
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১৮
প্রকাশিত : জুলাই ১৩, ২০২৫
কলেজ জীবনের কয়েকটি ঘটনা বলি। টেবিল টেনিস রুমের দখল নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া, মারামারি হতো। আমি ও মিজান টেবিল টেনিস এডিক্ট হয়ে পড়ি। নিয়ম মেনে লাইন ধরেই আমরা খেলি, কখনো জোর করে কারো আগে টেবিলের দখল নিতে যাই না। কিন্তু কয়েকটি গ্রুপ আছে ওরা এক সঙ্গে, দলেবলে আসে এবং এসেই হৈ হৈ করে দুটো টেবিলের দখল নিয়ে নেয়। আমরা নিয়ম মেনে লাইন ধরে খেললেও যেহেতু সারাদিন কমন রুমে পড়ে থাকি, আমাদের ওপর অনেকেই বিরক্ত। ওরা যখনই খেলতে আসে, দেখে আমরা খেলছি।
একদিন কমার্স বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় আমরা হাঁটছি, কোত্থেকে খাটো একটি ছেলে এসে আমাকে ও মিজানকে সজোরে দুইটা থাপ্পড় মেরে দৌড় দেয়। ও আমাদের চেয়ে খাটো হওয়ায় আমাদের গাল অব্দি হাত তুলে থাপ্পড় দেবার জন্য দুবার লাফ দিতে হয়েছে। খাটো হলেও ছেলেটির হাতে অসুরের শক্তি, ভীষণ ব্যথা পাই ওর থাপ্পড়ে। কিন্তু ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে যায় আমরা কিছু বুঝে উঠবার আগেই সে ছাত্রাবাসের দিকে দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতে চিৎকার করে খিস্তি করে, আর যদি তগরে কমন রুমে দেখি, খাড়ায়া হোগা মারুম।
মিজান ও আমি গালে হাত দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং চোখ ঘুরিয়ে আশে-পাশে দেখার চেষ্টা করি এই লজ্জাজনক দৃশ্যটি আর কেউ দেখেছে কিনা, বিশেষ করে আমাদের ক্লাসের কোনো মেয়ে।
মিজান বলে, চল সায়েন্স বিল্ডিংয়ে যাই, ওখানে জাসদের পোলাপাইন আছে, অগরে নিয়া আসি, যেই হাত দিয়া হালায় থাপ্পড় দিছে ওই হাত কাইটা দিমু।
মিজানের সঙ্গে সায়েন্স বিল্ডিংয়ে যাই কিন্তু কাউকে পাই না। আমরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। তিতুমীর কলেজে কয়েকজন ছাত্রনেতা ছিলেন, বাসদের আব্দুল কাদের বাবুল ভাই ছিলেন তুখোড় বক্তা, তার পেছনে পেছনে কয়েক দিন মিছিলও করেছি। তিনি ক্লাসে ঢুকেই শিক্ষকদের সালাম দিয়ে বলতেন, জাস্ট দুই মিনিট সময় নিব। সঙ্গে তার এক দল সাঙ্গ-পাঙ্গ। শিক্ষককে থামিয়ে দিয়ে বাবুল ভাই স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল বক্তৃতা করেন। ক্লিন শেইভড এক পরিচ্ছন্ন যুবক, কখনো খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে আসেন, কখনো শাদা শার্ট পরেন। মাঝে মাঝে তার ঠোঁটের ওপর ছোটো করে ছাটা গোঁফও দেখেছি।
তিনি মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। আমরা এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মজিদ খান শিক্ষানীতি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। বাবুল ভাইয়ের বক্তৃতায় এই কথাই প্রাধান্য পেত। বাবুল ভাই ভালো বক্তা ছিলেন। অনর্গল কথা বলতে পারতেন কিন্তু তার বক্তৃতায় প্রাণ ছিল না, ফুটপাতের ক্যানভাসারের মত লাগত। বিশ্বাসযোগ্য মনে হত না। মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাবুল ভাইদের এই আন্দোলনই মূলত এরশাদ পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
আরেকজন ছাত্রনেতা ছিলেন জয়নাল ভাই। বড়ো চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি, তাকে দেখলেই নেতা বা কবি মনে হতো। তার ছিল মেয়েলি গলা, ভালো কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু তার গ্যাং ছিল, তার পেছনেও একদল ঘুরঘুর করত, সেই দলে দুয়েকজন মেয়েকেও দেখেছি কিন্তু বাবুল ভাইয়ের দলে কোনো মেয়ে দেখিনি। মেয়েরা হয়ত কবি কবি ভাব, বড়ো চুল, দাড়ি আছে এমন ছেলেদের পেছনে ঘুরতেই পছন্দ করে।
তিতুমীর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না অনেক বছর, সেই কবে সিরাজ ভাই ভিপি হয়েছেন, এখনও তিনিই ভিপি। পরবর্তীতে জয়নাল ভাই ও সিরাজ ভাই এরশাদের রাজনীতিতে যোগ দেন। জয়নাল ভাই তেমন বড় কোনো পদ পাননি। সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে গুলশান থেকে নমিনেশন পেয়ে এমপি হন। জয়নাল ভাই এমপি হতে না পারলেও এরশাদের আমলে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন বলে শুনেছি। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় গেলে আমার বন্ধু ডিআইজি মাসুম রাব্বানী ও সিরাজ ভাই আমাকে বনানী ক্লাবে খাওয়াতে নিয়ে যান। ওখানে পুরনো দিনের অনেক স্মৃতি রোমন্থন করি আমরা।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়টাতে আমি পুরোদস্তুর কবি। ছয় মাস, নয় মাসেও একবার চুল কাটাই না, ঠিক মত গোসল করি না, সারাদিন কবিতার ঘোরের মধ্যে থাকি। একদিন মিজানকে ফাঁকি দিয়ে লাইব্রেরিতে চলে আসি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিছুটা সময় একা থাকি। একা থাকলে নীরবে সে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, আমার কপালে নেমে আসা লম্বা চুলে হাত বুলায়, তখন মস্তিস্কের জমিনে সৃজনশীলতার একটি বীজ অঙ্কুরিত হয়, আমি লিখতে শুরু করি। সব সময় কাগজে লিখি না। মাথার মধ্যে একটা অলৌকিক খাতা আছে, সেখানে লিখে রাখি এবং সেইসব কবিতা আমি দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারি। ওই বয়সে আমার স্মৃতিশক্তি ছিল অতি উচ্চ পর্যায়ের।
একদিন আমিনুল হক আনওয়ারকে তার এক বন্ধু একটি টেলিফোন নাম্বার দেন। তিনি রাস্তা থেকে একটি স্টার সিগারেটের খালি প্যাকেট তুলে নেন। সেটি ছিঁড়ে ভেতরের শাদা অংশে টেলিফোন নাম্বারটি লিখে রাখেন। পাশে দাঁড়িয়ে আমি নাম্বারটি শুনি। কয়েকদিন পরে তিনি পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে সেই কাগজের টুকরোটি আর খুঁজে পাচ্ছেন না। আমাকে বলেন, বাদল সেদিন না তোমার সামনে একটা নাম্বার লিখে রেখেছিলাম। আমি তো পাঞ্জাবির পকেটেই রেখেছিলাম কাগজটা।
ফোন নাম্বার?
আরে মিয়া হ। ওই যে প্রেসের আতাহার আলী দিলেন, একটা সিগারেটের প্যাকেটে লিখলাম না, তোমার সামনেই তো, মনে নাই?
হ্যাঁ, মনে আছে।
বলো তো কাগজটা কী করলাম? নাম্বারটা যে এখন খুব দরকার।
আমি তাকে ৬ ডিজিটের নাম্বারটা বলি।
তিনি বলেন, ধুর মিয়া, ফাইজলামি করো?
না, সত্যি বলছি।
বলো কী, এতদিন পরে তোমার ফোন নাম্বারটা মনে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আমিনুল হক আনওয়ার সেই নাম্বার পুনরায় লিখে নেন, ফোন করে তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পান এবং এই কথা তিনি সবাইকে বলে বেড়াতেন, আমি নাকি বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
যখন আমার কবিতার খাতায় কবিতার সংখ্যা প্রায় একশো তখন আমি সব কবিতা মুখস্ত বলে দিতে পারতাম। যে কোনো অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে অনর্গল কয়েকটি কবিতা শুনিয়ে দিতে পারতাম। এতে অবশ্য বদনামও হয়েছে, কেউ কেউ স্বভাব কবি, চারণ কবি এইসব বলে কটাক্ষ করতেন। হয়ত এ কারণেই, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মস্তিস্কের মেমরি সেল থেকে সব কবিতা ইরেজ হয়ে গেছে।
কলেজের লাইব্রেরিতে তখন খুব একটা আসতো না কেউ। প্রায়শই দেখতাম আমিই একা শেলফের রো`গুলোতে হাঁটছি। বইয়ের রাজ্যে একা একা হাঁটতে আমার দারুণ ভালো লাগত। নিঃসঙ্গ এই সময়টা আমার ভীষণ প্রিয় ছিল।
যেহেতু কবি জসীম উদদীন পরিষদ করি, তাই জসীম উদদীনকে ভালো করে জানার একটা প্রবল আগ্রহ ছিল। তার কবিতা তো পড়েছিই, এবার তার গদ্যগুলো পড়তে চাই। শেলফ থেকে একটি বই টেনে বের করি, বইয়ের নাম `হলদে পরীর দেশে`। এটি কবি জসীম উদদীনের লেখা ভ্রমণের বই। যুগোস্লাভিয়া, ইতালি এইসব জায়গা ভ্রমণের অপূর্ব বর্ণনা। পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেইসব দেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির গভীরে। এই বইয়ের প্রথম গল্পটি পড়েই শিল্পী এস এম সুলতানের নাম প্রথম জানতে পারি।
আমি যখন হলদে পরীর দেশে হাঁটছি, মনে মনে খুঁজছি কোনো এক অচেনা পরীর ডানা, ঠিক তখনই হলদে পরী এসে হাজির। শেলফে সাজানো বই-পত্রের ফাঁকে, মাত্র এক ঝলক, এর পরই কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল। কী অপূর্ব দুটি চোখ, কাঁপা কাঁপা ঠোট, ফ্যানের বাতাসে উড়ছিল ওর কপালের চুল। সত্যিই কি কেউ এসেছিল? নাকি দৃষ্টিভ্রম।
আমি বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াই, ছুটে যাই। এই রো, সেই রো খুঁজি, পুরো পাঠাগার তন্ন তন্ন করে খুঁজি, কিন্তু কোথাও কেউ নেই, পুরো পাঠাগারে আমি একা। এও কী সম্ভব? এরপর সম্ভবত আমি সেই হলদে পরীকে পুরো ক্যাম্পাসে আরো বহুদিন খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাইনি। চলবে