রাশেদ শাহরিয়ারের কবিতা ‘দ্রবীভূত দিনের জলচিহ্ন’

প্রকাশিত : মে ৩১, ২০২৫

১.
বৃষ্টির গোধূলি, এই শহরে কেমন যেন একটা অস্পষ্ট গন্ধ নিয়ে আসে, যেন পিচের মধ্যে আটকে থাকা কোনো অজানা পাখির পায়ের ছাপ। রাস্তায় আলো-আঁধারি বৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু আকাশে ওড়ে না কোনো শালিক, কোথাও নেই ভেজা কাঠের গন্ধ, কোথাও নেই নদীর ধারে বাচ্চাদের হাঁস দিয়ে খেলা। শহরের কোনো বাতাস নেই, শুধু ধোঁয়া আর কার্বনের ভেতর বৃষ্টির কণারা ভিজে ওঠে। সেই দিনগুলোকে মনে পড়ে, গরুর গাড়ির দিকে তাকালে দেখা যেত, সেও থেমে যাচ্ছে বৃষ্টির মাঝে, আর তার পায়ের নিচে গোলাপি নদী। আজ সেই শালিকের পাখা শুধু স্মৃতির আকাশে ওড়ে, চলে যায়।

২.
শহরে আজ বৃষ্টি নামে, রিকশার চালক হাঁটতে হাঁটতে থামে, কাঁধের গামছা ভিজে একাকার হয়ে যায়, আমি তাকিয়ে দেখি, জল জমে রিকশার চাকার নিচে, অথচ মনে পড়ে, ছোটবেলায় গ্রামে, বৃষ্টির পর মাঠের কাদায় আমার পা ঢুকে থাকত, মাটির নরম গন্ধ আমাকে ঘিরে থাকত, মা বলতেন, ‘এগুলো এখনো শুকাবে না, ছেলেমানুষি করে ফেলো না।’ অথচ আমার তো মনে হতো, সেই কাদায় পুরো পৃথিবী লুকিয়ে আছে। শহরের রিকশায় কেবল গোলমাল, দুর্ঘটনা আর অচেনা মুখের গড়নে আটকে থাকে শুধু হতাশা, না থাকলে কেন সেই কাদা, কেন একটুকু শিথিলতা?

৩.
বৃষ্টির দিনে যখন জানালার কাচে টুপ টুপ করে পানি পড়ে, তখন মনে হয়, বৃষ্টি পৃথিবীকে যেন শুয়ে থাকার একমাত্র উপায় শিখিয়েছে, যেন শহরের এই উচ্চশ্বাস প্রতিদিনের কাজকর্মের মাঝে, কেউ একবারও দাঁড়িয়ে দেখতে চায় না আকাশটা কেমন ঝলমলিয়ে আছে, মনে হয়, যেন আশপাশের দালানগুলোতেই আমার চোখ ঢেকে থাকে। আর আমার গ্রামে, জানালার বাইরে বৃষ্টি আসত পেছনের বাগান থেকে, যেখানে পাখির বাসা ছিল, যেখানে মাছ ধরা ছিল, যেখানে গাছের ছায়ায় সবকিছু এক হয়ে গেছে। এই শহরের পেছনের জানালার সামনে জল শুধু একে একে সরে যায়, একেকটি নিঃশব্দে চলে যায়।

৪.
শহরের বৃষ্টিতে ড্রেনের গন্ধ ভেসে আসে, আর ড্রেনের ওই অতল স্রোতে ভেসে যায় আমার মনে শোনা এক নিঃশব্দ কান্না, সেই কান্নার ভাষা নেই, কেবল ফুটপাথে ভেজা সিগারেটের রেখায় ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু আমি জানি, সেই কান্না আর কোথাও হারিয়ে যায় না, মাটির মতো মিষ্টি, মাটির মতো অসহায়, যে মাটিতে জন্মেছিলাম, যে মাটির পথে একসাথে হাঁটতাম, এখন সেই মাটি, এই শহরে কোথাও নেই। আমি কেবল চোখের কোণে মনে করতে থাকি— ধীরে ধীরে, কুড়িয়ে নিতাম ছিপ, আর খালপাড়ের জল থামিয়ে, চোখে বসিয়ে ফিরতাম নদীটাকে।

৫.
শহরের বৃষ্টিতে আজও শোনাতে শোনা যায়, শুধুই মফস্বল শহরের সুর, ছাতা খোলা স্নিগ্ধতাতে ভরা, ভিজে যায় চোখ, চোখের পল্লবে বৃষ্টি আসে, যখন ছাতা নিয়ে এগিয়ে যাই, ঠিক তখন চোখে দেখি— খালটি শুকিয়ে গেছে, আর সেই পুরনো সুর এখন শহরের মধ্যে চাপা পড়ে যায়। সেখানে শুধু একের পর এক রিকশা, এক এক সিগন্যাল, আর ফুটা ফুটা গান। তবে আমার গ্রামে বৃষ্টি মানে ছিল গোলপাতা, যেখানে ছাতা নেই, শুধু এক গাঢ় মৃদু সুরে গান উঠত; “এই আকাশে সঙ্গীত ভাসুক…” তখন মাটির গন্ধে আমি কেবল আকাশের সুরে গান করতাম।

৬.
এই শহরে, বৃষ্টির দিনগুলো রাস্তায় হেডলাইটের আলোয় ভিজে যায়, আর তারপর শহরের শরীরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, যে জল তুমি ধোও, সেই জলও যেন ক্রমাগত যেন মুছে যাচ্ছ, ঢেকে যাচ্ছে এই জীবনের নকশা, একে একে কেটে যাচ্ছে ছায়াগুলো। গ্রামে, বৃষ্টির দিনে আমরা কোনো একটা থালায় জড়ো করতাম, তারপর চালের ঝাড়ে বসে, পুকুরের কাছে অপেক্ষা করতাম। কোনো গাড়ির হেডলাইট আমাদের কখনও ঘিরে রাখেনি, তবে সেই দিনের বৃষ্টিতে চোখে ছিল শুধুই নিরন্তর শুদ্ধতা, যেখানে স্মৃতি ছিল নিখুঁত, যেখানে পৃথিবী ছিল সংযত।