হত্যার পর নদীতে লাশ, ২২ মাসে ৪ জেলায় ৭৩ মরদেহ

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০২৫

খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলায় হত্যার পর নদী-খাল ও ডোবাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে মরদেহ ফেলার সংখ্যা বাড়ছে। ১ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে মরদেহ উদ্ধারের সংখ্যা। পচে-গলে যাওয়ায় এক তৃতীয়াংশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা ও হত্যাকাণ্ডের লাশ। নৌপুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানায়, উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে বেশির ভাগই স্থলভাগে হত্যার পর তা নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে

স্থানীয় ও খুলনা নৌপুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২২ মাসে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুর জেলার নদ-নদী ও খাল থেকে উদ্ধার হয় ৭৩টিরও বেশি লাশ। এর মধ্যে ২৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যেখানে ২০২৪ সালে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেখানে গেল ১০ মাসের মধ্যে অক্টোবর পর্যন্ত নদ-নদী থেকে ৩৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নৌপুলিশের তথ্যমতে, ২০২৪ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু খুলনার মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত আরও তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৭ অক্টোবর নিখোঁজের ৩ দিন পর দাকোপের বাজুয়ার চুনকুড়ি নদী থেকে আশিষ সরকারের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

একই দিনে পাইকগাছা উপজেলার সোনাদানা ইউনিয়নের শিবসা নদীর চর থেকে ইকরাম হোসেনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। এর আগের দিন ১৬ অক্টোবর পাইকগাছার জিরবুনিয়া খাল থেকে অজ্ঞাত (৪০) মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

উদ্ধার ও তদন্ত কাজে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা জানায়, হত্যাকাণ্ডের দুই ধরনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর একটি নবজাতকের মরদেহ, অন্যটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের মরদেহ। নবজাতক বাদ দিয়ে পূর্ণবয়স্ক মরদেহগুলো অর্ধগলিত হওয়ার কারণে পরিচয় শনাক্ত কঠিন কাজ। যেসব মরদেহের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় এবং নিখোঁজ জিডি আছে কিনা যাচাই করে পরিচয় পাওয়া গেলে সেগুলোর তদন্ত ভালোভাবে করা যায়।

যত হত্যাকাণ্ডজনিত মামলা আছে এর সবগুলোই নদীর ওপরে নয়, স্থলভাগে হত্যার পর ফেলা হয় নদীতে। মূলত মরদেহ নদীতে ফেলা হয় তথ্য ও প্রমাণ লুকানোর জন্য। মরদেহ উদ্ধারের তদন্তে লোকবল ঘাটতির কথা জানিয়েছে ‍পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, “খুলনাসহ আশপাশের জেলার নদ-নদীগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই মানুষের মরদেহ ভেসে উঠছে। এর অন্যতম কারণ ৫ আগস্টের পর পুলিশের ভূমিকা যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, সেভাবে নেই। পুলিশের নজরদারি সেইভাবে নেই এবং খুলনাসহ আশপাশের জেলায় র‌্যাবের একটা বড় ভূমিকা থাকতো, কিন্তু তারাও সেইভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যেভাবে বুক ফুলিয়ে দেশের জন্য পুলিশ কাজ করতো, সেভাবে করতে পারছে না। পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পর খুলনা অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটেছে। এই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে যেসব সন্ত্রাসী আত্মগোপনে ছিল, তারা এলাকায় ফিরে আসছে। তারাই এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। এছাড়া বিচার প্রক্রিয়া যদি দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা যায় তাহলে অন্যান্য অপরাধীরা ভয় পাবে।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও আধুনিক করার পরামর্শ জানিয়ে তিনি বলেন, “হত্যার পর যেসব মরদেহ ফেলে দেওয়া হচ্ছে তার অধিকাংশই অজ্ঞাত থাকছে। এসব লাশ শনাক্তের জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এগুলো শনাক্ত করা হলে অপরাধীদের সহজেই খুঁজে বের করা সম্ভব হতো।”

খুলনা নৌপুলিশ সুপার ড. মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, “নদীতে ৩ ধরনের মরদেহ পাচ্ছি। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনাজনিত। গোসল করতে গিয়ে, নৌকা থেকে পড়ে, পরস্পর নৌকা-ফেরিতে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছে এমন। দ্বিতীয়ত কিছু আত্মহত্যার ঘটনা পাওয়া যায়। আর তৃতীয়ত আমরা কিছু পাচ্ছি হত্যাজনিত। হত্যার মধ্যেও আবার ২ ক্যাটাগরি রয়েছে। একটি নবজাতক। এক-দুই দিন বয়সী নবজাতককে তার বাবা-মা ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। আর পাচ্ছি বয়স্ক হত্যাজনিত। এসব ঘটনায় মামলা নিয়ে তদন্ত করছি। তিন ধরনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের লাশ বেশি পাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “নদ-নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গতবার পুরো বছরে যে পরিমাণ মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল, এবার ৮ মাসেই (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) সেই পরিমাণ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরেও সেটি বেড়েছে। আমাদের জনবল সংকট থাকলেও সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা।”