কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ১৯

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২৫

শুক্রবারে কবি জসীম উদদীন পরিষদের সাহিত্যসভা শেষে যখন বাড়ি ফিরছি তখন আমিনুল হক আনওয়ার বলেন, তোমার জন্য একটা সুখবর আছে।

আমি ভেবেছি আজ পরিষদের সভায় আমি যে কবিতাটি পড়েছি সেটি নিয়ে হয়তো সভার নির্ধারিত আলোচকদের বাইরেও কেউ তাকে কিছু বলেছে, হয়তো কবিতাটির প্রশংসা করেছে।

তখনকার দিনে এইটুকুই আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল। কারো একটি কবিতা কোথাও ছাপা হলে বা সাহিত্য সভায় পড়া হলে সেটি নিয়ে কে কী বলেছে, কোন চায়ের আড্ডায় কবিতাটির চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, এইসব জানার মধ্য দিয়েই আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম।

কাগজে ছাপা হওয়া ছিল একটি বিরল ঘটনা, কালে ভদ্রে খুব বড় কবির কবিতাও দৈনিকের পাতায় ছাপা হতো। পত্রিকার সংখ্যা কম ছিল, এর মধ্যে ভালো পত্রিকা তো ছিল মাত্র দুটি, ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা। সংবাদ তখনই মৃতপ্রায়। দৈনিক বাংলার অবস্থাও তত ভালো না, তবুও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। তবে দৈনিক বাংলা হাউজ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা বেশ রমরমা।

তিনি বলেন, গতকাল কাজী সালাহউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তোমার প্রসঙ্গ উঠল।
কী বললেন?
বললেন, ছেলেটা তো ভালোই লেখে।
আমি খুশি হই এবং কিছুটা লজ্জা পাই। লজ্জায় মাথা নিচু করে মাটির রঙ দেখতে শুরু করি।

লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। কবিদের সব সময় মাথা উঁচু করে হাঁটতে হয়। তুমি একজন কবি, কবি মানে বাদশাহ, তোমার চেয়ে বড় কেউ নেই, কাকে তুমি সমীহ করবে, কাকে ভয় পাবে? কখনো কারো প্রতি মাথা নত করবে না।

আমি কিছু বলি না। অবাক হয়ে এই হতদরিদ্র মানুষটির কালো শশ্রুর দিকে তাকিয়ে থাকি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তার সেই বিভক্তরেখার ওপর এসে দাঁড়াই, যেখান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হবো।
যাই, বলে আমার পথে পা বাড়াই, তিনি পেছন থেকে ডেকে ওঠেন।
সুখবরটা শুনে গেলে না?
ও, হ্যাঁ, তাইতো।

আমি আবার কয়েক পা পেছনে হেঁটে ফিরে আসি। বেশ রাত হয়েছে। শীতের রাত। কুয়াশা পড়ছে। তখন বাড্ডার রাস্তায় কোনো স্ট্রিট লাইট ছিল না। সর্বত্র বিদ্যুৎও ছিল না। কোথাও একটা বাতি দেখা গেলে সেই আলোটা ছিল কুয়াশা-আক্রান্ত, একটি বড়ো ফানুষের মতো ম্রিয়মাণ আলোর পিণ্ড হয়ে সেটি জ্বলছিল।

তিনি রাস্তার ওপর থেমে দাঁড়িয়ে আছেন। একটি ধুসর রঙের সুতির শাল দিয়ে তার দেহ আবৃত। আমি কবির গা ঘেষে দাঁড়াই।

তিনি বলেন, কাল শনিবার না?
হ্যাঁ, শনিবারই তো। আজ শুক্রবার গেল না? সাহিত্যসভা ছিল।
কাল আজাদের সাহিত্য পাতায় তোমার কবিতা ছাপা হবে।
আমি হঠাৎ এই খবরটা পেয়ে এত খুশি হই। কবিকে জড়িয়ে ধরি এবং জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদে ফেলি।

তাকে বিদায় দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। আকাশে কুয়াশা ভেজা শীতের চাঁদ। আমার মাথায় আশির্বাদের জ্যোৎস্নাবৃষ্টি হচ্ছে। আজ রাতে পৃথিবীটা এত সুন্দর! সাঁতারকুল সড়কে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা জামগাছটি যেন এক অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে উঠেছে, যেন সে তার স্কার্ট ছড়িয়ে কুর্নিশ করছে আমাকে। নিজেকে এখন একজন বাদশাহ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।

বাসায় ফিরে আনন্দে, উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমুতে পারিনি। সকালে খুব বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। উঠেই মনে হয় আজাদ সংগ্রহ করতে হবে। নাশতা না খেয়ে, কাউকে কিছু না বলে, বেরিয়ে পড়ি। প্রায় দেড় মাইল পথ হেঁটে গুলশান ১ নম্বর গোল চত্বরে চলে আসি। এখানে, জ্যোতি সিনেমা হলের সামনে, দুজন হকার বসে, শুধু তাদের কাছেই আজাদ পাওয়া যায়।

কোনো সেলুনে বা কারো বাসায় কেউ আজাদ পত্রিকা রাখে বলে শুনিনি। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। দুজনের কারো কাছেই কপি নেই। আমি দেরি করে ফেলেছি। ওদের কাছে যে কয়টা কপি ছিল সব বিক্রি হয়ে গেছে। বিকেলে এই ঘটনা আমিনুল হক আনওয়ারকে জানালে তিনি বলেন, বিক্রি হবে না, আজ তোমার কবিতা ছাপা হয়েছে।

না খেয়ে হাঁটাহাঁটি করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আসলে আমি কি হেঁটে গেছি, আনন্দে বেহুঁশের মতো ছুটতে ছুটতে গেছি। একজন হকার বলে, কাগজটা কি বেশি দরকার?

ওর এই প্রশ্নে আমি আশাবাদী হই। জোগাড় করে দিতে পারবেন?
হ পারুম। কাইল আইসা নিয়া যাইয়েন, আমি আইনা রাখুম।
আরে ধ্যাৎ, আমার আজই লাগবে।
তাইলে এক কাম করেন। মালিবাগে যান গা। ওইহানে গেলে পাইবেন।
মহাখালী পামু না?
না, ওরা আজাদ রাখে না। মালিবাগে পাইবেন।
ঠিক তো?
শিউর।

আমি হাঁটতে হাঁটতে মধ্য বাড্ডা হয়ে রামপুরায় যাই, ওখান থেকে মুড়ির টিনে চড়ে মালিবাগ। হকারকে জিজ্ঞেস করার আগে বুক ঢিপঢিপ করছে। যদি সেও বলে কাগজ নাই। আমার কাছে মনে হচ্ছে এইখানে ব্যর্থ হলে আমি আত্মহত্যা করে ফেলতে পারি। এদিকে ক্ষুধায় নাড়িভুড়ি কামড়াচ্ছে।

মালিবাগে পেয়ে যাই। কাগজটি হাতে নিয়ে টাকা দিতেই ভুলে যাই। সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য পাতাটি বের করি। পাতা উল্টাতে গিয়েও বুক কাঁপছে, যদি আমার কবিতা না থাকে।

আছে। কবিতার নাম বাগান। নিচে কী সুন্দর অক্ষরে বোল্ড করে ছাপা হয়েছে কবির নাম, কাজী জহিরুল ইসলাম। আহা কী সুন্দর সেই অক্ষরগুলো। কবিতাটি আমি বেশ কয়েকবার পড়ি। ছাপার অক্ষরে, একটি জাতীয় দৈনিকে কবি হিসেবে আমার নাম ছাপা হয়েছে, কী সাংঘাতিক ঘটনা! কখন কাগজটি নিয়ে আম্মাকে দেখাবো এই উত্তেজনায় আমি ছটফট করছি।

ফুটপাত থেকে ছুটে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলে হকার চিৎকার করে ওঠে, এই যে ভাই, কাগজের টেকাটা?
ওহ, স্যরি ভাই, এই যে নেন।

টাকা দিয়ে ছুটতে ছুটতে বাসায় আসি। আনন্দে আম্মার চোখেও জল। আম্মা আমাকে সেদিন এত এত দোয়া করলেন। আম্মার এইসব দোয়া এবং ভালো ভালো কথা শুনে মনে হচ্ছিল, আমি সত্যিই একজন কবি হয়ে গেছি।

১৯৮৫ সালের শেষের দিকে, সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে, দৈনিক আজাদ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। চলবে