
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১০
প্রকাশিত : জুন ২৮, ২০২৫
জুন মাস। আকাশ খুব ঘন ঘন মেঘলা হচ্ছে। মেঘ ভেঙে যখন তখন বৃষ্টি পড়ছে। দেখতে দেখিতে বর্ষার পানি এসে রাস্তাঘাট ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিকেলে আমি হাঁটতে হাঁটতে তপনদের বাড়িতে যাই। জাহাঙ্গীর স্যার আমার দিকে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেন, জানস নাকি কাল-পরশু তোদের রেজাল্ট দেবে?
শুনেছি।
এবার নাকি পাসের হার খুব কম দিচ্ছে। তুরা পাশ করবি তো?
জাহাঙ্গীর স্যারের এই প্রশ্নটি আমার মধ্যে যারপরনাই বিরক্ত সৃষ্টি করে। আমি বলি `তোরা` মানে কী?
তুরা মানে তুই, তপন আর যারা এই এলাকা থেকে পরীক্ষা দিছস, তারা।
সবার কথা তো আমি জানি না। আমি শুধু আমার কথা জানি। পাসের হার দিয়ে আমি কী করবো? পাসের হারের ওপর তো নির্ভর করে না কতজন পাস করবে। বরং কতজন পাস করল তার ওপর নির্ভর করে পাসের হার কত হবে। পাসের হার কম দিচ্ছে এই কথাটার কোনো মূল্য নেই স্যার। আমি শুধু জানি, যদি সারা বাংলাদেশ থেকে একজন পাস করে, সেই একজন আমি। যদি আমি পাস না করি তাহলে যিনি আমার খাতা দেখবেন তিনি নাম্বার দিতে ভুল করেছেন।
তোর বেশি অহঙ্কার। এত অহঙ্কার ভালো না।
এটা অহঙ্কার না স্যার, আত্মবিশ্বাস। আমি তো জানি, পরীক্ষার খাতায় আমি কী লিখেছি।
মন খারাপ নিয়ে ওদের বাসা থেকে চলে আসি।
আমাদের নৌকাটা অনেক পুরনো হয়ে গেছে। সামনের গলুইয়ের দিকটা ফেটে গেছে, তলা দিয়ে পানিও ওঠে। একটা নতুন নৌকা কেনা দরকার। কাল বৃহস্পতিবার, কায়েতপাড়ার হাট। নৌকা কিনতে হাটে যাওয়া যায়।
পরদিন সকালে, রোদ-বৃষ্টি ঠেলে, একদল লোকের সঙ্গে আব্বা, আমি আর বিটন বড় একটা ডিঙি নৌকা ভাড়া করে কায়েতপাড়ার হাটে যাই। একটা কোশা নৌকা কিনি। আমি আরও বড় একটা নৌকা কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দামের কারণে আব্বা ছোটো একটা নৌকা কেনেন। হাট থেকে নানান রকম খাবার কিনে খাই। কায়েতপাড়ার হাট আমাকে নিয়ে যায় দূরের খাগাতুয়া গ্রামে। যেন আমি কোনাঘাটের হাটে বা মাঝিআরার হাটে অথবা শ্রীঘরের হাটে এসেছি।
চারদিকে উত্তাল ঢেউ, মাঝখানে এক চিলতে দ্বীপের মতো একটা হাট। এখানে নৌকা পাওয়া যায়, বাড়িঘর বানাবার জন্য বাঁশ, কাঠ, টিন পাওয়া যায়, নানান রকম খাবার-দাবার, তরিতরকারি, মাছও পাওয়া যায়। আমরা খেয়ে-দেয়ে ভর দুপুরে নতুন নৌকা পানিতে ভাসিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করি। যখন আমরা পানিতে আমাদের নতুন নৌকা ভাসাই তখনই কাছের কোনো মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসছিল।
ভৌগলিক দিক সম্পর্কে আব্বার জ্ঞান অসাধারণ। কূল-কিনারাহীন বিলের মধ্যে দিক নিশানা ঠিক রেখে কীভাবে নৌকা চালিয়ে আমরা তিনজন সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে আসতে পারলাম তা চিন্তা করে এখনও বিস্মিত হই।
ফিরে এসে শুনি, আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। আমাকে সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। তপনও পাশ করেছে কিন্তু অন্যরা পাস করেনি। লিটনের জন্য আমার খুব মন খারাপ হয়। লিটন খুব ভালো ও পড়ুয়া ছেলে। কারো সঙ্গে মারামারি করে না, খেলায় না নিলে রাগ করে না, মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখে এবং খুশিতে হাততালি দেয়।
লিটনের আম্মা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ওরা তিন ভাই লিটন, মিলন ও পান্না। মিলন ছিল নাদুশ-নুদুশ এক শিশু, বিটনের সহপাঠী, পান্না ছিল খুব রোগা, হ্যাংলা-পাতলা ও অস্থির। সারাদিন শুধু দৌড়াতো। সবাই বলত, ও মায়ের মতো পাগল হয়েছে। তখনকার দিনে মানুষ অটিজম সম্পর্কে কিছুই জানত না, আর এই ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের যে বিশেষ যত্ন দরকার তা অনুভব করত না। বরং সমাজ এদেরকে নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করত।
লিটনদের নিয়ে সবচেয়ে বড় বিদ্রুপ করেন ওর আব্বা হামিদ সাহেব। তিনি কিছুদিনের মধ্যেই ওদের তিন ভাইসহ ওদের আম্মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন, দ্বিতীয় বিবাহ করেন এবং বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে পাশেই একটি নতুন জমি কিনে পুনরায় বাড়ি করেন। আগের বাড়িটি তার নামে ছিল, নতুন বাড়িটি শুনেছি তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে। এটি তিনি এজন্য করেছেন যেন ওরা তিন ভাই তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে না পারে। একজন পিতা কী করে এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে!
নোয়াখালীতে লিটনরা কেমন আছে তা জানার একটা ব্যাকুল আগ্রহ আমি অনুভব করতাম। কিন্তু কখনোই তা জানতে পারতাম না। একদিন খবর আসে অ্যাপেন্ডিক্স বার্স্ট করে, প্রায় চিকিৎসাহীন, লিটন মারা গেছে। এই সংবাদ আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয় এবং মনে মনে লিটনের আব্বাকে খুব অভিশাপ দিই।
হামিদ সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে দুটি ছেলে হয়, তারা উচ্চশিক্ষিত হয়েছে, একজন ডাক্তার হয়েছে বলে জেনেছি কিন্তু মিলন এবং পান্নার কী খবর তা জানতে পারিনি। অনুমান করি, যদি বেঁচে থাকে, ওরা খুব মানবেতর জীবন-যাপন করছে। চলবে