
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১২
প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২৫
সারারাত আমি ঘুমুতে পারি না। অপেক্ষা নয়, এ-আমার প্রতীক্ষা। বড় হয়ে রফিক আজাদের কবিতা পড়ে যখন প্রতীক্ষা শব্দের অর্থ জেনেছি তখন বুঝেছি, কবির সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষাটা আসলে অপেক্ষা নয়, অবশ্যই তা প্রতীক্ষা। আমার কাছে কোনো কালেই একজন কবির চেয়ে বড় কেউ ছিল না, আজও নেই। কোনো সেনাপতি, কোনো রাষ্ট্রনায়কের শক্তি কবির একটি পঙক্তির কাছে বড় অসহায়, এই বোধ আমি ধারণ করি দূর শৈশব থেকেই।
সকালে আম্মাকে বলি, আজ আমি একজন কবির সঙ্গে দেখা করতে যাব।
এ-কথা শুনে আম্মাও আবেগে কেঁপে ওঠেন। হয়তো তিনিও বুঝে ফেলেন তার পুত্র বুঝি কোনো এক আলোর সন্ধান পেয়ে গেছে।
কবিপত্নী আমাকে বিকেল চারটায় যেতে বলেছেন, আমি সাড়ে তিনটায় চলে যাই। কবির জীর্ণ গৃহের আশপাশে হাঁটাহাঁটি করি। নিজেকে চিরকাল একজন সময়নিষ্ঠ ঘড়ি হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, প্রকৃতিও আমার এই ইচ্ছে পূরণে অকৃপণভাবে আমাকে সাহায্য করেছে। আমি যখন সেইভ দ্য চিলড্রেন ইউকে নামক একটি এনজিওতে কাজ করি, আমাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়মন মলিসন আমাকে একটি চিরকুট দিয়ে বলেন, তিন মাস পরে আমাকে মনে করিয়ে দিও। আমি সেটি ড্রয়ারে রেখে দিই। এরপর ভুলে যাই।
একদিন কোনো কারণে সেই ড্রয়ারে কিছু খুঁজছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সেই ছোট্ট কাগজের টুকরোটি পাই। সেটি পেয়ে আমার মনে পড়ে, হায় হায় আমি তো এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সায়মন না আমাকে তিন মাস পরে মনে করাতে বলেছিল। মাই গড, এখন কী হবে? সেখানে একটা তারিখ ছিল, গুণে দেখি আজই ঠিক তিন মাস হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা নোট লিখে সায়মনের টেবিলে রেখে আসি। বিকেলে সায়মন অফিসে এসে কাগজটি এবং আমার নোটটি পেয়ে ছুটে আসেন আমার অফিসে। এসে বলেন, তোমার মতো এতো অর্গানাইজড স্টাফ আমি খুব কম দেখেছি, আই অ্যাম সো ইম্প্রেসড।
সব কাজ সময়মতো করতে পারার আপ্রাণ চেষ্টা আমি করি, কখনো ভুলে গেলে প্রকৃতি আমাকে ঠিক এভাবে সাহায্য করে।
আমি বারবার ঘড়ি দেখি এবং ঠিক চারটায় কবির দরোজায় গিয়ে দাঁড়াই। ঘন কালো শশ্রুমণ্ডিত এক পুরুষ, গাঢ় শ্যামলা মুখের ওপর অতিরিক্ত উজ্জ্বল দুটি চোখ, আমাকে সেই চোখ শার্দুলের মতো গেঁথে ফেলে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলেন, বাদল, আসো। বসো এখানে।
কথাটা বলে তিনি চেয়ার থেকে উঠে খাটের ওপরে গিয়ে বসেন, আমার জন্য ঘরের একমাত্র চেয়ারটা ছেড়ে দেন। তিনি এমনভাবে আমার নাম বললেন যেন আমি তার ভ্রাত্যুষ্পুত্র, অথবা খুব নিকট আত্মীয় কেউ যার সঙ্গে প্রতিদিনই তার দেখা হয়। এরপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, বাদলকে কী খেতে দিবা? ভাত আছে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বলি, আমি ভাত খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়েছি।
ঠিক আছে, বাসায় বোধহয় বিস্কুট-টিস্কুট নাই, বসো, তোমাকে নিয়ে চা খেতে হোটেলে যাব।
আমি বসি, কবিকে দেখি। আমার হাতে মোটা একটা কবিতার খাতা।
আপনাকে আমার লেখা কবিতা দেখাতে চাই।
অবশ্যই দেখাবে।
তিনি খাটের ওপর বসে একটা ডাল দিয়ে ঘষে ঘষে দাঁতে গুল মাখছেন। মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আসলে তিনি কোথাও তাকিয়ে নেই, তার দৃষ্টি হয়তো এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও, খুঁজছে অনাবিস্কৃত কোনো সত্য। আমার চিন্তায় একজন কবিকে আমি যেভাবে এঁকেছি, কবি আমিনুল হক আনওয়ার ঠিক সেই ছবি। তার পরনে একটি চেক লুঙি, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পা তুলে খাটের ওপর বসে গুল দিয়ে দাঁত মাঝছেন। একটু দূরে, একই ঘরের পার্টিশনের ওপাশে তার স্ত্রী, খোলা দরোজা দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে, তাকিয়ে আছেন কবির দিকে, যেন কোনো একটি প্রশ্ন করে অপেক্ষা করছেন যুৎসই উত্তরের।
হঠাৎ কবি বলেন, পড়ো।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি তিনি আসলে কাকে বলছেন, এবং কী পড়তে বলছেন।
এরপর একটি প্রাণখোলা হাসি। এমন প্রাণখোলা হাসি একজন কবি ছাড়া আর কে হাসতে পারেন দারিদ্রের এমন এক অগ্নিকুণ্ডে বসে?
কবিতা এনেছ না?
হ্যাঁ।
পড়ো, খাতা থেকে পড়ে শোনাও।
আমি পড়তে শুরু করি। একটা পড়া হলে তিনি আমার দিকে হাত তুলে চোখ বন্ধ করেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, আরেকটা পড়ো।
এভাবে অনেকগুলো কবিতা শোনার পড়ে বলেন, খাতা বন্ধ করো।
আমি বন্ধ করি এবং তার মন্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। তিনি আমার কবিতা নিয়ে কোনো মন্তব্য না করে প্রশ্ন করেন, কার কার কবিতা পড়েছ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, কাজী নজরুল ইসলামের, জসীম উদদীনের...
বেশ। আর কারো?
ফররুখ আহমদ, বেগম সুফিয়া কামাল, বন্দে আলী মিয়া...
বুঝেছি। তুমি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বের হতে পারোনি।
আমি আসলে তার এই মন্তব্যের কোনো অর্থই বুঝিনি। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আবার কোনো কবি আছে নাকি? তখনও পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল সংবাদপত্রে যেসব কবিতা ছাপা হয় সেগুলোও পাঠ্যপুস্তকের কবিদের কবিতাই। পাঠ্যপুস্তকে ছাপা না হলে কেউ কি কবি হয়? বরং আমি মনে মনে ভাবছিলাম, কেন আমি আমিনুল হক আনওয়ারের কোনো কবিতা পাঠ্যপুস্তকে পেলাম না।
তিনি বলেন, তোমার মধ্যে একজন কবি বাস করে কিন্তু তাকে বের করে এনে পৃথিবীর মানুষকে দেখানোর যে দায়িত্ব তুমি অনুভব করছ সেজন্য তোমাকে অনেক চর্চা করতে হবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক ধৈর্য ধরতে হবে, দারিদ্র্যকে ভালোবাসতে হবে, তুমি কি তা পারবে?
প্রশ্ন করা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে আমি উত্তর দিই, অবশ্যই পারব।
বেশ। এবার পকেট থেকে বিশটা টাকা বের করো।
আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ খুলে বিশ টাকা বের করি। তিনি টাকাটা হাতে নিয়ে বলেন, এটা তোমার গুরুদক্ষিণা।
আমি কিছুটা আহত হই। তার প্রতি শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা কমতে থাকে। বিশটা টাকা নিয়ে নিলো?
তার গুলমাজা শেষ হলে একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেন, আমার সামনেই আন্ডারওয়্যার ছাড়া প্যান্ট পরেন, এক জোড়া রাবারের স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বলেন, চলো।
আমি তার পেছন পেছন বেরিয়ে আসি। আমরা হোসেন মার্কেটের জিওস পুকুরের ওপর মাচা দিয়ে নির্মিত একটি রেস্টুরেন্টে বসি। পায়ের নিচে কাঠের মাচা, ফাঁক দিয়ে নোংরা পানি দেখা যায়। চা ও ডালপুরি খাই। তিনিই বিল দেন। আমি বিল দেবার কোনো চেষ্টাই করিনি। কারণ এরই মধ্যেই আমার কুড়ি টাকা গেছে। আর গচ্চা দিতে চাই না। বিল দেবার পরে তিনি আমার হাতে বিশ টাকা ফেরত দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার বিশ টাকা। তুমি আমার প্রতি বেশি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলে, সেই মুগ্ধতা কাটানোর জন্য তোমার পকেট থেকে বিশ টাকা ছিনতাই করেছিলাম। এখন তুমি একটা ভারসাম্যে এসেছ।
আমি বাকরুদ্ধ। এমন অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি আর কখনো হইনি। কবিরা কি এইরকমই হয়?
শোনো বাদল, তুমি একজন কবি এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তোমাকে একজন আধুনিক কবি হয়ে উঠতে হবে। তোমার কবিতাগুলোকে এডিট করতে হবে। অন্তমিলে কিছু ভুল আছে। তবে তোমার ছন্দ ভালো। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তুমি কবিতাগুলো লিখেছ। তোমাকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ শিখতে হবে। সেটাই আধুনিক কবিতার ছন্দ।
কীভাবে শিখবো?
আধুনিক কবিদের বই পড়ে, ছন্দের বই পড়ে।
আপনি শেখাতে পারবেন না?
পারবো, কিন্তু তুমি শিখতে পারলে কিনা তা বোঝার জন্য তোমাকে প্রচুর আধুনিক কবিতা পড়তে হবে।
কোথাও পাব আধুনিক কবিতা?
বইয়ে পাবে। পাঠ্যপুস্তকে নয়। বুক স্টলে গিয়ে তাদের বই কিনতে হবে।
কাদের বই?
তুমি কি কবি শামসুর রাহমানের নাম শুনেছ?
না।
আল মাহমুদ?
না।
জীবনানন্দ দাশ?
না।
এখন শুনলে। এই তিনজন কবির বই সংগ্রহ করবে, তাদের কবিতা যতটা পারো, পড়বে।
আপনার কাছে তাদের বই আছে?
আছে। দিব তোমাকে। শুধু বই ধার করে পড়লে হবে না। নিজেও কিনতে হবে।
আচ্ছা।
চলো তোমাকে আজ এক জায়গায় নিয়ে যাই।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় যাই। রম্য রচয়িতা ডাক্তার জিয়াউদ্দিন সাহেবের বাসায়। রোজ বিকেলে সেখানে কবি-লেখকদের আড্ডা বসে। সেদিন থেকে আমিও সেই আড্ডার একজন হয়ে যাই। চলবে