সানোয়ার রাসেলের আত্মগদ্য ‘দর্শন’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২২

স্টেশনে যেতে হয় একজন মানুষকে সঙ্গ ও সঙ্গপরবর্তী বিদায় জানাতে। ট্রেন আসে। এখানে, এই জংশনে ট্রেনের ইঞ্জিন তার দিক বদল করে। ঘুরে এসে বিপরীত প্রান্তে এসে মিলিত হয় বগির সাথে। সব সময় দেখা যায় এ সময়, অর্থাৎ, ইঞ্জিনের সাথে বগির মিলিত হবার সময় লাইনের দুপাশে কিছু উৎসুক জনতার জটলা সৃষ্টি হয়। এরা মুগ্ধদৃষ্টিতে ইঞ্জিনের সাথে বগির মিলনদৃশ্য দেখে। দেখতেই থাকে, যতক্ষণ এই মিলনকার্য সম্পন্ন হতে থাকে। দর্শকদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এদের সিংহভাগের বয়স তেরো থেকে পঁচিশের মাঝে। বয়সের এই সীমারেখার সামান্য হেরফেরও হতে পারে। শীতে এদের গলায় মাফলার, মাথা পর্যন্ত ঢাকা। গরমে গামছা, কোমরে প্যাঁচানো। খেটে খাওয়া মানুষ, সরল কিশোর, মাদ্রাসার ছাত্র কিংবা আরও ভিন্ন পেশার লোকও হতে পারে। সচরাচর যাদের দিকে আপনি দ্বিতীয়বার তাকান না, তেমন সব মানুষ।

যেমনই হোক, এদের সব সময় দেখা যায়, ইঞ্জিন ও বগির মিলনের সময় জটলা পাকাতে। মানুষ মূলত মিলন দেখতে ভালোবাসে। সেটা প্রাণহীন ইঞ্জিনের সাথে বগির মিলনই হোক, সপ্রাণ কুকুরের সাথে কুক্কুরীরই হোক, শ্রেষ্ঠপ্রাণ মানবের সাথে মানবীরই হোক। মোটকথা মানুষ মিলন দেখে আনন্দ পায়। কেউ স্টেশনে, কেউ রাস্তার মোড়ে, কেউ টিভির পর্দায়। তারা আনন্দিত হয়। একজন কিশোর দর্শককে ডেকে কেমন লেগেছে জিজ্ঞেস করায় সে একগাল হেসে জবাব দেয়, ভাল্লাগছে ভাই।

ইঞ্জিনের সাথে বগির মিলনদৃশ্য দেখতে মানুষের ভালো লাগে।
আমি দৃশ্য ও দর্শকদের দেখি। তাদের দর্শন করতে আমার ভালো লাগে।
এভাবে দেখতে দেখতে এক সময় মনে হয়, আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি, কিংবা, যা দেখি না, কিন্তু যেভাবে দেখতে চাই, সেভাবে সেই সব যদি অন্য কাউকে দেখাতে পারতাম! আমি ভাবতে থাকি। ভাবনার ঢেউ আমার ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করে। আলোড়নে অনেক তলের পানির মতই বহু আগের দেখা দৃশ্যগুলো, কিংবা দৃশ্যের আকাঙ্ক্ষাগুলো ভুরভুর করে উপরে উঠে আসে।


আমার মনে পড়ে যায়, এক সময় আমি বন্ধুদের কলেজের বিপরীত দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা দিতাম। তারা সাইকেলগুলোর চাকা আর ক্যারিয়ার একসাথে চেইন দিয়ে বেঁধে রেখে কাপের পর কাপ চা খেতো। তারা কলেজের মেয়েদের প্রেমে পড়তো। সেই প্রেম নিয়ে কিংবা বড়ভাই-ছোটভাই মার্কা সমস্যা নিয়ে কিংবা আরও কত অতুচ্ছ বিষয় নিয়ে দলবেঁধে মারামারি করতো। আর সারাক্ষণ কী এক উত্তেজনায় তারা টগবগ করে ফুটতো! আমি সেই সব দৃশ্য মানুষকে দেখাতে চাই। তাই আমি সেই সব দৃশ্যকে গুটি বানিয়ে রেশমের পোকার মতো সূতা ছাড়তে থাকি, শব্দের। এভাবেই তৈরি হয় আমার প্রথম গল্প, `আঁখির পানে চেয়েছিলে`, আমারই দর্শন থেকে।

কলেজ পাশ করে বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আমিও তাদের সাথে সাথে চলি। দেখে যাই। নতুন ছেলেরা সাহসী, মেয়েরা লাজুক। অগ্রজ ছাত্রেরা সদালাপী, অগ্রজ ছাত্রীরা ঝরঝরে। অকুতোভয় ছেলেকে দেখি কাঙ্ক্ষিত মেয়েটির কাছে প্রেমের প্রস্তাব দিতে গিয়ে নাক ঘেমে যায়। প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশ হয়। গলায় মদ ঢেলে মাতাল হয়, মদ তবু সেই মেয়েটির কথা ভোলাতে পারে না। নেশায় উন্মাতাল হয়ে ছেলেটি মেয়েটির নাম ধরে বিলাপ করে। মদ যাকে ভোলাতে পারে না, সময় তাকে ঠিকই ভুলিয়ে দেয়। ছেলেটি প্রেমে পড়ে, আবার। বিগত সকল যন্ত্রণাকে সুনামির মতো আছড়ে হটিয়ে দেয় সেই প্রেম। মায়ের আঁচলের মতো স্নেহের প্রলেপে ঢেকে দেয় সব ক্ষত। কিন্তু নিয়তি আমাকে চোখ ফেরাতে দেয় না। ভাঙা ও গড়া, গড়া ও ভাঙার খেলা চলতে থাকে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য কোথাও। ছেলেটি বিহ্বল। মেয়েটি অনন্যোপায়, যেহেতু ছেলেটির কোন চাকরি নেই।

নিয়তির অনিবার্যতাকে মেনে নেবার প্রস্তুতিতেই সে আবার আমাদের সাথে কালোকৌতূক করে। মেয়েটির বিয়ের সপ্তাখানেক পরেই ছেলেটির চাকরির ফলাফল প্রকাশ্য হয়। মেয়েটি কি আজও মনের ভেতর গোপন বনসাঁইয়ের মতো ছেলেটির জন্য ভালোবাসা লালন করে চলে? জানি না। কিন্তু আমি এভাবেই দেখতে চাই। আর সেই দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে তৈরি হয় যে গল্পটি, তার নাম রাখি `বনসাই`।

বলছিলাম মিলনদৃশ্য দেখতে মানুষের ভালো লাগে। কিন্তু `আঁখির পানে চেয়েছিলে` এবং `বনসাই` গল্প দুটিতে আমি মিলন দেখাতে পারিনি। দেখিয়েছি বিচ্ছেদের দৃশ্য। অবাক হয়ে দেখেছি, বিচ্ছেদের গল্পগুলো মানুষ পছন্দ করেছে। তবে কি মানুষ মিলনদৃশ্যের পাশাপাশি বিচ্ছেদ দৃশ্যও পছন্দ করে? হ্যাঁ, মানুষ বিচ্ছেদ দৃশ্য দেখতেও পছন্দ করে। মানুষ পরিচিত-অপরিচিত মানুষের বিয়ের খবর শুনে আনন্দিত হয়। আবার তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদের খবরেও পুলক বোধ করে। তারকাদের বিবাহের খবরের চেয়েও তাদের বিচ্ছেদের খবরের চাহিদা তাই অধিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জীবিকার সন্ধানে পরিচিত দৃশ্যের পটভূমি ছেড়ে ভিন্ন ক্যানভাসে স্থানান্তরিত হতে হয়। সেখানে সড়কপথের চেয়েও রেলযোগাযোগ অধিক সুবিধাজনক। তাই বড় একটা সময় কাটতে থাকে ট্রেনে কিংবা ট্রেনের অপেক্ষায় স্টেশনে। স্টেশন এক বিচিত্র দৃশ্যের জগত। সাধু থেকে শয়তান, কত হরেক কিছিমের লোক কত অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি করে চলে এখানে, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। মাঝে মাঝে কবিরাজি অষুধ বিক্রেতারা সাপের বাক্স নিয়ে পশরা সাজায়। অবিশ্বাস্য গল্পের ইন্দ্রজালে মোহমুগ্ধ করে সমবেত মানুষদের, কিংবা বলা ভালো তাদের কথার সেই ইন্দ্রজালে মোহমুগ্ধ হয়েই সমবেত হয় মানুষেরা! তারা সাপের কথা বলে, বিষের কথা বলে, পীরের কথা বলে, দেবীর কথা, গোপন অসুখের কথা বলে। সেই সব দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেক সময় ট্রেন ছুটে যায়। আমি সেই দৃশ্য দেখাতে চাই। লিখতে বসি `প্রতিপ্রহরের গল্প`। আমার মনে পড়ে যায় সেই নিবিষ্ট শিল্পীর কথা, যে খুটিয়ে খুটিয়ে গাঁজার পাতা থেকে বিষকাঁটা বাছতো। যেন প্রেমিকার শাড়ির পাড় থেকে প্রেমকাঁটা বাচছে কোন নিমগ্ন প্রেমিক! এই দৃশ্য আমার দেখাতে ইচ্ছে হয় সবাইকে। দেখাতে ইচ্ছে হয় একজন ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতা হয়েও কিভাবে কেউ স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটে। কাজেই এইসব চরিত্রকে জায়গা দিতে হয়, ওরা জায়গা করে নেয় এই গল্পে।

আলোর সাথে অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, ভালোর সাথে খারাপের দ্বন্দ্ব। ইতিহাসটা বহু প্রাচীন। সৃষ্টির আদি থেকে শুরু হয়েছে যে লড়াই, সে লড়াইয়ে কে জেতে? ভালো নাকি মন্দ? সাদা চোখে অন্ধকারকেই তো চতুর্দিকে জিততে দেখা যায়। কিন্তু এ লড়াইকে আমি কিভাবে দেখি? সেই দেখাটাই তো দেখাতে চাই সবাইকে। কাজেই আলো ও অন্ধকারকে জীবন্ত সত্তার মতো তুলে আনতে হয়, যেন ওরা মানুষের মতোই দুজন। তো সেই দুই সত্ত্বার মধ্যে শুরু হয় এক প্রতিযোগিতা। কে কয়জন মানুষকে নিজের দিকে টানতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। নির্ধারিত সময় শেষে বিমর্ষ আলো দেখতে পায় যে তার অর্জনের পাল্লা শূন্য। অন্ধকারের জয়জয়কার। এই ভেবে আলো মরতে বসে। কিন্তু অন্ধকার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে অন্যভাবে। যত মানুষ অন্ধকারে ধাবিত হয়, তারা সকলেই আলোর সন্ধানেই যাত্রা শুরু করেছিলো। কিন্তু জ্ঞানের অভাবে তারা অন্ধকারকেই আলো ভেবে ভুল করেছে। আর অন্ধকার কেবল সেই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করেছে। কাজেই মানুষ মূলত আলোর পথের যাত্রী, আর তাই জয় হয় আলোরই। অন্ধকারের ব্যাখ্যা শুনে আলো ছুটে যায় জ্ঞানের খোঁজে, আর অন্ধকার বসে থাকে একা। এভাবেই তৈরি হয় `থাকে শুধু অন্ধকার` গল্পটি। আমি এভাবেই দেখাতে চেয়েছি আলো আর অন্ধকারের সম্পর্ককে। আর তা দেখাতে গিয়েই আমাকে এখানে বলতে হয়েছে সেই গ্রামের কিশোরী মেয়েটির গল্প, যে সিনেমার নায়িকা হবার আশায় সর্বস্ব খুঁইয়ে এক্সট্রা হিসাবে জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সেই জীবনটাকেও যদি অপাঙ্গে একটু দেখে নেন আপনারা।

দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রতিদিন আমাদের কত সংবাদ শোনায়। অবশ্য বেশিরভাগই দুঃসংবাদ। রাজনৈতিক হানাহানি, গুম, খুন, দুর্নীতি, অনিয়ম এইসব দুঃসংবাদ আমাদের কাছে নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা হিসাবেই প্রতিভাত হতে থাকে। আমরা দুঃসংবাদে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তথাপি কিছু কিছু দুর্ঘটনার খবর আমাদের অভ্যস্ততার দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দেয়। তেমনি একটি ঘটনা আমরা পত্রিকা মারফৎ জানতে পারি। লম্পট শিক্ষক পরিমল জয়ধর ধর্ষণ করে তারই স্কুলের ছাত্রীকে! মানুষেরা প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। পত্রিকার পাতা গরম হয়। পরিমল জয়ধর স্কুল থেকে বহিঃস্কার হয়। আর কোন সাজা তার হয়েছিলো কিনা তা ঠিক মনে নেই। কিন্তু আমি দেখতে চেষ্টা করি সেই কিশোরীর মর্মজ্বালা। তার অন্তর্দহনের খবর আমরা নিয়েছিলাম কি? তখন আমার ছোটবেলায় দেখা একটা দৃশ্য মনে পড়ে যায়। আমি দাঁড়িয়েছিলাম গৌরীপুরের চান্দের শাটিয়া গ্রামের ভগ্নপ্রায় এক পরিত্যক্ত দালানের সামনে। দালানটি কেবল সাপ-খোঁপের আস্তানা। পাশেই এক মস্ত দীঘির ভাঙা পাড়। গ্রামের একজন বলেছিলো এখানে আগে ছিল মস্ত নদী, আর সেই নদীতে চলাচল করতো সদাগরদের নৌকা। এখন আর নদীর কোন চিহ্নও নেই। পরিত্যক্ত দালানের আরেক পাশে পুরানো কুয়া, এখন ভরাট। আমি এই প্রাচীন দালান, বুঁজে যাওয়া কূপ, দীঘির ভাঙ্গা ঘাটের সাথে সেই দুর্ভাগা কিশোরীর একটা সম্পর্ক আঁকতে চেষ্টা করি। আমি দেখতে চাই পরিমল জয়ধরেরা ভয়ানক কোন অপার্থিব শাস্তি ভোগ করছে তাদের কৃতকর্মের জন্য, চিৎকার করে ক্ষমা চাইছে কিশোরীর কাছে। কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য এই অমানুষদের ক্ষমা করা হচ্ছে না। আমি দেখতে চাই এভাবে, দেখাতে চাই এইসব। তাই আমি গল্প বানাই। গল্পের নাম রাখি `নিমন্ত্রণ`।

লেখক: কবি