জগলুল আসাদের গদ্য ‘প্র‍্যাকটিসিং মুসলিম’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০২১

মুসলিম মাত্রই বিচারশীল। তাকে আত্মবিচার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রবিচারও  করতে হয়। প্র‍্যাকটিসিং মুসলিমের জন্যে ব্যাপারটা প্রায় প্রাত্যহিকই। সে কতটা ইবাদত করলো, কোনো অন্যায় করলো কিনা, কারো অধিকার মারলো কিনা, কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলো কিনা, নামাজ কাজা হলো কিনা, ইলমের পথে সে কতটুকু অগ্রসর হলো, কোনো ইলমি বা আমলি ভুল হলো কিনা—নিজেকে নিয়ে এই বিচারটুকু একজন মুমিন মুসলমানকে নিয়মিত করবার কথা বা করতেই হয়। এই যে চর্চা এটাকে মুহাসাবা বলে। অর্থাৎ হিসাব নেয়া, নিজেকে নিজে নিরীক্ষণের আওতায় রাখা। এই আত্মনিরীক্ষণ একটা সেল্ফ-ক্রিটিক, নিজেকে আরো বেশি শুদ্ধ বা কামেল করে তুলবার প্রক্রিয়া এইটা। এইটা তার সাবজেক্টিভিটিরও চর্চা।

একজন মুসলিমের দায়িত্বই হক কথা বলা। সে নিজ বা অপর, যার ক্ষেত্রেই হোক। আইডিয়ালি তাকে হকের উপরেই থাকতে হবে। নিজের বা নিজ গোত্রের বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গেলেও তাকে আদল বা ইনসাফই করতে হবে। আদল বা ইনসাফ হকেরই একটা পার্ট বলা যায়। কখনোই অন্যের যে অধিকার, তা নষ্ট করা যাবে না। তা-ই মুসলিমের যে বাক-স্বাধীনতা এইটা রেস্ট্রিকটেড হয় এই বিধি দ্বারা যে, সে গিবত করবে না, নামীমাহ করবে না, কিযব বলবে না। তার হক কথা অপর ব্যক্তির তরে গিবত, নামীমাহ বা কিযব মুক্ত হবে। হক কথা বলা নিজেই একটা ক্রিটিক বা বিচার। Speaking truth/embarrassing truth to the power এর নমুনা ও নকীব,  মুসলমান বলে দাবিদারকে হয়ে উঠতে হয় ।

অত্যাচারীর সামনে হক কথা বলা সর্বোত্তম জিহাদ বলে যে নববি বাণী আছে, তা কিন্তু ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্যকে সমুন্নত ও সত্যের পক্ষাবলম্বনের দায় ও দায়িত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নবি (সা.) একবার বললেন, (মর্মার্থ) তোমরা নিজেকে ছোট করো না। সাহাবিরা নিজেকে ছোট করার অর্থ কি জানতে চাইলেন। নবিজি জানালেন, যেখানে যে কথাটি বলা উচিত সেখানে সে কথা না বলা। সুতরাং, মুসলিমের দায়িত্ব নিজেকে ছোট না করা। আর সেই বিখ্যাত হাদিস সবার জানা, যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদের সামর্থ অনুসারে ইমানের তিনটি স্তরের কথা বলা হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্তত কথা দিয়ে প্রতিবাদ ইমানের  দ্বিতীয় স্তরের মধ্যে পরে। প্রথম স্তর হাত বা ক্ষমতা দিয়ে প্রতিহত করা, আর ন্যুনতম স্তর অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, তারপর আর ইমানের অস্তিত্ব নাই।

সামষ্টিক ও ব্যক্তিগতভাবেও মুসলিমদেরকে হিসবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। অর্থাৎ আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার বা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব। এই দায়িত্বকে আপনাদের পরিভাষায় ক্রিটিকও বলা যাবে, আবার মহাত্মা তালালের সূত্রানুসারে (মাইকেল কুক ও মিশরি এক শাইখের বরাতে), অপর ভাই বা বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব হিসেবে, এমনকি ফুকোর পরিভাষায় Care of the self হিসেবেও এই হিসবাকে পাঠ করতে পারেন, আর রাষ্ট্রীয় পরিসরে এইটাকে জুডিশাল সিস্টেমেও ইনকরপোরেটে করা যায়৷। ওয়ায়েল হাল্লাক জানান দেন, আধুনিক-পূর্ব জমানায় হিসবাহ কোনো ‘ল’ ছিল না। ছিল ট্র‍্যাডিশন বা নরম্যাটিভ প্র‍্যাকটিস। অর্থাৎ, ব্যক্তি মুমিন এইটাকে দায়ই মনে করতো যে, অন্যায়কে তার নিষেধ করতে হইবো। আর, নসিহাও কিন্তু a form of critique।


যাক, সাইদের বা ফুকোর সংজ্ঞা ধইরা যদি ক্ষমতার সামনে সত্য/বিব্রতকর সত্য বলাই যদি ইন্টেলেকচুয়ালিটি হয়, তাইলে কিন্তু মুমিন-মুসলামান মাত্রই ইন্টেলেকচুয়াল। এভরি ট্রুলি প্র‍্যাকটিসিং মুসলিম ইস এন ইন্টেলেকচুয়াল। এইটা না মানলেও কোনো অসুবিধা নাই। একজন মুসলিম যথার্থ আব্দুল্লাহ হলেই সে সফল, আর সব কিছুই তার কাছে নিম্নতম স্তরের।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক