
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১৭
প্রকাশিত : জুলাই ১০, ২০২৫
আমার একটি নতুন টিউশনি হয়েছে। মধ্য বাড্ডা স্কুল-রোডের ওপর একটি নামকরা টেইলর হাউস ছিল, প্রফিসি টেইলার্স, ওখান থেকে ডানে বাঁক নিয়ে খানিকটা বাঁ দিকে গেলেই একটি খোলা মাঠের পাশে বড়োসড় এক টিনশেড বাড়ি। এই বাড়ির তিনজন ছেলে-মেয়ে সদরুদ্দিন, সাবিনা এবং আমিনাকে পড়াতে হবে। টিউশনিটি জোগাড় করে দেন এরশাদ মাস্টার। এরশাদের সঙ্গে নুরুল ইসলামের লজিং মাস্টার মিজানের বন্ধুত্ব ছিল, যদিও এরশাদ বয়সে অনেক বড়ো, শুনেছি গ্রামে তার বউ, বাচ্চা আছে কিন্তু তিনি ঢাকায় লজিং থেকে চাকরি করেন।
এও শুনেছি, তিনি মাস্টার্স পাস করে কোনো একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করেন। হিসেবটা কিছুতেই মিলছে না, মাস্টার ডিগ্রি পাস করা একজন মানুষ, প্রাইভেট ফার্মে ভালো চাকরি করেন, স্ত্রী, সন্তান আছে, তিনি লজিং থাকবেন কেন? তার তো ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া করে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখের সংসার পাতার কথা। শুধু তাই নয়, তিনি যে বাড়িতে লজিং থাকেন সেই বাড়ির বাচ্চাদের পড়াবার জন্য আমাকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে রাখা হয়েছে। এরশাদ মাস্টারের বিষয়টা বড়ই রহস্যময়।
একজন মাস্টার লজিং রাখার জন্য তো একটা ঘর দিতে হয়, তাকে তিনবেলা খাওয়াতে হয়, বেশ একটা খরচ আছে। এতসব করে আবার বাচ্চাদের পড়াবার জন্য বাড়তি টাকা দিয়ে আরেকজন প্রাইভেট মাস্টার কেন রাখা হবে?
অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এই রহস্যের জট খুলে গেছে। এরশাদ মাস্টার এই বাড়িতে লজিং ছিলেন বটে, এখন তিনি এ-বাড়ির জামাই, তাদের বড় মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েছেন। গ্রামে যে তার আরেকটি সংসার আছে এই কথাও নাকি সত্যি। রহস্য আরো একটি উন্মোচিত হয়েছে। আমাকে রাখা হয়েছে শুধু পড়াবার জন্য না, তাদের দ্বিতীয় কন্যা সাবিনার সম্ভাব্য পাত্র হিসেবে। এরশাদ মাস্টার নাকি অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে খুঁজে বের করেছেন।
সদরুদ্দিন দশম শ্রেণির ছাত্র৷ সাবিনা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে, আমিনা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ওদের আদি বাড়ি লালবাগ, একেবারে খাঁটি ঢাকাইয়া। সদরুদ্দিনকে ওরা ডাকে ছাদ্দু, সাবিনাকে ছাবিনা, আমিনাকে আমিনাই ডাকে। ছাদ্দু ও আমিনার গায়ের রং কুচকুচে কালো, সাবিনা ফর্শা ও মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়লেও নারীত্বের আভাস ওর দেহ ও মনে বিদ্যমান। আমিনা আমার সঙ্গে হেসে হেসে এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় দুলাভাইয়ের সঙ্গে রসিকতা করছে। সাবিনা আপ্রাণ চেষ্টা করে আমার সঙ্গে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলে আমাকে ইম্প্রেস করতে।
অল্প দিনের মধ্যেই আমি সব বুঝে ফেলি কিন্তু টিউশনিটা ছাড়তে পারছি না। কারণ আমার টাকার দরকার। রোজ বিকেলে পড়াতে এলে মুগলাই পরোটা, ডালপুরি, নুডুলস, সেমাই, জর্দ্দা এমন নানান মুখরোচক নাশতা খেতে দেয়। মাঝে মাঝে ফালুদা ও কুলফিসহ আরো নানান মজাদার ঢাকাইয়া খাবার-দাবার আসে। মালাই ভাসা চা তো আছেই। অনেকটা জামাই আদর।
ছাদ্দুর মাথা ভর্তি গোবর। যত পড়াই, যত বোঝাই কিছুই ওর মাথায় ঢোকে না। সাবিনা প্রথম কিছুদিন ভালোই করছিল হঠাৎ কী হলো, সেও ভাইয়ের পথ ধরে। একদিনও হোমওয়ার্ক করছে না, পড়া ধরলে কিছুই পারে না, এমন কী আগের দিন কী পড়ালাম সেটাও মনে করতে পারে না। পড়া জিজ্ঞেস করলে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর মিষ্টি করে হাসে। ছাদ্দুকে পড়া না পারলে বেত্রাঘাত করি, মাঝে মাঝে সাবিনাকেও পিটাই কিন্তু অমন সুন্দর একটা মেয়েকে পিটাতে খুব মায়া লাগে। ছাদ্দুকে আঘাত করলে চিৎকার করে কিন্তু সাবিনা কোনো শব্দ করে না, শুধু ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
আমিনা খুব শার্প, যা পড়া দেই সব ঠিক মত করে ফেলে। সাবিনা কেন হোম ওয়ার্ক করে নাই এই বিষয়ে রোজই আমিনা একটা কৈফিয়ত দেয়। আম্মির লগে লালবাগ গেছিল, ফুপ্পি আইছিল, আরো কত কী।
দুইদিন পরে ঈদ। আজ বৃষ্টি হয়েছে খুব। ভেবেছিলাম এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কাদা ঠেলে পড়াতে যাবো না কিন্তু না গেলে তো বেতনটা ঈদের আগে পাব না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাই। বেতনের টাকার সঙ্গে একটা ব্যাগ আমার হাতে তুলে দিল সাবিনার আম্মা।
মাস্টার সা`ব আপনের ঈদের বখসিস।
ব্যাগটা আমি আর ওখানে খুলি নাই। সত্যি কথা বলতে কী ঈদের আগে এইরকম অপ্রত্যাশিত একটা উপহারের প্যাকেট পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। বাসায় এসে আম্মাকে বলি, আম্মা আমার টিউশনি-বাড়ি থেকে ঈদের উপহার দিয়েছে।
আম্মার সামনে প্যাকেটটা খুলে দেখি একটি পাঞ্জাবী, একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটি শাদা লুঙ্গি। লুঙ্গি দেখে আমরা সবাই হাসতে হাসতে মরে যাই। ঈদের দিন মাস্টারকে লুঙ্গি উপহার দেয় এমন ঘটনা আর কখনো দেখিনি, শুনিওনি। ঈদের পর পড়াতে গেলে ওরা সবাই জিজ্ঞেস করে ঈদের উপহার আমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আমি বলি, লুঙ্গি কি ঈদের উপহার?
ছাদ্দু বলে, হ তো। বেবাকতেরেই তো আব্বা লুঙ্গি, পাঞ্জাবী আর গেঞ্জি দিছে, এরশাদ স্যাররে ভি।
পরে আমি এরশাদ মাস্টারকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, এটা ঢাকাইয়া প্রথা। ওরা প্রতি ঈদে সবাইকে নতুন লুঙ্গি, পাঞ্জাবি আর গেঞ্জি উপহার দেয়। নতুন লুঙ্গি পরে সবাই ঈদের নামাজ পড়তে যায়।
এই টিউশনিটা আমি খুব বেশি দিন করিনি। অল্প কিছুদিন পরেই ছেড়ে দিই। আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয় কি-না এই ভয়ে না। ছেড়ে দিই, কারণ ওরা পড়ালেখায় একদমই মনোযোগী না। আমার ছাত্র-ছাত্রী ফেইল করবে এই অপবাদ আমি নিতে পারব না।
ওটা ছেড়ে দিয়ে একটি নতুন টিউশনি নেই শাহজাদপুরে, ছাত্রের নাম সোহেল, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। দারুণ মেধাবী। ওকে পড়িয়ে খুব মজা পেয়েছি। খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। আমার জীবনে যত টিউশনি করেছি সম্ভবত সোহেলই ছিল সেরা ছাত্র। চলবে