জন কীটস ও ফ্যানি ব্রন

জন কীটস ও ফ্যানি ব্রন

জন কিটসের প্রেমের চিঠি

ভাষান্তর: হৃদ্য আবদুহু

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৯, ২০২২

লন্ডনের মুরফিল্ডসের একটি আস্তাবলে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর জন কিটসের জন্ম। তার পিতা ছিলেন আস্তাবল রক্ষক। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর কিটসের মা আবার বিয়ে করেন। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনিও মারা যান। এনফিল্ডের একটা স্কুলে কিটসের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৬ বছর বয়সে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। তার ইচ্ছে, কবিতা লিখবেন। কিন্তু গাই হাসপাতালে ওষুধ বিদ্যায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওষুধ বিদ্যার পেশা ছেড়ে কবিতা লেখায় মনোযোগ দেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কিটসের ভাই টম যক্ষায় আক্রান্ত হন। কিটস তার সেবাযত্ন করেন। ডিসেম্বরে টম মারা যান। এরপর কিটস তার বন্ধু চার্লস ব্রাউনের হ্যাম্পস্টেডর বাসায় চলে আসেন। এখানে ফ্যানি ব্রন নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী প্রতিবেশীর প্রেমে পড়ে যান কিটস। এরপর থেকেই কিটসের সৃষ্টিশীল সময় শুরু হয়। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে কিটসের য²ার লক্ষণ দেখা দেয়। জুলাই মাসে তার কবিতার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। তখন তিনি খুবই অসুস্থ। সেপ্টেম্বরের উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে কিটস ও তার বন্ধু জোসেফ সেভার্ন ইতালি চলে আসেন। তারা যখন রোমে পৌঁছান তখন কিটস আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। সেভার্ন তাকে যথাসাধ্য সেবাযতœ করেন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি কিটস মারা যান। তাকে রোমের প্রটেস্ট্যান্ট সিমেটারিতে কবর দেয়া হয়। কিটসের দর্শন ছিল, সুন্দরই আনন্দময়। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই ফ্যানিকে এই চিঠিটা লেখেন কিটস। চিঠিতে কিটসের উদগ্র কামনা প্রকাশ পেয়েছে। তবে তা শারীরিক কামনাই শুধু নয়, সেই কামনা সুন্দরের প্রতি তার তৃষ্ণা।

প্রিয়তমা,
তোমার চিঠি পেয়ে যে আনন্দ পেলাম, তা তোমাকে পাবার আনন্দের মতোই অনাবিল। বিরহ যে এত মধুর, আজ তা বুঝলাম। তোমার কথা না ভাবলেও তোমার সৌন্দর্যের জ্যোতি যেন আমায় উদ্ভাসিত করে আছে। মনে হচ্ছে, তুমি তোমার মাধুর্য ও কোমলতা নিয়ে সবসময় আমাকে ঘিরে আছ। আমার যন্ত্রণাময় দিন ও রাতের আসা-যাওয়ার মধ্যেও তোমার চিন্তা সুন্দরের প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। বরং তোমার না-থাকায় সেটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রেমের যে অমৃত তুমি আমাকে পান করিয়েছ, এর আগে সেই আস্বাদ আমি কখনোই পাইনি। প্রেম যে এত মধুর, তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। আগে আমার ভয় হতো, যদি প্রেমের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাই! তোমার প্রেমে আগুন আছে কিনা, জানি না। যতি তা থাকেও তবে আনন্দরসে ভিজে সে আগুন স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। পোড়ানোর ক্ষমতা তার নেই, আছে শুধুই আনন্দের জ্যোতি।

তোমার হরিণ-চোখ দুটো আনন্দের উৎস। তোমার ঠোঁট দুটো ধারণ করে থাকে আমার কাতরতা। যখন তুমি হাঁটো প্রতিটি পদক্ষেপে আমার দেহে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের ঢেউ। আচ্ছা তুমিই বলো, তোমার সৌন্দর্যের আরাধনা কেনই বা আমি করব না? তুমি জানো, সুন্দরকে আমি ভালোবাসি। এ ভালোবাসা তো সুন্দরের আরাধনারই আরেক নাম। ভালোবাসার মূলে রয়েছে চিরসুন্দর। আর তাই সে শাশ্বত, অনন্ত। ভালোবাসার অন্য কারণও থাকতে পারে। সে ভালোবাসাকে আমি শ্রদ্ধা করি, প্রশংসা করি। কিন্তু তা সুন্দরের ঐশ্বর্যে মহান নয়। সে ভালোবাসার বিকাশ পুরোপুরি হয় না। তার সৌরভে দশদিক সুরভিত হয়ে ওঠে না। তাই তোমার সৌন্দর্য নিয়ে আমার এত উল্লাস। একইসঙ্গে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, তোমার সৌন্দর্যের পরীক্ষা আর কোনো পুরুষকে দিয়ে করাতে হবে না। তোমার কাছে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছি। এখানে তোমার বিরহে কবিতা লিখে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছি। আমি যতই ভাবি যে, শুধু আমার জন্যেই তুমি আমাকে ভালোবাসো (আমার তো আর কোনো গুণ নেই) ততই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তীব্র হয়ে ওঠে। তুমি কি নারী? নাকি কবির কল্পনার কবিতা? নাকি দেবি? তোমার পাঠানো চিঠির অক্ষরগুলোর ওপর চুমু দিই কেন, জানো? তুমি যে সেখানে অমৃত মেখে রেখেছ! আমাকে প্রেম দিয়ে তুমি সুন্দরের প্রেমে মাতাল করে তুলেছ। বলো তো, কেন এত প্রেম দিলে? আমি দেখি আর শুনি। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি না।

জন কিটসকে লেখা ফ্যানি ব্রনের একটি চিঠি:

প্রিয়তম জন,
তোমাকে দুঃখ দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এ কথা তো অনেকবার তোমাকে বলেছি। যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কি কেউ দুঃখ দিতে পারে? আমিই যদি তোমার আনন্দ হই তাহলে সে আনন্দ তুমি চিরদিনই পাবে। তুমি বলো, ‘সুন্দর চিরদিনই আনন্দের উৎস।’ সুতরাং, আমি যদি সুন্দরী হই তবে আমি তোমার, তোমার চির আনন্দের উৎস। আর এটাই আমার পরম গৌরব। নারীজীবনের একমাত্র চাওয়াও আসলে এটাই। প্রেমিকা চায় প্রেমিকের হৃদমাঝারে চিরদিনের প্রতিষ্ঠা। আমি তোমার কাছেই থাকি কিংবা দূরে চলে যাই, তাতে তোমার আনন্দের কমতি কেন হবে প্রিয়তম? চোখের আনন্দ তো আনন্দ নয়, সে তো মোহ। মনের যে অনাবিল আনন্দ, তার নামই তো প্রেম। অনুভূতির সঙ্গে এই প্রেমের সংযোগ। তোমার হৃদয় সিংহাসনে যদি আমার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত, তাহলে আমাকে না দেখলে সে আসন টলে ওঠে কেন? তোমার দিক থেকে এটা কিন্তু মারাত্মক অন্যায়।

আমাদের ভাব-ভালোবাসা আর পাঁচটা সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকার মতো গতানুগতিক নয়। তাতে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা কি উচিত নয় হে সুন্দরের উপাসক? তোমার প্রেম যেন কখনো ক্ষয় না হয়। প্রেমিকার জন্যে তোমার আকাক্ষা যেন শুধু মুখের কথা না হয়। তোমার চিঠির প্রতিটি শব্দে যে প্রেম ব্যক্ত হয়েছে তা যেন শুধু নিস্ফল মন্ত্র না হয়। আমি জানি, তা হবে না। তবু তোমাকে একথা বলছি কারণ, হঠাৎ হঠাৎ তোমার ভেতর আমি দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি। সেই দুর্বলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াই তো প্রকৃত প্রেমিকার কাজ। এতে রাগ করো না।

ওগো প্রিয়, তোমার চিঠি পড়ে আমার কী যে আনন্দ হয়, লিখে তা প্রকাশ করা যায় না। তোমার প্রথম চিঠিটা যেদিন পাই সেদিনকার সেই অনির্বচনীয় আনন্দ আজও আমার সারা দেহে শিহরণ তোলে। আমাকে বলো, শপথ করে বলো, তুমি শুধু আমারই, আর কারো নয়। তুমি চিরদিনই আমার থাকবে। জীবনে-মরণে তুমি শুধুই আমার। আমিও তোমাকে বলছি, ঈশ্বরের সন্তান আমি মনেপ্রাণে তোমার। অক্ষয় হোক আমাদের প্রেম। শেক্সপীয়রের জুলিয়েট যেন আমার চেয়ে বেশি গৌরব অর্জন করতে না পারে। তাড়াতাড়িই তোমার বাহুর বন্ধনে ধরা দেব।