
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১৫
প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০২৫
বন্ধুদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা, কে কোন কলেজে ভর্তি হবে। ছেলেদের জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে ঢাকা কলেজ। আমি যেহেতু সরকারি কলেজে ভর্তি হতে চাই, তাই দ্বিতীয় ভালোর মধ্যে আছে তিতুমীর কলেজ। এই দুটোর যে কোনো একটিতে ভর্তি হতে হবে। বন্ধুদের, মুরুব্বিদের পরামর্শ আমি মন দিয়ে শুনি, পছন্দ না হলেও কাউকে কিছু বলি না। তবে আমি কী করবো তা আমিই ঠিক করি, আমার নিজস্ব চিন্তার সঙ্গে না মিললে আমাকে কেউ প্রভাবিত করতে পারে না। যেহেতু আমি সকলের কথাই শুনি এবং শেষ পর্যন্ত আমি যা করি তা কারো না কারো পরামর্শের সঙ্গে মিলে যায়, অনেকেই মনে করেন আমি খুব সহজেই সেই মানুষটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আমি প্রভাবিত হইনি, আমার চিন্তার সঙ্গে সেই মানুষটির পরামর্শ মিলে গেছে।
আমার সিদ্ধান্ত আমিই নেই, একথা ঠিক কিন্তু অন্তত একজন কেউ আমার সঙ্গে একমত না হলে কাজটি করে শান্তি পাই না। সমস্ত জীবন আমি কখনো সচেতনভাবে কখনো নিজের অজান্তেই সেই একজন ঠিক করে রাখি। এই সময়টাতে আমার সেই বিশেষ একজন সমর্থক হচ্ছেন আমার আম্মা। আম্মাকে বলি, আম্মা কোথায় ভর্তি হবো, ঢাকা কলেজ নাকি তিতুমীর কলেজ?
আম্মা বলেন, তিতুমীর।
মনে মনে আমিও এই সিদ্ধান্তই নিয়ে রেখেছি। আম্মা ঢাকা কলেজ বললে তাকে কী বলে তিতুমীরে রাজি করাবো তাও ঠিক করে রেখেছি। ঢাকা কলেজ দূরে, দুইবার বাস, টেম্পু বদল করে যেতে হবে, তিতুমীর কলেজ কাছে, গুলশান থেকে ৬ নম্বর বাসে উঠলে এক স্টপেজ পরেই। ভাড়া মাত্র ত্রিশ পয়সা।
যাচাই করার জন্য আম্মাকে প্রশ্ন করি, ঢাকা কলেজ তো সবচেয়ে ভালো, তিতুমীরে কেন যাব
তিতুমীর বাড়ির কাছে, এত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ভালো করে লেখাপড়া করলে তিতুমীর থেকেই তুমি ভালো রেজাল্ট করতে পারবা।
আমি আর কোনো কথা বলি না। যেসব যুক্তি আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, আম্মা সেগুলোই আমাকে শোনাচ্ছেন।
কলেজে ভর্তি হবার পর আমার দুটো নেশা হয়। সারাদিন কমন রুমে পড়ে থাকি, টেবিল টেনিস খেলি আর কিছুটা সময় থাকি লাইব্রেরিতে। এত এত বই একসঙ্গে আমি কখনোই দেখিনি। স্কুলে পড়ার সময় আমি বড় কোনো পাঠাগারে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমার আত্নীয়-স্বজনদের মধ্যে যেসব ধনী লোকদের বাড়িতে গিয়েছি তাদের কারোর বাসায়ই সমৃদ্ধ কোনো পাঠাগার ছিল না। হয় আমি সেইরকম একটি আলোকিত সমাজের খোঁজ পাইনি অথবা ঢাকা শহরে তখনও ঘরে একটা বইয়ের আলমারি রাখার মতো সমাজ গড়ে ওঠেনি। আসলে এখনো, এই ২০২৫ সালেও কি তা হয়েছে?
তিতুমীর কলেজের পাঠাগারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে আমি বাংলা সাহিত্যের অনেক ক্লাসিক বই পড়ে ফেলেছি। মধ্যযুগের কবিতা পড়েছি, কবি জসীম উদদীনের গদ্যগুলো পড়েছি, তার কাব্যনাটক পড়েছি, রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু বই পড়েছি, ময়মনসিংহ গীতিকা পড়েছি, ভানুসিংহের পদাবলী পড়েছি।
কলেজের প্রথম দিনের ঘটনা বলি। ছিপছিপে তরুণী শিক্ষয়িত্রী, ইংরেজির ক্লাস নিতে শ্রেণিকক্ষে ঢোকেন। এমন অপূর্ব সুন্দরী আমাদের শিক্ষয়িত্রী? পরনে গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি, ছিপছিপে একহারা গড়ন, ফর্শা গায়ের রঙ, শাদা স্লিভলেস ব্লাউজে ঢাকা অনিন্দ্য দুটি স্তন, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে গোলাপি রঙের লিপস্টিক পরেছেন। কপালের মাঝখানে একই রঙের বড় একটা টিপ। ম্যাডাম কী বলছেন তা কেউ শুনছে বলে মনে হয় না, ছেলেরা হা করে শুধু তাকে দেখছে। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পাঠপুস্তকে গিফট অব ম্যাজাই বলে একটা গল্প ছিল। তিনি ক্লাসের সবচেয়ে সুদর্শন ছাত্র, যার লম্বা চুল ঘাড়ের নিচে দোল খায়, গায়ে লাল শার্ট, খুব মিষ্টি করে হাসে, হাসলে ওর একটা বাঁকা দাঁত বেরিয়ে পড়ে, যার কারণে ওকে আরো সুদর্শন লাগে, যার নাম পলাশ, তার দিকে আঙুল নির্দেশ করে ম্যাডাম বলেন, গল্পটার নাম বলে প্রথম প্যারাটা পড়ো।
পলাশ দাঁড়ায় এবং ফ্যালফ্যাল করে ম্যাডামের দিকে চেয়ে থাকে, মুখে কিছুই বলে না। সম্ভবত ম্যাডামও এই অবস্থাটি উপভোগ করছেন। তিনি পলাশকে বেশ খানিকটা সময় দেন তারিয়ে তারিয়ে দেখার জন্য। শুধু তাই না, তিনি স্টেজ থেকে নেমে ওর কাছে চলে আসেন, যেন তার গা থেকে ভেসে আসা ভারি পারফিউমের গন্ধে পলাশ আরো খানিকটা মুগ্ধ হতে পারে। পলাশ তখনো বাকরহিত। ম্যাডাম একেবারে ওর কাছে গিয়ে বলেন, হ্যালো হ্যান্ডসাম, বইটা হাতে নাও এবং পড়ো।
পলাশ পড়তে শুরু করে, গিফট অব দ্য...পরের শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে থেমে যায়। অন্য ছাত্রদের মধ্যে গুঞ্জন। কেউ বলছে, ম্যাগি, কেউ বলছে মাগি। ম্যাডাম হাইহিলে আওয়াজ তুলে, তারা শরীরের বাঁকে বাঁকে কামনার ঢেউ তুলে স্টেজে উঠে আসেন এবং খুব মিষ্টি করে বলেন, থামো। শুধু তোমরাই এই ভুলটা করোনি। প্রতি বছর যারাই ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাসে আসে এই ভুলটা করে। শব্দটা মাগি কিংবা ম্যাগি নয়, এটা হবে ম্যাজাই।
ম্যাডাম কী অবলীলায় `মাগি` শব্দটা উচ্চারণ করলেন, যা শুনে আমরা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
ও হেনরির বিখ্যাত ছোটোগল্প গিফট অব দ্য ম্যাজাই এর নায়িকা ডেলা। সেদিন থেকে ম্যাডামের নাম আমরা দিয়ে দিই ডেলা। তার নিজের নাম কেউ জানে না, সকলেই তাকে ডেলা বলে ডাকে এবং কেউ তাকে ম্যাডাম বলে না, শুধুই ডেলা বলে ডাকে।
ক্লাস শেষ হলে ছেলেরা সবাই পলাশকে ঘিরে ধরে, দোস্ত, ডেলা তোর প্রেমে পড়ে গেছে।
পলাশ গর্বে কলার ঝাকায় এবং ক্লাসের হিরো হয়ে যায়। আমাদের বাণিজ্য শাখায় প্রায় দুশো ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে মাত্র ৫টি মেয়ে। একটি মেয়ে কালো এবং খুব লম্বা, ছেলেরা ওর নাম দিয়েছে তল্লাবাঁশ। একটি মেয়ে খাটো, ফর্শা ও মোটা, ওকে বলে বয়ম। একটি মেয়ের খুব বড় বড় চোখ, দীর্ঘ কালো চুল, যা সে কখনোই বেঁধে রাখত না। হাঁটলে ওর চুল বাতাসে উড়ত। গায়ের রঙ কালো হলেও চেহারাটা ছিল বেশ মিষ্টি। ওর নাম সুলতানা। অন্য দুটি মেয়ের ছিল ছোটো চুল, ফ্লাট বুক, অনেকটা ছেলেদের মত। মোটের ওপর কিছুটা দেখার মতো ছিল সুলতানাই।
ছেলেদের মধ্যে যারা কিছুটা বয়সে বড়ো, ড্যাশিং, জিমে যেত, ইংরেজি বলতে পারত, ধনী পরিবারের, গাড়ি নিয়ে আসত, ওরা সবাই সুলতানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু সুলতানা কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। ক্লাসের সেরা সুন্দরী সে, কাজেই বেছে নেবার একটা সহজ সুযোগ ওর ছিল।
এক সপ্তাহের মধ্যেই সুলতানার সঙ্গে জুটি বেঁধে ফেললো পলাশ। ওদের মধ্যে গভীর প্রেম, চিপায়-চাপায় ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অনেকেরই চোখে পড়ছে। মজার ব্যাপার হলো যারা সুলতানাকে পাবার জন্য লাফালাফি করেছিল তারাসহ পুরো ক্লাসই এই জুটিকে বাহবা দিতে লাগলো, উৎসাহ দিতে লাগল। ওদের কোনো কিছু দরকার হলে সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। ক্লাসের এমন অভূতপূর্ব সহযোগিতা পেয়ে ওরা দুজন চুটিয়ে প্রেম করতে লাগল।
এই সময়টাতে আমার আলাতুন নেসা স্কুলের বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে খুব সখ্য গড়ে ওঠে। মিজান আমাকে বলে, দোস্ত আমরা ঢাকা কলেজে যায় নাই কিন্তু আমাদের যেসব বন্ধু ঢাকা কলেজে গেছে তাদের চেয়ে আমাদের ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
আমি বলি, ঠিক, আম্মাও এই কথাই আমাকে বলেছে।
কিন্তু কীসের কী। মিজান আর আমি সারাদিন টেবিল টেনিস খেলি একটাও ক্লাস করি না। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হয়ে যায়। দুশো ছাত্রের মধ্যে মাত্র চারজন ফেইল করেছে, দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে পারেনি। সেই চারজনের দুজন আমি আর মিজান। আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করি। সবাই টাকা পয়সা জমা দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু করে দিয়েছে, আমরা বারান্দায় বসে থাকি। আমরা কি কলেজের বখাটেদের তালিকায় পড়ে গেলাম?
একদিন মিজানকে বলি, চল পরীক্ষা কমিটির হেড হাবিবুর রহমান স্যারের কাছে যাই, গিয়ে স্যারের হাতে পায়ে ধরে বলি, দ্বিতীয় বর্ষে আমরা ভালো ছাত্র হয়ে যাব।
মিজান বলে, ফেইল করলাম কেমনে? পরীক্ষা তো ভালোই দিলাম। চল যাই।
স্যারের দরোজার সামনে যে চিকনা মামু বসে থাকে সে আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। মিজান মামুর কলার ধরে হ্যাচকা একটা ধাক্কা দেয়, ওর শার্টের বোতাম ছিঁড়ে যায়। মামু ভয় পেয়ে যায়। শব্দ পেয়ে হাবিবুর রহমান চিৎকার করে ওঠেন, এই কে ওখানে, কী হয়েছে?
আমি বলি, কিছু না স্যার, মামু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল, এখন ঠিক আছে।
কথাটা বলেই মামুকে তার টুলে বসিয়ে দিয়ে আমরা দুজন দরোজা ঠেলে, ভারি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ি।
কী চাও তোমরা?
মিজান বলতে শুরু করলে আমি ওর হাত চেপে ধরি।
আমি বলি, স্যার আমরা দুজন সেকেন্ড ইয়ারে প্রোমোশন পাইনি কিন্তু স্যার আমরা নিশ্চিত, খাতা দেখায় কোনো একটা ভুল হয়েছে। আমরা খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছি। আপনি স্যার আমাদের খাতাগুলো পুনরায় একটু দেখার ব্যবস্থা করেন।
স্যার মন দিয়ে কথাটা শোনেন। তারপর টেবুলেশন শিট বের করে বলেন, কই তোমরা তো পরীক্ষায় ভালো নম্বরই পেয়েছ, আবার খাতা দেখতে হবে কেন? দেখি তো সমস্যা কী। ও, এই কথা? তোমাদের তো অ্যাটেন্ডেন্সই নেই, কী করেছ সারা বছর? ক্লাস করোনি কেন?
আমি বলি, স্যার, আমাদের দুজনেরই অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ, অনেকগুলো টিউশনি করে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু স্যার আমরা বাসায় মন দিয়ে পড়ালেখা করি।
সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি, সব বিষয়েই ভালো নাম্বার পেয়েছ। ঠিক আছে, আমি তোমাদের প্রোমোশন দিয়ে দিচ্ছি, সেকেন্ড ইয়ারে একদম ফাঁকি দেবে না।
হাবিবুর রহমান স্যার দুজনের জন্য দুটো চিরকুট লিখে দেন। সেগুলো নিয়ে কেরানির কাছে যাই। কেরানি ফি নিয়ে আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি করে নেন।
এরপর মিজান আর আমি ঠিক করি, অনেক হয়েছে, আর না। এবার পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিদিন বিকেলে রামপুরা ব্রিজ টু শাহজাদপুর ব্রিজ আমরা দুবার করে হাঁটি। আগে থেকে একটা চ্যাপ্টার ঠিক করে নেই, আমি পুরো চ্যাপ্টারটা ওকে বোঝাই, ফেরার পথে ও কী বুঝলো তা আমাকে বলে।
পরের দিন মিজান আমাকে একটা নতুন চ্যাপ্টার ব্যাখ্যা করে বোঝায়, ফেরার পথে আমি কী বুঝলাম তা ওকে বলি। এভাবে আমরা পড়ালেখার একটা নতুন কৌশল বের করে অধ্যায়ন করতে থাকি।
এক বছর পর যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। আমাদের কলেজের বাণিজ্য শাখা থেকে মাত্র ৪ জন প্রথম বিভাগ পায়। সেই চারজনেরও দুজন আমি আর মিজান। মার্কশিট তোলার জন্য যখন হাবিবুর রহমান স্যারের কাছে যাই, তিনি আমাদের ঠিক চিনে ফেলেন।
স্যার বলেন, তোমরা সেই দুষ্টু দুই বন্ধু না, আমার পিয়নকে মেরেছিলে?
আমরা মাথা নিচু করে থাকি। স্যার মার্ক শিটের দিকে তাকিয়ে বলেন, ব্রাভো, দুজনই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছ। ওয়েল ডান মাই বয়েজ। কিপ ইট আপ। চলবে