
রেজা ঘটকের গদ্য ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’
প্রকাশিত : জুন ১৬, ২০২৫
পশ্চিমারা কোনো ধরনের যুক্তি ছাড়াই ইরানে ইজরায়েলের আগ্রাসনকে সমর্থন করছে। পাশাপাশি তারা অস্ত্র, গোলাবারুদ আর অর্থ দিয়ে বর্বর বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর হাতকে আরো শক্তিশালী করছে। এই তথাকথিত পশ্চিমারা আবার বিভিন্ন দেশে মানবাধিকারের ধুয়া তোলে। ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের আগ্রাসন পৃথিবীর যে-কোনো বর্বরতাকে হার মানিয়েছে।
নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নেতানিয়াহু ইরানে হামলা চালিয়েছেন। ইরানে হামলার পেছনে তার যুক্তিগুলো খুবই দুর্বল।
১. ইরান পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হলে ইজরায়েলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
২. ইরানের রিজিম চেইঞ্জ করাটা মানে আলী খোমেনির বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত করতে হবে।
৩. ইরানে নারীদের স্বাধীনতা নেই।
নেতানিয়াহু পৃথিবীর কোনো আইনের তোয়াক্কা করেন না। জাতিসংঘ মানবাধিকার চার্টার থেকে শুরু করে যুদ্ধনীতি কোনো কিছুতেই তার কোনো বিশ্বাস নাই। তার এই দাপটের পেছনের শক্তি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। কিন্তু শুধু কী পশ্চিমা মিত্রদের ভরসায় ইরানে ইজরায়েল এত নিখুঁত হামলা করতে সক্ষম? মোটেই নয়।
ইরানের প্রধান শত্রু ঘরেই রয়েছে। পশ্চিমাদের ইরানের পূর্বতন শাসক ধ্বজাধারী রেজা শাহ পাহলভীর পরিবার এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত। কয়েকদিন আগে শাহপুত্র রেজা পাহলভী ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। ইরানে রেজা শাহর অনুসারীরাই মূলত ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে।
শাহ অনুসারীদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকা মোসাদের এজেন্টরা ইরানের মাটিতে থেকেই বিপ্লবী গার্ড রেজিমেন্টের সেনা কর্মকর্তারা ও বিজ্ঞানীদের অবস্থান শণাক্তকরণে সুস্পষ্ট তথ্য পাচ্ছে। আর তাদের কতল করার জন্য ইরানের মাটিতে বসেই মোসাদের এজেন্টরা ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে নিখুঁত নিশানায় হামলা করেছে।
পাশাপাশি একই সময়ে ইরানের সামরিক স্থাপনা, তেল শোধনাগার ও পরমাণু স্থাপনায় আকাশপথে হামলা করেছে ইজরায়েল। যেসকল শীর্ষ সামরিক ও শীর্ষ বিজ্ঞানীরা ওই হামলায় নিহত হয়েছেন, তার সবগুলোই ইরানের মাটি থেকে মোসাদের এজেন্টরা করেছে। আর আকাশপথে হামলাগুলো এসব শীর্ষ ব্যক্তিদের অবস্থান খুঁজে পাবার কথা নয়।
মোসাদের এজেন্টরা হামলার আগেই ইরানের আকাশরক্ষা ব্যবস্থার রাডার সিস্টেম অকেজো করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ইজরায়েলের শুক্রবারের প্রথম হামলা ছিল একদম নিখুঁত। কয়েক বছর ধরে নারীদের স্বাধীনতার নামে ইরানে যেসব আন্দোলন হয়েছে, সেগুলো পতিত শাহ পাহলভীর অনুসারীদের রচিত। ওরা নগদ মার্কিন ডলারে লোভে ওই আন্দোলন করেছে।
রেজা শাহর পতন হলেও ইরানে তার প্রচুর অনুসারী রয়েছে। এই পতিত রেজা শাহর অনুসারীরা এখন মোসাদের রক্ষক ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা। ফলে ইরানকে এখন ঘরের শত্রু ও বহির্শত্রুর মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বহির্শত্রুর চেয়ে ইরানের সামনে এখন এই ঘরের শত্রুরা সবচেয়ে ভয়ংকর ভূমিকা পালন করছে।
জিও-পলিটিক্সের অংশ হিশেবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য রক্ষায় তার সবচেয়ে বড় মিত্র ইজরায়েল। পাশাপাশি সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ইরাক, জর্ডান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া ও তুরস্ক মার্কিন মিত্র হিশেবে ইজরায়েলকে এখন সহযোগিতা করছে। বিপরীত দিকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মূলত রাশিয়া ও চীনের সমর্থন ছাড়া একাই লড়াই করে যাচ্ছে।
এছাড়া ইজরায়েলের ওপর ইরানের পাল্টা হামলা চালাতে ইরানকে এখন সহযোগিতা করছে তাদের কিছু লোকাল এজেন্ট। যেমন ইয়েমেনের হুতি ও লেবাননের হিযবুল্লাহ। পুরো আরববিশ্ব পশ্চিমা মিত্রদের সাথে একজোট হয়ে ইজরায়েলের ইরানের ওপর আগ্রাসনকে সমর্থন দিচ্ছে। আর ইরানের আলী খোমেনীর বিপ্লবী সরকারের পতন চাইছে। সেকাজে ইরানের বাইরের শত্রুদের চেয়ে ঘরের শত্রুরাই এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।
এখন কিছু `যদি` ও `সম্ভাবনা` নিয়ে কথা বলব। যদি রাশিয়া ও চীন ইরানকে পুরোপুরি সামরিক সহায়তা দেয়, তাহলে ইরান পূর্ণ শক্তি নিয়েই ইজরায়েলকে পাল্টা হামলা চালিয়ে কাবু করতে পারবে এবং ইজরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজেই পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করে যাচ্ছে। মিত্র ইরানকে এই মুহূর্তে রাশিয়ার পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেবার সামর্থ্য থাকলেও টেকনিক্যালি তা সম্ভব নয়।
একমাত্র চীন ও উত্তর কোরিয়া ইরানের এই প্রয়োজন মেটাতে পারে। যদি চীন ও উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া ইরানের পাশে থাকে, তাহলে গোটা পশ্চিমা মিত্ররা ইজরায়েলকে সাথে নিয়েও ইরানের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। বরং ইরানের জনগণ ধীরে ধীরে পশ্চিমা এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সেক্ষেত্রে ইরানের ঘরের শত্রু শাহর অনুসারীদের নিধনের জন্য ইরানে একটি দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ মাঝে মাঝে ইজরায়েল ও তার মিত্রদের বিপক্ষে সরাসরি ইরান যুদ্ধ করবে। পাশাপাশি শাহর অনুসারীদের নিধনের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী গুহযুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে ইরান।
কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যতদিন তেল ও গ্যাস থাকবে ততদিন পশ্চিমা শক্তিগুলো সেখানে আগ্রাসন চালাবে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ যখন শেষ হবে, তখন পশ্চিমারা সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মনযোগী হবে। এটাই জিও-পলিটিক্স। আর সেজন্য অলরেডি বাংলাদেশ, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভারতকে ঘিরে নয়া জিও-পলিটিক্স সারমর্ম তৈরি করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানে আলী খোমেনির পতন হলে কী মধ্যপ্রাচ্যে চিরশান্তি বিরাজ করবে। জবাব হচ্ছে না। তার উদাহরণ ইরাক, লিবিয়া, লেবানন, জর্ডান, মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তান। পশ্চিমা আগ্রাসনে এসব দেশের কী পরিণতি হয়েছে তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। অতএব তার ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন নাই।
পশ্চিমাদের তথাকথিত মানবাধিকারের বুলি একটা খোঁড়া অযুহাত। তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে তারা ইজরায়েলের বর্বর হামলাকে এখন সমর্থন করছে, এটাই সায়েন্স। মানবাধিকার বলে পশ্চিমারা আদতে কিছুই বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে স্বার্থ। দ্যাটস ইট।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা