রথো রাফির গদ্য ‘পঁচিশ পয়সার জোছনা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২

কিছুই করছ না, শুধু সময়কে বয়ে যেতে দিচ্ছ। তাহলেও ঘণ্টাপ্রতি ৫৫ টাকা ব্যয় হয়েই যাবে। ব্যয়ের এই স্রোত তুমি থামাতে পারবে না। যদি নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিক হতে চাও এ শহরে, মানে এ ঢাকায়। বলো তো, তোমাকে কি আদৌ বিষণ্নতা মানায়! তবু দশ বছরে তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিষাদের গর্তে তুমিও কিনা ঢেলেছো অন্তত তিন লাখ টাকা।

প্রথম ছয়মাস কিছুই নয়, নিরন্তর নীরব বিষণ্নতা। তাহলে? ছয় বিশে এক লাখ বিশ হাজার ব্যয় করে ফেললে, নিজের অজান্তেই। এ সময়ে কোনো আয়ই তুমি কররলে না।

পরবর্তী ছয়মাসও তুমি আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওনি। তাহলে, ছয় বিশে একলাখ বিশ হাজার। পরের বছরটা প্রতিদিনই অন্তত দুই ঘণ্টা করে এবং তৃতীয় বছরেও অন্তত দিনে ঘণ্টাখানেক এবং চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে আধাঘণ্টা করে এবং ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে প্রতিদিনই গড়ে মিনিট পাঁচেক তার স্মৃতি তোমার মগজটা দখলে নিয়েছে।

এখনও প্রতিদিন একমিনিট বা আধা মিনিট। এর মানে দ্বিতীয় বছরে ৬০ গুণ ৩৬৫ মানে ২২ হাজার। তৃতীয় বছরে ১৩ হাজার। চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে ১৮ হাজার। এবং ষষ্ঠ থেকে দশম বছরে ৬ হাজার। তোমার মাঝে এখনও এই অপচয়ের একটা চিকন স্রোত রিনরিন করে বইছে। তোমার যোগ্যতা অনুযায়ী এত শুধু টাকার অঙ্কে তোমার অপব্যয় হয়ে যাওয়া সময়ের হিসেব মাত্র।


তুমি জানো, তার জন্য এখন এই তিন লাখ টাকা নেহাতই হাতের ময়লা, মাত্র দুই মাসের আয়। আর তুমি এখনও ঠিক নাগরিক হওনি, সময়টা এখনও তোমার কাছে টাকার হিসেবে ধরা দেয় না। শুধু ভাবো, জীবনের দশটা বছর অপচয় হয়ে গেল। নিজের প্রজন্ম থেকে তুমি কত না পিছিয়ে গেলে! আর ভিন্ন রকম হয়ে গেল গোটা জীবনটা।

আর তুমিও তো জানো, সময় প্রত্যাবর্তনে অক্ষম! শুধু কালের রেখায় বলা যায়, যখন এমনটা ভাবছো, এই আজকের দিনে ৫ থেকে ৬টি ডিম পাওয়া যায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। ডিম মানে মুরগির ডিম। আর নিজের অজান্তে তুমি বিড়বিড় করে ওঠো, ওহ, সব কেমন ঘোড়ার ডিম হয়ে গেল!

তোমার শুধু হঠাৎ হঠাৎ মনে হবে, এ দেশেরই কবি তিনি। শহীদ কাদরী। তিনিও পঁচিশ পয়সার জোছনা কিনতে চেয়েছিলেন এ শহরে। হ্যাঁ, বাণিজ্যিক আলোয় তীব্রভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠা অভেদ্য অন্ধকারের পোশাক পড়া এই নীল রাজধানীতে। প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানিয়ে তার জন্য কত কিছুই না তিনি করতে চাইতেন। কিন্তু তারও মনে হতো, মাতৃজরায়ুতে ফিরে যাওয়াই বুঝি উদ্ধার।

এমন অলৌকিক ও অসম্ভব উদ্ধারের কথা ভাবতেও বাধ্য হতেন তিনি। তুমি ভাববে, যেন ভাবনাই সমাধান! যদিও ভাবনা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। আর আজ তুমিও ভাবো, কোথায় সেই পঁচিশ পয়সা, প্রয়োজনের অধিক যা, আনন্দের জননী, যা দিয়ে জোছনা কিনবে তুমি!

লেখক: কবি