মিসবাহ জামিলের আত্মগদ্য ‘এড়িয়ে যাওয়ার মতো গল্প’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০২৩

এসএসসি পাস করে আম্মার তাগাদায় ভর্তি হয়েছি কম্পিউটার প্রশিক্ষণে। সপ্তায় চারদিন ক্লাস। কোর্স ছয় মাসের। এই সময় আমার মতো উড়নচণ্ডির জন্য অনেক বেশি। এদিকে আমি নব্য কবিও। কবিতা ও ছড়া লেখা আর অল্পস্বল্প বইপুস্তক পড়া ছাড়া অন্যকিছু ভালো লাগে না। আম্মা নানা কাজ শেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই বনিবনা হচ্ছে না। কিছুদিন যাতায়াত শেষে ফিরে আসি। সবকিছু যেন শত্রু শত্রু লাগে। মানুষ আমারে তেমন ভালো চোখে দেখে না। ভাবে উজবুক, অসামাজিক। দেখলে এমনভাবে তাকায়, যেন আমি হিংস্র বন্যপ্রাণী, এইমাত্র লোকালয়ে চলে এসেছি।

আম্মা আমার কর্মসংস্থানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কিছু একটা আমাকে তার করাতেই হবে। অন্যের ওপর আর কতদিন? ১৪/১৫ বছর তো অনেক সময়। সেই বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই তো আশ্রিতের জীবন। নিজের জীবন অন্যের কাঁধে আর কতদিন রাখব? এবার না-হয় নিজের জীবনটা নিজের কাঁধে তুলে নিই। এই হলো আম্মার কথা।

এদিকে আমার কিছু বন্ধুও আয়-রোজগারে লেগে গেছে। কেউ বাবার ব্যবসার সহযোগী, কেউ অন্য নানা কাজে যুক্ত। কিছু ছেলে আছে, যাদের বাপধন বিদেশে থাকে, তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। তাদের কথা হলো, লেখাপড়া করে এই দেশে কিছুই হবে না। আমাদের মতো অজপাড়াগাঁয় এসএসসির পরেই লোকজন ভাবে, ছেলে তো অনেক বড় হয়েছে, এবার কোনো কাজে লাগুক। অল্পকিছু লোক আছে, যাদের অনেক টাকা-সম্পদ। তারাই শহুরে ‘আধুনিকতার’ নাগাল পায়। ভাবে, পড়ালেখা করতে হবে। পরে দেশ আর বিদেশ যেখানেই হোক কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়া যাবে। কিন্তু আমরা তো তেমন নয়, আমাদের জীবন গলার কাঁটা। কবিরাজের কাছে দৌড়াতে হবে। সেই কবিরাজের নাম কাজকর্ম। আর দাওয়াই বা মেডিসিন হলো টাকা।

কিন্তু আমি এসব বুঝতে নারাজ। আমি কবি হবো। টাকা তথা পুঁজিবাদকে গোণার টাইম নাই। আমি গণমানুষের কথা বলব। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়ে বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনা পেয়ে বসলো। এ যেন এক ঘোর, কোনো বাউলের, পরমকে পাওয়ার। আমার সে পরমের নাম মুক্তি। মানুষের মুক্তি, বৈষম্যের বিলুপ্তি। সেই আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরব ছড়া ও কবিতার মাধ্যমে। নজরুল নজরুল একটা ভাব। কিছু কবিতা লেখি। যারা তিরস্কার করে না, এমন দু’চারজনকে দেখাই। কেউ প্রশংসা করে, কেউ ত্রুটি ধরে। আমার ব্যাপারগুলো ভালোই লাগে। কিন্তু তিরস্কারকারীদের এড়িয়ে চলতে লাগলাম। কতজনের সাথে যে সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল, তার সীমাসংখ্যা নাই।

তিরস্কারকারীরা আমাকে নানা অকথা-কুকথা শুনিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, আম্মাকেও নানা কথা বলতো। কবিতা লিখে পান্তাভাতও ঝুটবে না, এটা-সেটা কতকিছু। এদের কথা শুনে আম্মাও আমাকে সবসময় বকাঝকার মধ্যে রাখেন। আমি কিছুই বলি না। হাসিতে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যর্থচেষ্টা করি। কখনও বই কিনেছি দেখলে আম্মাও আরও কঠোর কথা শোনাতেন। কখনও ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করার চেষ্টা করতেন, শাসানির মাধ্যমে ঠিক করতে না পেরে। তোর বাপ নাই, ভাই নাই, নিজের হাল নিজেকেই ধরতে হবে। এসব নানা কথা। এর মধ্যে কিছু উচ্চশিক্ষিত আত্মীয়ের মধ্যে আমার কবিতা-ছড়া পৌঁছে যায়। তারা মোটামুটি প্রশংসাই করেন। উৎসাহ দেন। বলেন, আরও ভালো লিখতে হবে। নানা পরামর্শ দেন। আম্মার কাছেও আমার কবিতার প্রশংসা করেন। তখন থেকে আম্মা একটু নমনীয় হতে থাকলেন আমার ব্যাপারে। মাঝে মাঝেই বলেন, ‘তুই তোর কবি হও, সমস্যা নাই। কিন্তু কিছু একটা করার চেষ্টা কর। এই দুনিয়ার কেউ কারও নয়। নিজের উপায় নিজেকেই করতে হবে।’ নিন্দুকরা এবার নিন্দা করতে আসলে আম্মা আচ্ছামতো বকে দেন। বন্ধ হলো নিন্দুকদের প্রকাশ্য তৎপরতা। তবে আড়ালে তাদের তৎপরতা আজঅব্দি থেমে নেই।

আম্মা যেহেতু এবার নমনীয়, তাই কাতর হয়েই আমার ভালোর কথা, ভবিষ্যতের কথা বলছেন। ভালোর জন্যই তো বলছেন। কোনো কাজবাজ শেখা উচিত। সেই ইচ্ছা থেকেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া। ক্লসে আসাযাওয়া চলছে রুটিনমতো। আমি ছাড়া আর কোনো ছেলে নাই ওই শিফটে। সবাই মেয়ে। ৮ থেকে ১০ জন। আনন্দের সঙ্গেই এগোচ্ছে কম্পিউটার শিক্ষা। দিনে দিনে শেখার আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠছে। বিভিন্ন বিষয় সবার আগেই আমি আত্মস্থ করে ফেলি। প্রশিক্ষক বাইরে গেলে, মেয়েরা আমাকে এটাওটা জিগ্যেস করতো। ওদের সঙ্গে ভালো একটা বোঝাপড়া হলো। যদিও আমি একটু লাজুক স্বভাব ছিলাম। একদিন একটা মেয়ে আমার ফোন নম্বর চাইল। হোয়াটসঅ্যাপে কথা চালাচালি হলো। নানান বিষয়ে আলাপ হলো। এভাবে কিছুদিন গেল। একদিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমি আর ওই মেয়েটি। স্বপ্না রানী দাস। একটা বিষয়ে জানতে আমার পাশে আসলো। কাঁধে হাত রাখল। কিছুটা অস্বস্তি লাগল। ওই বিষয়টি দেখিয়ে দিয়ে আমি তাকে দূরে সরাতে চাইলাম, নিজের স্বস্তির জন্য। কিন্তু ওর যাওয়ার খোঁজ নাই। বলল, তোমাকে আমার পছন্দ লাগে। হয়তো ভালোও বাসি।

আমি বললাম, কী বলো এসব? প্রেম ভালোবাসা আমার পছন্দ নয়। সরি বলে প্রসঙ্গ পালটাতে চাইলাম। আমি তো ওর বোনের প্রেমে পড়ে গেছি এতদিনে। নাম টুম্পা রানী দাস। কীভাবে সম্ভব স্বপ্নার কথায় সাড়া দেওয়া? এদিকে টুম্পার সঙ্গে ভাব জমাতে লাগলাম। ও খুব লাজুক স্বভাবের নম্র-ভদ্র মেয়ে। বেয়াড়াভাবে কথা বলতে পছন্দ করে না। প্রয়োজনের বাইরে ঠোঁট নাড়ায় না। শব্দ, বাক্য তথা কথাই যেন ওর বড় সম্পদ। ব্যয় করতে চায় না, ক্ষয় করতে চায় না খামোখা।

তারপর একদিন একটা ছেলে এলো। ছেলেটার কম্পিটার ব্যাসিক কোর্স মোটামুটি জানা। শুধু পরীক্ষা দিতে চায় এ প্রতিষ্ঠান থেকে। এজন্য অল্পবিস্তর ক্লাসও করে। ছেলেটার নাম বিশাখ। পদবীটা মনে নাই। টুম্পা ও স্বপ্নার ক্লাসমেট। ওরা নবম শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাসমেট হওয়ার সুবাদে ওরা একসাথে আসে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে। বিশাখের নিজস্ব অটোরিকশা। টিপ দেয় ও পড়ালেখার বাইরে। প্রতিদিন টুম্পা ও স্বপ্নাকে এটাসেটা খাওয়ায়। অন্যদের প্রতিও তার মোটামুটি ভালোলাগা আছে। কেউ বোন, কেউ বন্ধু হিসাবে। কিন্তু আমার প্রতি যেন তার কেমন মন্দলাগা আছে। শত্রু শত্রু ভাব। সেটা যে টুম্পাকেন্দ্রীক, বুঝতে দেরি হলো না। সেই থেকে টুম্পার সাথেও তেমন একটা কথা বলা হয় না। ও কিছু জিগ্যেস করলে উত্তর দিই। এর বাইরে ভালোমন্দ কিছু বলি না।

এর কিছুদিন পর বিশাখ আমার সঙ্গে চা খাইতে চাইল। একটি চায়ের দোকানে গেলাম। ও সিগারেট অফার করল। বললাম, আমি ধূমপান করি না।
ও সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, সিনিয়র হিসেবে সম্মানের সঙ্গেই বলছি, টুম্পার থেকে নজর ঘুরিয়ে নিন। খামোখা নিজেদের মধ্যে গেঞ্জাম করে কী লাভ জামিল ভাই?

আমি কিছু না বলে চা শেষ করে গেলাম শব্দটা উচ্চারণ করলাম।

টুম্পা ও স্বপ্নার সঙ্গে আর কোনো কথা হয় না আমার। নিশ্চুপ নিশব্দ থাকার চেষ্টা করি। এভাবে চলল কিছুদিন। একদিন এক হিজাবি মেয়ে ডাকল আমায়। বলল, কথা আছে।
গেলাম। সে আর আমি। আলাপ চলতে থাকল। প্রশংসা শুরু করল, হামিদা। পুরো নাম হামিদা জাহান লিমা। আমার নীল টিশার্টের প্রশংসা। ওটায় নাকি খুব সুন্দর লাগে আমাকে। কিছুদিন ধরে ও পর্যবেক্ষণ করে আসছে। এসব আলাপের শেষে গেল মূল কথায়। তুমি তো কবি। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
তুমি কি কাহিনি-কবিতা লিখতে পারো?
লিখিনি এখনও। পারব কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করতে পারি।
তাহলে ঠিক আছে। আমি তোমাকে কাহিনি বলব সময় করে। প্রস্তুত থেকো।

লেখক: কবি