
চলচ্চিত্রের অমরত্ব: সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির বিবর্তন
পর্ব ১
রাজীব জবরজংপ্রকাশিত : মে ১০, ২০২৫
বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে চলচ্চিত্র যে কেবল একটি বিনোদন মাধ্যম তা কিন্তু নয়, বরং এটি মানব সমাজ ও সভ্যতার প্রতিচ্ছবি, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল এবং সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিশ্বজুড়ে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি এইসব চলমান চিত্রাবলি আমাদের গল্প বলা, ইতিহাসকে নথিবদ্ধ করা, সমাজের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করা এবং শৈল্পিক ভাবনার প্রকাশ ঘটানোর শক্তিশালী একটি মাধ্যম। যদিও চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং সময়ের সাথে সাথে এর ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতার কারণে কার্যকর চলচ্চিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আজ খুবই জরুরি। এই লেখাটির উদ্দেশ্য মূলত চলচ্চিত্র সংরক্ষণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান প্রযুক্তির প্রয়োগ ও চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দিগন্ত ও উদ্ভাবনসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা।
ক্ষয় ও ক্ষতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম
শুরুর দিকের ফিল্ম স্টকগুলির গঠনগত পরিবর্তনশীলতা ছিল চলচ্চিত্র সংরক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে একটি প্রধান উদ্বেগের কারণ। মূলত ব্যবহৃত সেলুলোজ নাইট্রেট ফিল্ম ছিল অত্যন্ত দাহ্য এবং রাসায়নিকভাবে ভঙ্গুর, যা সময়ের সাথে সাথে সহজেই ভেঙে যেত এবং প্রায়শই পাউডার বা ধুলোতে পরিণত হতো। এই অন্তর্নিহিত অস্থিরতার ফলস্বরূপ আগুন লাগা (দুর্ঘটনাজনিত ও ইচ্ছাকৃত, উভয়ই) এবং রাসায়নিক পচনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে ফিল্ম নষ্ট হয়ে যায় নানান সময়ে। নাইট্রেট ফিল্মের বিপদ এতটাই বেশি ছিল যে, এর জন্য বিশেষায়িত স্টোরেজ ও হ্যান্ডলিং পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল, যা আনুষ্ঠানিক সংরক্ষণ চর্চার ভিত্তি স্থাপন করে।
চলচ্চিত্র সংরক্ষণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল মূলত টেকসই অনুলিপি তৈরির ওপর জোর দেয়া , যাতে সময়ের সাথে সাথে ছবির গুণমান উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস না পায়। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক সংরক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্বও প্রাথমিক পর্যায়ে স্বীকৃত হয়েছিল। কারণ, এটি ছিল ফিল্মের পচন প্রক্রিয়াকে ধীর করতে সহায়ক। যদিও এই প্রাথমিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী রাসায়নিক পচনের জটিলতা ও অনুলিপি তৈরি প্রক্রিয়ায় ফিল্মের সম্ভাব্য গুণমান হ্রাস সম্পর্কে ধারণা ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
প্রথম দিককার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অর্থনৈতিক বাস্তবতার মূল মনোযোগ ছিল সংরক্ষণের তুলনায় লাভের দিকে বেশি। যার ফলে বাণিজ্যিক মূল্যের অভাব বা স্টোরেজের উচ্চ ব্যয়ের কারণে প্রচুর পরিমাণে ফিল্ম ধ্বংস করা হতো ইচ্ছাকৃতভাবে। ১৯৩৭ সালে ফক্স স্টুডিও ও ১৯৬৭ সালে এমজিএমের মতো বড় আর্কাইভের অগ্নিকাণ্ডগুলিতে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রের বিশাল সংগ্রহ অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছিল। এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলি বাণিজ্যিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চলচ্চিত্রকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৩৫ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট (মোমা) প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র সংরক্ষণ উদ্যোগগুলির মধ্যে একটি শুরু করে, যেখানে তারা প্রথম দিকের ফিল্ম কোম্পানিগুলির মূল নেগেটিভ ও গ্রিফিথের চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ তাদের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করে। একই বছর যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল ফিল্ম লাইব্রেরি (বর্তমানে বিএফআই ন্যাশনাল আর্কাইভ) প্রতিষ্ঠিত হয়। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল স্থায়ী মূল্যের চলচ্চিত্রগুলির একটি জাতীয় ভাণ্ডার তৈরি করা।
১৯৩৬ সালে প্যারিসে প্রতিষ্ঠিত হয় সিনেমাথিক ফ্রঁসেজ, যা চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। সিনেমাথিক ফ্রঁসেজ বহু মূল্যবান ফিল্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। আঠারোশো সালে যাত্রা শুরু করা লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসও ফিল্ম সংরক্ষণে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ১৯৪২ থেকে কপিরাইট নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া কাগজের প্রিন্টগুলির মাধ্যমে, যা অজান্তেই অনেক প্রাথমিক চলচ্চিত্রকে রক্ষা করে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিষ্ঠা চলচ্চিত্রকে কেবল বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে না দেখে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দিকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে। যেখানে বাণিজ্যিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থের বাইরে গিয়ে চলচ্চিত্র সংরক্ষণের একটি ডেডিকেটেড মিশন তৈরি হয়।
সংরক্ষণ প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ
১৯৫০ এর দশকের শুরুতে নাইট্রেট ফিল্মের বিকল্প হিসেবে সেলুলোজ ডায়াসেটেট ফিল্ম ব্যবহৃত হতে শুরু হয়, যা সেফটি ফিল্ম নামেও পরিচিত। এটি তুলনামুলকভাবে কম দাহ্য হওয়ায় নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হলেও পরবর্তীতে ভিনেগার সিনড্রোম নামের বিশেষ ধরনের ক্ষয়ের শিকার হতে দেখা যায়। ভিনেগার সিনড্রোমের ফলে ফিল্মের অ্যাসেটেট বেস অ্যাসিডিক অ্যাসিডে ভেঙে যায়। যার ফলে ফিল্ম সংকুচিত হয়, ভঙ্গুর হয়ে যায় এবং ভিনেগারের মতো গন্ধ বের হয়। ভিনেগার সিনড্রোমের আবিষ্কার প্রমাণ করে, নিরাপদ বিকল্প ফিল্ম স্টকও দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণে নিজস্ব চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। যার জন্য প্রয়োজন ছিল অনুকূল স্টোরেজ এবং হ্যান্ডলিংয়ের ওপর আরও গভীর ও বিশদ গবেষণার।
প্রাথমিক দিককার রঙিন ফিল্ম প্রযুক্তির সংরক্ষণও জটিল বিষয় ছিল। বিশেষ করে ইস্টম্যান কোডাকের তৈরি রঙিন ফিল্মগুলি সময়ের সাথে সাথে রঙের বিবর্ণতার শিকার হতো, যেখানে লাল রঙের স্তরটি বিশেষভাবে দুর্বল ছিল। যার ফলে ছবিতে লালচে আভা দেখা দিত। প্রাথমিক পর্যায়ে রঙিন ফিল্ম সংরক্ষণের সাধারণ সমাধান ছিল মূল রঙিন ফিল্মের সাদা-কালো অনুলিপি তৈরি করা। যা ছিল মূলত ছবির দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার নিরিখে। যেহেতু রঙিন ফিল্মের উজ্জ্বলতা ও নির্ভুলতা সংরক্ষণ করা ছিল অন্যতম প্রযুক্তিগত বাধা। যার জন্য প্রয়োজন ছিল ফটোকেমিক্যাল ও ডিজিটাল পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান ও কৌশলের।
বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ফিল্মের দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য সম্ভাবনাময় সমাধান হিসেবে আশা জাগায়। যা হ্যান্ডলিং, ডুপ্লিকেশন, স্টোরেজ এবং অ্যাক্সেসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। প্রাথমিকভাবে ডিজিটাল স্টোরেজ মাধ্যমের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ও অ্যানালগ ফিল্মকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরিত করার ফলে ছবির গুণমান হ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আর্কাইভাল সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় ছিল। তবে 4K, 8K এবং তারও বেশি উচ্চ রেজ্যুলিউশনের স্ক্যানারগুলির বিকাশের সাথে সাথে, ডিজিটাল সংরক্ষণ ক্ষেত্রটি ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফিল্ম সংরক্ষণ ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে, যা ডেটা পুনরুদ্ধার এবং ডেটা অ্যাক্সেসের সম্ভাবনায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
তবে একই সাথে ডেটা হ্যান্ডলিং, প্রযুক্তিগত ক্রমপরিবর্তনশীলতা এবং মূল অ্যানালগ মাধ্যমের সত্যতা বজায় রাখার বিষয়ে নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। চলবে