
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ৩২
প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০২৫
একটি কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি মনে করি, এই কথাটি বলা খুব দরকার। যেদিন প্রথম কবি আমিনুল হক আনওয়ার আমাকে ডাক্তার জিয়াউদ্দিন সাহেবের বৈঠকখানায়, মানে জসীম উদদীন পরিষদে নিয়ে যান সেদিন থেকে পরবর্তী ১ বছর পর্যন্ত আমি বিরতিহীন প্রতিদিন সেখানে গিয়েছি। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা কিংবা অসুখ-বিসুখ যাই থাকুক একদিনও সেই তীর্থে হাজিরা দিতে ভুল করিনি।
এই ১ বছরে শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সকলের কথা শুনেছি, সবাইকে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করেছি। কোনো দিন নিজে একটি কথাও বলিনি, কোনো বিষয়ে নিজের কোনো মতামত ব্যক্ত করিনি। এই যে প্রায় দেড় হাজার ঘণ্টা আমি পরিষদের মানুষদের পাঠ করেছি, এতে করে আমি প্রত্যেককে খুব ভালো করে জানতে পেরেছি, এই ঘরে আসা মানুষগুলোর মধ্য দিয়ে আমি জেনে নিয়েছি দেশের সকল মানুষের আচার-আচরণ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা।
আমি শিখেছি মানুষ কোন কথায় রাগ করে, কোন কথায় অভিমান করে, কোন কথায় খুশি হয়। শুধু তাই নয়, পরিষদের কার ঘটে কতটুকু বিদ্যা আছে এবং কোন বিদ্যা কখন কীভাবে তারা কাজে লাগান তাও শিখে নিয়েছি। আরও শিখেছি সাহিত্যের আলোচনা কীভাবে করতে হয়, কাকে উৎসাহ দিতে হয়, কাকে নির্মমভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে হয়।
পরিষদের গঠনতন্ত্রের একটি ছাপানো পকেট বুক ছিল। জিয়াউদ্দিন সাহেব চাইতেন আমরা সবাই যেন এই গঠনতন্ত্র ভালো করে পড়ি, বুঝি এবং তা মেনে চলি। আমি গঠনতন্ত্রটি প্রায় মুখস্ত করে ফেলি। এতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। সাংগঠনিক অবকাঠামো সম্পর্কে আমার ধারণা পরিষ্কার হয়েছে। পরবর্তী জীবনে যে সংগঠনেই গেছি, প্রথম বৈঠকে কথা বলার পরেই সবাই আমাকে সংগঠনের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে, আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার প্রায় কেউ ছিলোই না বলা চলে।
বহু সংগঠনের গঠনতন্ত্র আমি তৈরি করে দিয়েছি। পরিষদের গঠনতন্ত্র পাঠ ও বোঝার আগ্রহ আমাকে দেশের সংবিধান পাঠে আগ্রহী করেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চার্টার পড়ার প্রতি আগ্রহী করেছে। যখন যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেই প্রতিষ্ঠানের আইন-কানুন আমি খুব দ্রুত রপ্ত করে ফেলতে পেরেছি এবং এর সুফল চাকরি জীবনে পেয়েছে। আসলে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ, কোনো শিক্ষাই বিফলে যায় না। পৃথিবীর প্রতিটি ঘরই একেকটি বিদ্যালয়, দেখা হওয়া, পরিচয় হওয়া প্রত্যেক মানুষই একেকজন শিক্ষক।
কনক কবিতা লিখতে না পারলেও নিঃসন্দেহে ও একজন ভালো সংগঠক। মুহূর্তের মধ্যেই একটি সংগঠন গড়ে তুলতে পারে এবং একদল মানুষ জড়ো করে ফেলতে পারে। একদিন জসীম উদদীন পরিষদের সভায় এসে জানায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় পরিষদের একটি শাখা করতে চায়। ডাক্তার জিয়াউদ্দিন তো মহাখুশি। ঢাকার বাইরে শাখা হোক, আমরা সেখানে বেড়াতে যাই, এটা তিনি খুব চাইতেন।
কনকের ফুপুকে বিয়ে দিয়েছে নবীনগরের শিবপুর ইউনিয়নের কনিকাড়া জমিদার বাড়িতে। শিবপুরেই জন্মেছেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সুর সাধক উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তার ভাই উস্তাদ আয়েত আলী খাঁ।
কনিকাড়ার জমিদার রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী কনকের ফুপা। মেজো ফুপাত ভাই মান্নান চৌধুরী শিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, বড় ভাই হান্নান চৌধুরী শিল্পমনা মানুষ। হান্নান চৌধুরীকে সভাপতি এবং নিজেকে সাধারণ সম্পাদক করে কনক একটি কমিটি করে ফেলে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নবীনগরে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
কেন্দ্রীয় মহাসচিব রম্যকার ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি, আমি এবং পরিষদের আরো কয়েকজন বিশেষ অতিথি। আমরা লঞ্চে করে নরসিংদী থেকে নবীনগর ঘাটে গিয়ে নামি। নেমে দেখি সেখানে এলাহী কাণ্ড। আমাদের ছবি দিয়ে দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। একটি রিক্সায় করে মাইকিং করা হচ্ছে, এক তরুণ সুর করে আমাদের নাম উচ্চারণ করছে। এমনভাবে মাইকিং করছে যেন দেশের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক আমরা, অথচ ঢাকায় আমাদের কেউ চেনে না বললেই চলে।
আমি কনককে বলি, এসব কী? আমরা কী এত বিখ্যাত যে এভাবে আমাদের নামে মাইকিং হচ্ছে? বিষয়টা কিন্তু পরে খুব লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
কনক বলে, নবীনগরের কে কয়টা বই পড়েছে? প্রচার হলেই তো আপনারা বিখ্যাত হয়ে যাবেন।
কনক আসলে জানতোই না লেখকেরা প্রচারে নয়, ভালো লিখে বিখ্যাত হয়।
আমরা লঞ্চ থেকে নামার পরপরই নবীনগরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আমাদের অভ্যর্থনা জানান এবং স্কুলের ছোটো ছোটো মেয়েরা আমাদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। কলেজে পড়ুয়া, বিশেষ করে যারা মানবিক বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, আমাদের ঘিরে ধরে। কনক ও হান্নান চৌধুরী এমনভাবে এলাকায় আমাদের নাম প্রচার করেছে, তারা ভেবেছে আমরা ঢাকার খুব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক। তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে, রম্যসাহিত্য নিয়ে আমরা গাম্ভীর্য বজায় রেখে বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছি এবং বলা যায় এক্ষেত্রে আমরা বেশ সফলই হয়েছি।
আমাদের সঙ্গে ঢাকা থেকে আরো যারা গিয়েছিলেন তারা হচ্ছেন আলাউদ্দিন, সাঈদ আখন্দ, শহীদুল্লাহ সবুজ, আহসান হাবীব পিয়াল, গোলাম মোস্তফা তাপস এবং হেলাল মাহমুদ। সার্কিট হাউজ এবং বিভিন্ন বাসায় আমাদের ভাগ করা হয় রাত্রি যাপনের জন্য। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা উপজেলা শহরের একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিই, গান বাজনা করি, কবিতা পড়ি। প্রায় মাঝরাতের পরে একেকজন একেক বাসায় ঘুমাতে যাই। আমাকে একটি রিক্সায় করে নবীনগর সরকারী কলেজের প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রিন্সিপালের স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছেন, পুরো বাড়ি খালি। অনেকগুলো ঘর তার। তিনি আমাকে অফার করেন তার সঙ্গে মাস্টার বেডরুমে ঘুমাতে। আমি এতে খুব অস্বস্তি প্রকাশ করি, পরে আমাকে মাস্টার বেডরুমে ঘুমাতে দিয়ে তিনি অন্য একটি ঘরে চলে যান। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখি তিনি আমার পাশে ঘা ঘেষে শুয়ে আছেন। আমি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসি, তিনি বলেন, এই বিছানা ছাড়া ঘুমাই না তো তাই অন্য ঘরে ঘুম আসছিল না।
আমি তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারি এবং খাট থেকে নেমে বলি, ঠিক আছে, আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি।
পরদিন কনককে ঘটনাটি খুলে বলি এবং এর পরের দুইদিন আমি সার্কিট হাউজে ঘুমাই। প্রিন্সিপালের বাসায় অন্য অতিথি পরের দুই রাত ছিলেন, কিন্তু তাদের কেউ এইরকম কোনো অভিযোগ করেননি।
দ্বিতীয় দিন নবীনগর উপজেলা অডিটোরিয়ামে বিশাল সভার আয়োজন করা হয়। সভাপতিত্ব করেন উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক। জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আমি এবং ঢাকা থেকে আগত আরো কয়েকজন মঞ্চে বসি। আমি খুব সংক্ষিপ্ত একটি বক্তব্য রাখি এবং কবিতা পড়ি। আমার বক্তব্যে উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করি এবং বলি, আজ নবীনগরে যে প্রদীপটি আমরা প্রজ্জ্বলন করলাম তা যেন কোনো দিন নিভে না যায়। উপজেলা চেয়ারম্যান আমাদের খুব সম্মান করেন।
আমরা যে তিনদিন নবীনগরে ছিলাম সেই তিন দিন নবীনগর উপজেলা সদরে একটা উৎসব আমেজ ছিল। সব দোকানে, রেস্টুরেন্টে, বাজারে শুধু সাহিত্যের আলোচনা। নবীনগর প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের মধ্যে একটা গণ্ডগোল লাগে, কাকে সম্মান দেয়া হয়েছে, কাকে দেয়া হয়নি, কাকে দাওয়াত দেয়া হয়নি, কে কার চেয়ে বড় সাংবাদিক এইসব নিয়ে হট্টগোল। হান্নান চৌধুরী যথেষ্ঠ প্রভাবশালী মানুষ, তিনি খুব শক্ত হাতে এইসব কোন্দল, দলাদলি দমন করেন।
এই যে একটি উপজেলা পর্যায়ে সাহিত্য নিয়ে একটি উন্মাদনা তৈরি হয়েছে আমি মনে করি এটিই আমাদের সফরের, এই অনুষ্ঠান আয়োজনের বড় সাফল্য। এই আয়োজনের জন্য কনকের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। পরিষদের একজন সদস্য আছেন শহীদুল্লাহ সবুজ। তিনি যেখানে যান সেখানেই মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নেন, সেই ধার আর কোনো দিন শোধ করেন না। পরে সবাই পরিষদের কাছে নালিশ করে। এই ভয়ে শহীদুল্লাহকে আমরা নবীনগরে নিতে চাইনি কিন্তু তিনি নিজ উদ্যোগে গিয়ে হাজির হয়েছেন।
তাকে নিয়ে আলাউদ্দিন প্যারোডো গান বানায়, সেই গান আমরা সবাই মিলে মেঘনা নদীর পাড়ে বসে মজা করে গেয়েছিও। তিনটা দিন আমরা সবাই শহীদুল্লাহ সবুজ ভাইকে চোখে চোখে রেখেছি যাতে এই দূর দেশে এসে তিনি পরিষদের কোনো বদনাম না করেন। চলবে