সরকার আবদুল মান্নানের আত্মস্মৃতি ‘আমাদের গ্রাম’

পর্ব ১

প্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০২০

প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম সত্তরের দশকে। স্কুলে তখন গ্রাম নিয়ে রচনা লিখতে হতো, `তোমার গ্রাম`। আমরা বই থেকে মুখস্থ করে লিখে দিতাম। শিক্ষকগণ পড়তেন। নম্বর দিতেন। তারা কখনোই মনে করতেন না যে, এতে কোনো ভুল হচ্ছে। শিক্ষকগণ যে গ্রামে থাকতেন আমরাও তো সেই গ্রামেই থাকতাম। কিন্তু আমরা যে রচনা লিখছি সেই গ্রাম তো আমাদের নয়। শিক্ষকগণ আমাদের এই ভুল ধরিয়ে দিতেন না। আমাদের ঘিলুতেও আসত না যে, যে গ্রাম নিয়ে রচনা লিখছি ওই গ্রাম তো আমার গ্রাম নয় কিংবা আমাদের গ্রাম নয়। ওই গ্রাম তো আমরা চিনি না।

আজ এত দিন পরে মনে হচ্ছে, যে গ্রামটা আমাদের ছিল, যে বাড়িটা আমাদের ছিল, সারাটাক্ষণ যে বাড়িতে, যে গ্রামে হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়িয়েছি, গাছে চড়েছি, খালে বিলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছি, মাঠে ঘাটে উঠানে বিচিত্র খেলা নিয়ে মত্ত থেকেছি, সেই বাড়ি, সেই গ্রাম নিয়ে তো কখনোই একটি রচনা লিখিনি। আজ সেই ঘরবাড়ি, গ্রাম, সেই জনপদ আর নেই। নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাতাসের ভেতরে থেকে যেমন বোঝা যায় না, প্রতিটি নিঃশ্বাস কত মূল্যবান, তেমনি শৈশবে গ্রামের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে বুঝিনি যে, গ্রামটা কত প্রাণের জিনিস, কী অপরিসীম তার মায়ার টান। ফলে নিজের ঘর-বাড়ি নিয়ে, গ্রাম নিয়ে, অঞ্চল নিয়ে কোনো দিন কিছু লেখা হয়নি।

তারপর অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘর নেই, বাড়ি নেই, গ্রাম নেই। উদ্বাস্তু এক জীবন। টঙ্গী, কাপাসিয়া, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ফরিদপুর, খিলগাঁও করে করে একটা জীবন পার করে দিলাম। কোথাও বিন্দুমাত্র শিকড়ের আস্বাদ পেলাম না। কত বছর ধরে খিলগাঁও আছি। প্রতিবেশীরা আছে বহুদিন ধরে। একই বিল্ডিংয়ে অথবা আশেপাশের বিল্ডিংয়ে। তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই হলো না। তারা আত্মীয় নয়, অনাত্মীয় নয়, শত্রু নয়, মিত্র নয়, আপন নয়, পর নয়। কিছুই নয়। সম্পর্কহীনতার এমন আজব জীবন বাংলাদেশে কী করে সম্ভব, ভেবে পাই না।

বহুদিন ধরে আমি এমন এক আজব জীবন বহন করে চলছি। মনে হয়, আমার মতো অনেকেই। এ যেন অনতিক্রম্য নিয়তি। ভেতরে যেন একটি কান্না জমে জমে পাথর হয়ে গেছে। এর থেকে কোনো মুক্তি নেই। পরিত্রাণ নেই। খুব মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলোর কথা। দশ গ্রামে এমন বাড়ি কমই আছে যখানে অবলীলায় ঢুকে পড়া যেত না। এমন কোনো ঘর কমই আছে যেখানে আদর-আপ্যয়ন ছিল না। গাছগোড়া আর লতাপাতার সম্পর্ক নেই এমন কোনো বাড়ি কল্পনাও করা যেত না। "তুই ওমকের পুত না?" "তুমি ওমকের পোলা না?" “তুমি ওমকের ছেলে না?” বলে চৌদ্দ গোষ্ঠীর খবর নিয়ে শুরু হতো আদর আপ্যায়নের পালা। আদর-আপ্যায়ন মানে পোলাউ-কুর্মা খাওয়ানো নয়। ঘরে যা আছে তাই এনে সামনে দেওয়া। সিদ্ধ একটা মিষ্টি আলু, চালভাজা, দুটি পেয়ারা, একটি পাকা গাবও হতে পারে।

কিন্তু কেন লিখছি এইসব কথা? কী হবে এইসব লিখে? আর কি কোনোদিন ফিরে পাব হারিয়ে যাও বাড়িঘর, গ্রাম-গঞ্জ, পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন? কোনোদিন না। তবুও এতদিন পরে মনে হচ্ছে, হৃদয়ের ক্যানভাসে যে ঘর-বাড়ি-গ্রাম ও জনপদ আঁকা হয়ে আছে তার কিছু রং আর কিছু রেখা আখরে বেঁধে দিলে কেমন হয়! ভেতরে জমে থাকা কান্নার উপলখণ্ডে কি একটু স্রোত বইবে? জানি না।

আর সে জন্যই সাহস পাই না লিখতে। নিজের উপর আস্থারও বড় অভাব। সত্যিকার চিত্রটা যদি আঁকতে না পারি! যে চিত্রটাতে বেদনার রংটাই প্রগাঢ়, তা যদি আঁকতে না পারি তা হলে কী হবে! তার চেয়ে বরং হৃদয়ের কন্দরে যে চিত্রটা আঁকা আছে তাই থাক্। ওকে আর দীনহীন করে লোক-সম্মুখে হাজির করে হাস্যকর করে তোলার কোনো মানে হয় না। এবং অন্যদিকে "কে হায় হৃদয়খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?" সত্যি কি কেউ কারো কষ্টের ঐশ্বর্যকে অনুভব করতে পারে? অন্যের বেদনার রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারে নিজেকে? জানি না।

এতসব দ্বিধাদ্বন্দ্বের পরেও শরণ নিতে হয় গ্রিক ট্রাজেডির সেই বিখ্যাত অনুভব "ক্যাথারসিস" বা আবেগ বিরেচন তত্ত্বের। এ হলো উত্তরণের আশ্রয়, দুঃখ হজম করার মহৌষধ, পারগেশন। আমিও সেই আশ্রয়টুকু নিতে চাই। চলবে

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক