প্রসঙ্গ এসে যায়।
এর মধ্যে আমাদের টেস্ট পরীক্ষার শুরু হয়ে যায়। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার দিন সন্ধ্যায় এসে সুস্মিতার হাতের নাড়ায় সশব্দে বেজে ওঠে আমাদের দরজার কড়া। আম্মু দরজা খোলার পর তার পেছন পেছন এসে তাকিয়ে ওদের দেখি। ওর আসার বিষয়টা আব্বু-আম্মু কিভাবে নেয় তা ভেবে সেই চাপ থেকে উদ্ভূত অধৈর্য আমার আচরণে রূঢ়তা ফুটিয়ে তোলে। আর তখনই সুস্মিতার টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন চাওয়ার বিষয়টা তোলে।
আরও কয়েকটা পরীক্ষা বাকি থাকায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরের দিন সন্ধ্যায় সুস্মিতাবে গলির মুখে পেয়ে শাসানির ভঙ্গিতে বলেছিলাম, যাতে আর প্রশ্ন চাইতে বাসায় হাজির না হয়।
৫.
এইচএসস পরীক্ষা সমাগত হওয়ায় পড়াশুনা বাইরে বিকেলে ক্রিকেট খেলা, সন্ধ্যার আড্ডা আর এশার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় শোয়েবের সাথে চলতি পথের আলাপ— এইভাবে চলছিল। শোয়েব আর আমি ছিলাম সহপাঠী। ওদের বাসাটা ছিল সুস্মিতাদের পাশের বাসার নিচতলায়। ওদের জানালা থেকেও আমার জানালা দেখা যেত। আমাদের বিভিন্ন সময়ে দুই জানালায় কথা হতো। কোনো কোনো দিন সকালে, আমাদের কথাবার্তার মাঝে খুলে যেত, সুস্মিতাদের জানালা। শোয়েব তখন মুখ টিপে ইঙ্গিতময় হাসি হাসত। সেই হাসির রেশ ধরে অগ্রবর্তী কোনো প্রশ্ন নিয়ে আমাদের তখন পর্যন্ত কোনো কথা হয় নাই। কেবল সমবয়সী এক তরুণীর উপস্থিতির মুহূর্ত-আলোড়ন তৈরি হয়ে তা নিমেষেই মিলিয়ে যাওয়া।
এভাবে নতুন বছরের মাঝামাঝি মূল পরীক্ষাসহ প্রাকটিক্যাল পরীক্ষাও শেষ হয়। ততদিনে সুস্মিতার প্রতি করা আচরণের কথা মনে পড়ে এবং সহসা অনুতাপের মোড়কে একে হয়ত ওর সাথে কথা বলতে চাওয়ার একটা উপলক্ষ তৈরি করতে চায় আমার মন। আমি আর শোয়েব তখন সন্ধ্যার আড্ডা শেষে শহরময় সাইকেলে ঘুরে বেড়াই। আমাদের বাসা ছাড়ার তারিখ ঠিক হওয়ার সবকিছুর মধ্যেই মিশে থাকে বিদায়ের বিষণ্ণতা। একদিন সোয়েবকে জিজ্ঞেস করে ফেলি, ‘আচ্ছা, সুস্মিতার কাছে কি আমার সরি হওয়া উচিত?’ সোয়েব সাইকেলের গতি কমিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। এরপর ইয়ার্কির মাত্রা বাড়িয়ে ছড়া কাটতে থাকে, ‘আয়রে প্রেম কাছে আয়, মিথুনের মন সুস্মিতায় খায়।’
ওর ইয়ার্কি দেখে আমার মধ্যে তৈরি হওয়া শরম পাওয়ার ভাব লুকাতে পারি না। ফলে আর এ প্রসঙ্গে কিছুই বলতে পারি না আমি। এরপর শোয়েব বেশ কয়েকবার ফোড়ন কেটে ‘অগ্রগতি কতদূর’ জানতে চায় আর জবাবে আমি ‘ধূর কী যে বলো’ বলে আলাপের ইতি টানি।
এর মধ্যে শেষের দিনগুলোতে পরপর কয়েকদিন সন্ধ্যায় পাড়ায় ঘুরঘুর করি, যদি গলিতে সুস্মিতাকে একা পাওয়া যায়— এই গোপন অভিপ্রায়ে। এভাবে ওকে একা পেতে চাওয়ার গভীরে কোনো নিগূঢ় কারণ রয়েছে কিনা, সে বিষয়েও নিজের কাছে জানতেও চাই না। কেবল শর্তহীনভাবে মনের নির্দেশনা অনুসরণ করে যাই মাত্র। কথা বলার মতো মওকায় ওকে আর পাওয়া যায় না। সন্ধ্যায় দুয়েকবার ওর পিচ্চি দুই ভাইকে ডাকার প্রসঙ্গে গলির মুখে আসতে, আর সন্ধ্যার পর পর ওদের দোতলায় ওঠার বাইরের সিঁড়িতে নিতুর সাথে বসে থাকতে দেখা যায় সুস্মিতাকে।
ততদিনে আমাদের বাসা ছাড়ার দিন চলে আসে। বলাই বাহুল্য খবরটা পাড়ার সবাই আগে থেকেই জানত। শেষ সপ্তাহ আমরা পারিবারিকভাবে পাড়া ও বাসাটার মায়ায় এক অঘোষিত বিষণ্ণতা সপ্তাহ পালন করতে থাকি। আম্মু-আব্বু প্রতিদিনই পাড়ার বিভিন্ন পরিচিতজনের বাসায় যান, লুড়ুলস এবং চায়ের সাথে মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেন। আর ফিরে আসার সময় বিদায়ভরাট কণ্ঠে বলেন, ‘মাঝে মাঝে তো অবশ্যই আসব আপনাদের দেখতে। আর আপনারাও যাবেন বেড়াতে। এই তো কাছেই….।’ সুস্মিতাদের বাসায়ও যান তারা।
জুনের শেষ দিন বিকেলে শেষবারের মতো পাড়ার সবার সাথে ক্রিকেট খেলি। সন্ধ্যার আড্ডায় আবেগঘন এক বিদায় পর্ব ঘটে। সবশেষে প্রায়ান্ধকারে কয়েক মিনিটের জন্য গলিতে একা হওয়ার চেষ্টা করি। যদি দেখা মেলে ওর… দেখা হয় না। এরপর শোয়েবের সাথে শেষবারের মতো সাইকেল নিয়ে শহরে বেরিয়ে পড়ি। বাসায় এসে শুনি, সন্ধ্যার পর সুস্মিতা ও ওর মা এসেছিল বাসায়। আমি ভেজাবেড়ালের মতো মুখ করে ‘কেন এসেছিল’ জানতে চাইলে আম্মু স্বাভাবিক বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘কেন আবার, আমরা চলে যাচ্ছি তাই! সুস্মিতা তোর কথা জানতে চাইছিল। তোর পড়ার রুমেও গেছিল, কী একটা বই খুঁজতে। গিয়ে তো দেখে সব বস্তাভরা।’
৬.
পরেরদিন সকালটা যেন এক ঘোর লাগা দ্রুতটার শেষ হতে থাকে। সময়কে তার স্বাভাবিক গতির চেয়ে দ্রুত ছুটতে দেখি আমি। সাড়ে ৭টার মধ্যে সব মালামাল ট্রাকে উঠে যায়। শেষবারের মতো আমার রুমের জানালা দুইটা বন্ধ করতে গিয়ে তাকাই, সুস্মিতা ওর জানালায় দাঁড়িয়ে। পাশে ওর ছোটভাই বাপ্পি। আমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকি। নিচ থেকে আব্বুর তাড়া দেওয়া কণ্ঠ ভেসে আসে।
আগে থেকে ঠিক করা ছিল আব্বু-আম্মু বাসে করে যাবেন আর আমি ট্রাকের সাথে। ফলে ট্রাকের মালামাল উঠে গেলে তারা বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রিকশায় ওঠেন। পাড়ার সব ঘর তখনও সকালের নাস্তা বানানোয় ব্যস্ত। দুয়েকটা রিকশা গলির সামনে দিয়ে টুংটাং শব্দ করে ছুটে যায়। গলির মোড়ে ঘোল বিক্রি করতে দেখা যায় চিরচেনা লাবু কাকাকে। তার উল্টো পাশে সুস্মিতাদের নানার বাসার গলির মুখে কেবলই মুদি দোকানের ঝাপ খুলছিলেন কুট্টি কাকু। সামনে খালের পাড়ের কবরস্থানের দেড়ালে বসে সিগারেট টানছিলেন বাপ্পী দা। তার উল্টো পাশে মেইন রাস্তা দিয়ে ট্রাকের চালককে নাস্তা করে হেঁটে আসতে দেখি আমি। আর ঠিক সেই সময় সুস্মিতার ছোট ভাই বাপ্পি কিছুটা দৌড়ে ট্রাকের কাছে আসে।
ওর আসাটা চলমান চিন্তা থাকিয়ে আমার মনোযোগ ওদের দিকে নিবদ্ধ করে। ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সুস্মিতাকে। বাপ্পি আমার হাতে ছোট্ট এক টুকরা কাগজ দিয়ে কিছু না বলে আবার দৌড়ে ফিরে যায়। আমি মুহূর্তে চিরকুটটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে ফেলি।
চিরকুট পড়তে চাওয়ার অধৈর্য থেকে হিসেবে ট্রাক ড্রাইভারকে বলি, ‘ভাই, আমি ফেরিঘাট পর্যন্ত ট্রাকের পেছন দিকটা কিছু একটার উপরে বসছি। যদি দেখি মালামালের কোনো নড়চড় নাই, তাইলে ফেরিঘাটে আপনের পাশের সিটে চলে আসবনে।’
আবহমান সব বিদায়ের মতো পুঞ্জিভূত এক হাহাকার নিয়ে ট্রাকটা ছাড়ে। আর ক্রমে অপসৃয়মান পাড়াটায় আমার বিদায়ের আয়োজনে অংশ হয়ে থাকে সুস্মিতা ও তার ভাই বাপ্পির নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা। ট্রাকটা ওদের পেছনে ফেলে বাঁক নেওয়ার পর আচমকাই মনে হয়, ট্রাক ড্রাইভার ভাইকে কিছু একটা ছুতা দেখিয়ে আরেকবার কি গলির মধ্যে ছুটে যেতে পারি না!
ট্রাকটা হাইওয়েতে উঠলে আগে থেকে কিনে রাখা একটা সিগারেট ধরানোর জন্য বাতাসের আড়াল পেতে নিচু হই। বাতাসের বাঁধায় প্রথম কাঠিটা ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় কাঠিটার জন্য সাবধানে আড়াল তৈরি করে দেয় করতল। সিগারেটে প্রথম টানের পর ভাঁজ করা তোশকে হেলান দিয়ে আস্তে করে বুকপকেটে হাত দিই। চিরকুটের ভাঁজ খুলতে গিয়ে যা ঘটে, তা আজও আমার কাছে এসে হারিয়ে ফেলা এক প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা হয়ে বাজে মনে।
আচমকা হাত ফসকে বাতাসে উড়ে যায় চিরকুট। কী লেখা ছিল তাতে, এত বছর ধরে সাপের ছোবল হয়ে থাকা সেই প্রশ্ন আজ রাতের লঞ্চে এই আচমকা সাক্ষাতে আমার মনের মধ্যে আবারও বিষ ছড়ায়। সাথে আরেকটা প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় এর পাশে, সুস্মিতা কি জানে সেই চিরকুটের পরিণতি?
























