কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৯

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২৫

মেঘলা আকাশ। হয়তো অকারণেই, আমার খুব মন খারাপ। মানুষের মনের ওপর মেঘেদের এতটা আধিপত্য থাকে খুব কম বয়সেই আমি তা জেনে গেছি। মাস দেড়েক পরে ঠাটারি বাজার থেকে ফিরে এসেছি। এই সময়ে উপন্যাস লেখা বন্ধ ছিল। যে খাতায় উপন্যাসটা লিখছিলাম সেই খাতাটা মাঝরাতে আমাকে ডাকত, ফিরে এসো, একা একা শেলফে পড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু ওর যত্ন নিতে পারছি না। একটা লাইনও লিখতে পারছি না।

দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বন্যাদের বাড়ির পেছনে যে খোলা একটা মাঠ আছে, যেখানে জঙ্গুইলা বাড়ির লোকেরা ধান মাড়াইয়ের খোলা বানিয়েছিল, সেখানে এসে দাঁড়াই। পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ ফাঁকা বিল। দূরে, কাঁঠালদিয়ার দিকে বর্ষার পানি চলে এসেছে। মেঘের ফাঁকে হঠাৎ একটু রোদ দেখা দিলেই বিলের পানি ঝিকমিক করে ওঠে। তখন আমার ভেতরটাও কেমন যেন হু হু করে। ধান মাড়াই প্রায় শেষ, ছোটো ছোটো খড়ের গাদাগুলো এখনো একেকটা বুরকা পরা মহিলার মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। সোদা গন্ধ আসছে সেগুলো থেকে।

আমি আনমনে উত্তর বাড্ডা বাজারের দিকে হাঁটতে থাকি। একবার ভাবি ঠাটারি বাজারে চলে যাই। হয়ত মনিরের প্রতি খুব আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। পথের মাঝখানে মিজানের সঙ্গে দেখা।
দোস্ত, তোর কাছেই যাচ্ছিলাম।

আমার কাছে মিজান যাচ্ছিল, একথা শুনে আমি কিছুটা অবাক হই। সাধারণত আমিই ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি, আমাদের বাড়িতে ও কালে-ভদ্রে এসেছে আমার খোঁজে। এর একটা কারণও আছে, কেউ তো পেছনের দিকে যায় না, সকলেই সামনের দিকে যেতে যায়, নগরের দিকেই ধাবিত হয় মানুষ।

কী ব্যাপার বলতো?
একটা টিউশনি করবি?
আমি? টিউশনি? হ্যাঁ করবো। কোন ক্লাসের ছাত্র।
শুধু ছাত্র না৷ ছাত্রীও আছে।
ছাত্রী? না, থাক।
আমি আসলে কিছুটা লজ্জা পাই।
তোর ভয় বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ছাত্রী না, শিশু। ছাত্রীর বয়স ৭ বছর, থ্রি-তে পড়ে, আর ছাত্র টু-তে।
ও, তাহলে ঠিক আছে।
চল আমার সঙ্গে। এখনই তোকে নিয়ে যাই।
টাকা?
ওরা খুব গরিব।
ফ্রি পড়াব?
আরে নাহ। একটু কম দিবে। দেড়শো টাকা দেবে।
ঠিক আছে, পড়াব। জীবনের প্রথম টিউশনি যখন, দেড়শোতেই সই।

মিজানের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে টিউশনি বাড়িতে যাই। মধ্য বাড্ডা আদর্শ নগরে। একেবারে মিজানের বাড়ির পাশেই।
তোর ঘরের পেছনে, তুই পড়াচ্ছিস না কেন?
আমার একটা টিউশনি আছে, আরেকটা নিতে চাই না।
নাকি টাকা কম, সেজন্য?
মিজান একটু মন খারাপ করে। আমি ওর পিঠে হাত রাখি, বলি, জাস্ট মজা করলাম।
ইট`স ওকে।

ছাত্রীর নাম কানন, ছাত্রের নাম বুলবুল। আমি কিন্তু জীবনের প্রথম টিউশনি করতে গিয়ে একটুও ঘাবড়ে যাইনি। কারণ আমার ভাইবোনদের আমি নিয়মিত পড়াই, স্কুলে, প্রায় সব ক্লাসেই, সহপাঠীদের অঙ্ক করিয়েছি, কাজেই পড়ানোটা আমার কাছে ডালভাত।

ওদের বাবা তেজগাঁয়ের একটি কারখানার ফোরম্যান, মা-ও কোথাও চাকরি করে। আমি রোজ বিকেলে পড়াতে যাই। ওর বাবা খুব রাগী, ছেলে-মেয়ে দুটোকে সারাক্ষণ পেটায়। ওরা একদিকে যেমন দুষ্টু অন্যদিকে মাথায় তেমন কিছু নেই। কানন তো একেবারেই মেধাহীন, বুলবুল বুঝিয়ে দিলে পড়াটা ধরতে পারে কিন্তু অতিমাত্রায় দুষ্টুমির কারণে, আজ কী পড়িয়েছি কাল আর তা মনে করতে পারে না। কাননের বয়স ৭ বছর হলেও ভীষণ ইঁচড়েপাকা। নারী-পুরুষের গোপন সম্পর্কের ব্যাপারে ওর দারুণ কৌতূহল।

পরদিন মনির এসে হাজির। মনির ও আমার মধ্যে একটা কেমিস্ট্রি এই দেড়মাসে ডেভেলপ করেছে। আমরা দুজন পরস্পরের প্রতি বেশ আকর্ষণ অনুভব করি। এরপর থেকে মনির রোজই আসতে শুরু করে। আগে কিন্তু মনির কখনোই আমাদের বাড়িতে আসেনি। রোজ এসেই আম্মাকে বলে, ভাবি শুটকির ভর্তা খাবো, ভাবি ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক খাবো, ভাবি কাঁঠালের বিচির ভর্তা খাবো। এইরকম অদ্ভুত অদ্ভুত খাবারের বায়না ধরে, আম্মা তার পিচ্চি দেবরের চাহিদা অনুযায়ী রোজই এটা সেটা রান্না করেন।

মনির আমাকে এখানে-সেখানে নিয়ে যেতে চায়, ঠাটারি বাজারে ফিরে যেতে বলে কিন্তু আমি যাই না। আমার যে যেতে ইচ্ছে করে না তা নয়, পুরনো ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটার একটা অন্যরকম আনন্দ আছে, ওয়ারি, বনগ্রাম, অন্যদিকে সিদ্দিক বাজার, নয়াবাজার, বেগম বাজার, ইংলিশ রোড, আরো কত কত জায়গায় ছুটে যেতাম। সদরঘাটের বড়ো কাটরা, ছোটো কাটরা, হোসনী দালান এইসব এলাকায়ও চলে যেতাম। তাছাড়া ওখানে আছে প্রাচুর্য, যখন যেটা খুশি খেতে পারার অবাধ সুযোগ। মোগলাই পরোটা, বিরিয়ানি, কলিজা সিঙ্গারা, শিক কাবাব, রেস্টুরেন্টের খাসির মাংস, সব লোভনীয় খাবার।

কিন্তু আমি যেতে পারছি না। এখন তো আমি বেকার না, আমার একটা টিউশনি আছে, রোজ বিকালে পড়াতে হয়, ২৪ ঘন্টার জন্য তো কোথাও যেতে পারি না। মনিরের প্রকৃতি প্রেম, একেবারে গ্রামের খাবারের প্রতি আকর্ষণ, দূর-দূরান্তে বেড়াতে যাওয়া এই বিষয়গুলোর সঙ্গে আমার দারুণ মিল আছে কিন্তু শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তো ওর সঙ্গে কথা বলা যায় না।

ও কবিতার প্রতি আগ্রহ দেখায়, আমি জানি এটা ও করে আমাকে খুশি করার জন্য, কিন্তু ওর কাব্যবোধ একেবারেই নিম্ন পর্যায়ের, বলা যায় ও এসবের কিছুই বোঝে না। এই জায়গাটায় গিয়ে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব পানসে হয়ে যায়, হালকা হয়ে যায়, ঢিলে হয়ে যায়। মনিরও তা টের পায় এবং হঠাৎ আসা বন্ধ করে দেয়।

টিউশনির প্রথম মাসের টাকাটা পেয়ে অতি দ্রুত ছুটতে ছুটতে বাসায় আসি। এসেই আম্মার হাতে টাকাটা তুলে দিই। টাকাটা আম্মাকে দিয়ে মুখে কিছুই বলিনি কিন্তু আমার মনের ভেতর কথা কথা। মনে মনে বলছি, আম্মা দেখেন, আমি একজন যোগ্য সন্তান, টাকা উপার্জন করতে পারি। আমাদের আর অভাব থাকবে না। আমি সব অভাব দূর করে দেব। আব্বাকে বলবেন, আমাদের দুঃখের দিন শেষ। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারি। আম্মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মায়েরা সন্তানের মনের অব্যক্ত কথাও শুনতে পান। আমার আম্মাও মনে মনে বলা আমার সব কথা শুনে ফেলেছেন।

স্কুলে কেউ আমাকে বকা দিলে, কিল-ঘুষি দিলে বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আম্মা বলতেন, কী-রে বাবা, কারো সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি হয়েছে? আমার সোনামানিকের মুখ কালো কেন? আমি বলি, কই না-তো আম্মা। কিছুই হয়নি। আম্মা বলেন, লুকাতে হবে না, খুলে বলো কী হয়েছে। তখন আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলি এবং আম্মাকে সব খুলে বলি।

আম্মা টাকাগুলো আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলেন, যাও, তোমার নানার জন্য কিছু একটা কিনে আনো। আমি মধ্য বাড্ডা বাজারে গিয়ে আমার নানার জন্য একটা সবুজ রঙের শাল কিনি, সম্ভবত আশি টাকা দিয়ে। সেই শালটা পেয়ে নানা খুব খুশি হয়েছেন, আম্মা এবং আমার বড়ো খালাম্মা খুশি হয়েছেন নানার চেয়েও অনেক বেশি। আম্মার মুখে গর্বের হাসি তার ছেলে নিজে উপার্জন করে তার পিতাকে উপহার কিনে দিয়েছে। আমার নানা এই শালটা আমৃত্যু যত্ন করে পরেছেন, প্রথম কিছুদিন গ্রামের কেউ এলেই তাকে দেখিয়ে বলতেন, আমার নাতি ছাত্র পড়িয়ে প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমার জন্য এটা কিনেছে। চলবে