
মারিয়া সালামের গদ্য ‘প্রাচুর্য ও মূল্যবোধ’
প্রকাশিত : মে ১১, ২০২৫
মাঝরাত বা রাতের দ্বিপ্রহর হবে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাগানের ঠিক এককোনায় যেদিকে আমাদের শৌচাগার ছিল, ঠিক তার সামনে কাঠের টুলের ওপর একা বসে আছি। মনে হচ্ছে, বড় পাত্রভর্তি ঘন কুয়াশা আর তার মাঝে কিছু বড় বড় গাছ, সেগুলোর ঠিক মাঝখানে টিমটিমে আলোর হারিকেন হাতে আমি। আমার বয়স সবে আড়াই বা তিনবছর। ছোটবেলার প্রথম স্মৃতি বলতে এটাই বারবার সামনে আসে, ঝাপসা মতো চিত্র। পরাবাস্তবতা সম্ভবত এভাবেই প্রথম সামনে আসে আমার।
মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম কোনো কিছু কি কখনও ঘটেছে। হ্যাঁ ঘটেছে। সেদিন গভীর রাতে মায়ের শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ঘরে আমি আর মা একা। এরকম শীতের কয়েকশো ফুট দূরের শৌচাগারে তার একা যাওয়ার সাহস হয়নি, আমাকে ঘুম থেকে তুলে তার সাথে বাগানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল। সম্ভবত তখন থেকেই আমি আমার মায়ের নির্ভরতার জায়গা। আমার সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক খুব ঠাণ্ডা, অনেকটা গবেষণার বস্তু আর গবেষকের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক থাকে, সেইরকম।
মানে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু, অতিরিক্ত একবিন্দু নয়। এখানে আবেগের চেয়ে প্রয়োজন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার মায়ের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, সর্বগুণসম্পন্ন, তাত্ত্বিকভাব সফল সন্তান তৈরি করার। সেই চ্যালেঞ্জের প্রথম ধাপ আমি ছিলাম। নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশ হবার আগপর্যন্ত আমি সেই গবেষণার প্রতিটি ধাপে মাকে সর্বাত্মক আনুগত্য দেখিয়েছি। সেই ছোটশিশুর মননে যেভাবে গেঁথে গিয়েছিল, অন্ধকার রাতে কিভাবে মায়ের নির্ভরতার জায়গা হতে হয়, সেভাবেই আমার বেড়ে ওঠা।
আমাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। তবে মায়ের একটা ভরসা হচ্ছে, আমি আছি পাশেই, সে যত বড়ই ঝামেলা হোক। এই যে এরকম একজন মানুষ তৈরি করতে পারা, সেটা আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না। আমার পেছনে আমার মায়ের যে শ্রম আর ত্যাগ, সেটার কথা ভাবতে গেলে একটা অসম্ভব কিছু মনে হয়।
আমার মায়ের আমরা চারটি সন্তান। আমার নিজের সেই অর্থে বলতে গেলে ছয়টি। বলা হয়, মাতৃঋণ শোধ করা যায় না। আমি ভাবতাম, এসব সন্তান পালন করে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব। ছয়টি শিশুর পরিচর্যা আর সুরক্ষার পেছনে জীবনের আঠারোটি বছর পার করে এসে বুঝলাম, সন্তানকে প্রাচুর্য দিয়ে বড় করার চেয়ে মূল্যবোধ দিয়ে বড় করা কয়েকশো গুণ কঠিন কর্ম।
এই কাজটিই আমার ভয়াবহ প্রতিকূল পরিবেশে আর অর্থনৈতিক সংকটে থেকেও মা যতটা সহজে পেরেছিলেন, সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতিতেও আমার জন্য তা অনেক কঠিন মনে হয়।
আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি, হতাশ হয়ে যাই। তবে হাল ছেড়ে দেই না। আমার বিষয়ে আজ থেকে দশ, বিশ বা ত্রিশ বছর পরে আমার কোনো সন্তান এভাবে লিখতে পারবে কিনা, জানি না। তবে নিরন্তর চেষ্টা করি, যতদিন বেঁচে আছি, তাদের ভরসার জায়গা হয়ে যেন থাকতে পারি, যেরকম আছি আমার মায়ের ভরসার জায়গা হয়ে। জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি দেখেছি, কোনোটা নিজেই তৈরি করেছি, কোনোটা অন্যের তৈরি করা। আমি যেমন ভুগেছি, আমার সন্তানরাও ভুগেছে। আমরা একসাথেই এসব কষ্টের পথ চলেছি, এভাবেই একসাথে চলতে চাই যতদিন বেঁচে আছি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী