
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২০
প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২৫
একটা কথা এখানে বলে রাখি, আমার যারা প্রিয় মানুষ তারা কখনোই আমাকে কবিতা লেখায় নিরুৎসাহিত করেননি। আম্মা সবসময় চাইতেন আমি যেন কবিই হই, না বুঝে না, কবির জীবন দারিদ্রের প্রাচুর্যে পূর্ণ থাকে, এইসব জেনেই আম্মা চাইতেন আমি কবি হই। কবিতা লিখি, এটা শুধু চাইতেন না, তিনি যেন নিশ্চিত ছিলেন, এটিই আমার একমাত্র গন্তব্য।
বেশ পরিণত বয়সে এসে আমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি। তখন আমার বয়স ২৭ বছর। মেয়েটিও আমার প্রতি শুধু এই কারণেই আকৃষ্ট হয় যে আমি কবিতা লিখি। কবিতা ছাড়া প্রকৃত অর্থে তখন আমার আর কোনো সম্পদ ছিল না। আমি নিজেও যেন জানতাম আমার ঝোলার মধ্যে যে কবিতাগুলো আছে সেগুলো ভাঙালে কয়েকটা দালান কেনা যাবে, কয়েকটা দামি গাড়ি কেনা যাবে, কাজেই অন্য কোনো সম্পদ অর্জনের জোড়ালো কোনো আগ্রহও কখনো তৈরি হয়নি।
আমাদের পাড়ায় নতুন একটি পরিবার আসে। ওদের বাড়ি নোয়াখালী। স্ত্রী, এক কন্যা ও দুই পুত্র নিয়ে আব্দুল হক পাটোয়ারী তার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের তৈরি করে দেওয়া বাড়িতে এসে ওঠেন। পাটোয়ারী সাহেব রূপালী ব্যাংকের একজন করণিক। বেশ হিসাবি ও অসম্ভব পরিশ্রমী মানুষ। রামপুরা কিংবা গুলশানে এসে বাস থেকে নেমে ভারি ভারি বাজারের ব্যাগগুলো বহন করে দেড়, দুই মাইল হেঁটে বাসায় চলে আসতেন। বৃষ্টির দিনে আমাদের কাঁচা রাস্তাগুলো এমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠত যে, মনে হতো সার্কাসের দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছি। ভারসাম্য ঠিক রেখে হাঁটার এক বিরল প্রশিক্ষণ আমাদের হয়ে যেত এইসব লাল মাটির মেঠো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে।
একদিন তেমন এক বৃষ্টির দিনে পাটোয়ারী সাহেব আমাকে রাস্তায় ধরেন। এক হাঁটু কাদার মধ্যে আমাকে দাঁড় করিয়ে তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করেন, হাউ ডু ইউ ডু?
আমিও ইংরেজিতে উত্তর দেই। এরপর তিনি আমাকে আরো ৩/৪টি প্রশ্ন ইংরেজিতেই করেন। আমিও সাধ্যমত ইংরেজিতে উত্তর দিই। তিনি দিগন্ত বিস্তৃত একটি হাসি দিয়ে বলেন, ভেরি গুড, ব্রিলিয়ান্ট বয়।
আমাদের বয়সী ছেলেরা মুরুব্বিদের দেখলে একটা সালাম দিয়ে কেটে পড়ত, কেউ আলাপচারিতায় জড়াত না। এটাই সভ্যতা, এটাই আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু আমি জসীম উদদীন পরিষদে সারাদিন বুড়োদের সঙ্গে আড্ডা দিই, কবি আমিনুল হক আনওয়ার আমার প্রধান বন্ধু, কাজেই মুরুব্বিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খোশগল্প করা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।
কয়েকদিন পরে আবার পাটোয়ারী সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি আবারও আমাকে রাস্তার ওপরে থামান। এবার তিনি আমাকে তার বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াত দেন। আমি শুক্রবারে, ছুটির দিনে, তার বাসায় যাই। তার স্ত্রী মজার নাশতা তৈরি করেন, তিনি আমার সঙ্গে বসে নানান গল্প করেন। তার ব্যাংকের গল্প, তার স্বপ্নের গল্প, একটা ঋণের আবেদন করেছেন, সেটা পেলে জমি কিনবেন, দুই ছেলেকে নিয়েও তার স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি যে শুধু নিজের ছেলেদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন তাই নয়, পাড়ার ছেলেদেরও খোঁজ-খবর নেন। তাদের নিয়েও স্বপ্ন দেখেন। যখন আমরা আলাপে মশগুল তখন তার বড় সন্তান, ঝরনা, ভেতরের ঘর থেকে আমাদের জন্য চা, নাশতা নিয়ে আসে।
বেশ স্টাইলিস্ট মেয়ে, ফ্যাশন করে চুল কাটা, মুখে মেকাপ, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। এই বয়সের একটি মেয়ের এত সাজসজ্জা! অন্তত আমাদের পাড়ায় এমনটি আমরা আগে কখনো দেখিনি। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আজ পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসবে। জিজ্ঞেস করে জানি ও নবম শ্রেণিতে পড়ে, আমার ছোটোবোন শাহনাজও নবম শ্রেণিতে পড়ে, পরে ওরা দুজন ভালো বন্ধু হয়।
পাটোয়ারী সাহেব বলেন, আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি তুমি এই এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছেলে। আমি চাই তুমি আমার দুই ছেলে আনিস ও লিটনকে কাল থেকে পড়াও।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাই। আমারও টাকার দরকার, একটি নতুন টিউশনি নেবার মতো যথেষ্ঠ সময় আমার হাতে আছে। আনিস বেশ শার্প, খুব দ্রুতই অঙ্কগুলো বুঝে ফেলে, লিটন কিছুটা ডাল, ওকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়। লিটন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, আনিস পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে।
বর্ষা যখন টইটম্বুর, নৌকা ছাড়া এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাওয়া যায় না সেই রকম একদিন ওদের বাসায় পড়াতে গিয়ে দেখি নোয়াখালী থেকে ওদের খালাত ভাই এসেছে। ছেলেটি নাসিকাধ্বনি মিশ্রিত কণ্ঠে বেশ প্রমিত উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করে। দেখে মনে হচ্ছে আমারই বয়েসী। জিজ্ঞেস করে জেনে নিই, সেও এ-বছর আমারই মত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। এবং বাণিজ্য বিভাগ থেকেই। এক দুই কথার পরেই আমরা বন্ধু হয়ে যাই। ওকে আমার নৌকাতে তুলে দূর দূরান্তে ঘুরতে যাই। যে কয়দিন সে খালার বাড়িতে ছিল এই সময়ের মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। পরেও যখন এসেছে আমরা কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি।
একদিন আমরা দুজন নৌকা বাইতে বাইতে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে চলে যাই। সেটি কোনো এক পুলিশের পরিত্যক্ত বাড়ি বলে এলাকায় পরিচিত ছিল। শুধু একটি শূন্য ভিটা, চারদিকে থৈ থৈ বর্ষার জল, ভেসে আছে ছোট্ট এক দ্বীপের মত। তবে দ্বীপটি জনমানবশূন্য হলেও বৃক্ষশোভিত ছিল। বাড়িটির চারপাশ ঘিরে অসংখ্য ফিকুস গাছের অরণ্য ছিল। বাড্ডার লোকেরা বলত তিদ্দিলা গাছ, আমি এর একটি পরিমার্জিত নাম দিয়েছি, তিথিলা। বাড্ডা ছাড়া এই গাছ বাংলাদেশের আর কোথাও দেখিনি আমি। তবে পশ্চিম আফ্রিকায় গিয়ে প্রচুর দেখেছি, ওখানকার মানুষ এই গাছগুলোকে বলে ফিকুস। নানান প্রজাতির ফিকুস আছে, মার্কিনীরা অবশ্য ফাইকাস বলে, তবে যেগুলোর পাতা পাকুর গাছের পাতার মত, কিন্তু তেলতেলে, শিমের মত খুব শক্ত এক ধরণের অখাদ্য ফল হয়, সেগুলোই বাড্ডার পরিত্যাক্ত পুলিশের বাড়িটিতে ছিল।
আমরা দুজন সেই বাড়িতে নৌকা ভিড়িয়ে নিরিবিলি গল্প করতে থাকি। এক পর্যায়ে ছেলেটি বলে, চলো, গাছে উঠি।
সে নোয়াখালির মানুষ, গ্রাম থেকে এসেছে লাফিয়ে গাছে উঠতে পারে। আমিও ওকে অনুসরণ করে তিথিলা গাছের ডালে উঠে বসি। ছেলেটি আমাকে গাছে উঠতে বেশ সাহায্য করে। আমি চিরকালেরই রোগা শিশু কিংবা বালক ছিলাম, তখনও তাই আছি, কিন্তু আমার বন্ধুটি বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। ওর হাতের পাঞ্জা প্রায় আমার দ্বিগুণ, লম্বায়ও বড়ো, চেহারাও সুদর্শন।
আমরা দুজন গাছে উঠে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটাই। ও আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চায়, আমি এই প্রশ্নের উত্তরে চোখের সামনে কিছু কবিতার পঙক্তি ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিব, একাউন্টেন্সি অথবা ম্যানেজমেন্ট, যেটা পাই সেটাতেই ভর্তি হয়ে যাব।
ওকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি করবে?
ও বলে, আমি এমন একটা বিষয়ে পড়বো যে বিষয়ে ভালো ছাত্ররা ভর্তি হয় না।
কেন?
তাহলে আমি ফার্স্ট হতে পারবো। ফার্স্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসারি করব।
কী সেই বিষয়?
দর্শন।
দর্শন?
হ্যাঁ, দর্শন। এই বিষয়ে কেউ পড়তে চায় না। দর্শন হচ্ছে আসল বিষয়।
আমার তখন মনে হচ্ছিল, ও খুব ফোকাসড। তখনই সে তার জীবনের গন্তব্য ঠিক করে ফেলেছে। এত সুস্পষ্ট ওর চিন্তা এবং বেশ দৃঢ়, মনে হচ্ছিল এই সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘ দিন ধরে অনেক ভেবে-চিন্তেই নিয়েছে এবং এখান থেকে ওকে কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না।
সেই ছেলেটির নাম কামরুল আহসান। সে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগেই ভর্তি হয়। অনার্স-মাস্টার্স করে বিলেতের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগেই শিক্ষক হিশেবে যোগ দেয় এবং এখন কামরুল আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
আমার আজকের এই লেখার মধ্য দিয়ে আমার বন্ধু কামরুল আহসানকে জীবনের পরিকল্পিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারার জন্য অভিনন্দন জানাই। চলবে