জন্মটাই যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলা

মহাকালে রেখাপাত ৯২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০২৩

জন্মের পরই আমরা কেবল হারাতে থাকি। আমাদের জন্মটাই যেন কিছু একটা হারিয়ে ফেলা। কী হারিয়ে ফেলা? মাতৃগর্ভকে হারিয়ে ফেলা। আমরা মাতৃগর্ভের সেই নিশ্চিন্ত জীবন, সেই চৈতন্যহীন জীবন, সেই নিবিড় অবিশ্রান্ত ঘুম ত্যাগ করতে চাইনি। আমাদের যেন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তাই জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে উঠি। হারানোর বেদনায় চিৎকার করে কাঁদি।

তারপর মাতৃস্তন্য পান করছি। ভাবছি, এই স্তনটা আমার, আর কেউ এর ভাগীদার হবে না। অথচ ক’দিন পর দেখা গেল, আমার ভাই বা আমার বোন সেই স্তনে ভাগ বসিয়েছে। মায়ের কোলটাও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মায়ের বুকেও আর ঘুমাতে পারছি না। মা আমাকে ধীরে ধীরে আলাদা করে দিচ্ছে, দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। মায়ের স্তন হারিয়ে ফেললাম, বুক হারিয়ে ফেললাম, কোল হারিয়ে ফেললাম। অর্থাৎ, শৈশব পেরোনোর আগেই, জীবন কী তা বুঝে ওঠার আগেই হারানোর বেদনার মুখোমুখি হয়ে গেলাম।

তারপর খেলাধূলা করি। ভাবি, এটাই আমার জগৎ, এটাই আমার জীবন। এভাবেই খেলাধূলা করতে থাকব অনন্তকাল। এই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আমার। আমি চিরকাল এই মাঠে ঘুড়ি ওড়াব, ফড়িংয়ের পিছে পিছে ছুটব। এই দিঘি আমার। এই দিঘিতে চিরকাল সাঁতরে বেড়াব। এই বাড়ির উঠোন আমার। এই বাড়ির উঠোনে মাটির পুতলা বানাব, তাদের মনমতো সাজাব, তাদের সঙ্গে খেলব। এই যে বাবার আঙুল ধরে হাঁটছি, আঙুল ধরে পুকুরঘাটে যাচ্ছি, হাটে-ঘাটে-স্কুলে যাচ্ছি― চিরকাল এই আঙুল এভাবেই ধরে রাখব। কখনো এই আঙুল হারাব না। অথচ একদিন খেলাধূলা হরিয়ে গেল, মাঠ হারিয়ে গেল, ঘাট হারিয়ে গেল, মাটির পুতলা হারিয়ে গেল, বাবার আঙুলটাও হারিয়ে গেল। অর্থাৎ পৃথিবীকে ভালোবাবে বোঝার আগেই আমরা একের পর এক হারাতে থাকি। হারাতে থাকি আর বেদনার মুখোমুখি হই।

তারপর স্কুলে যাই। ভাবি, এভাবেই চলবে জীবন। তারপর যাই কলেজে। ভাবি, এটাই জীবন, এভাবেই চলতে থাকবে। অথচ দেখা গেল একদিন স্কুল ছেড়ে দিতে হলো, কলেজ ছেড়ে দিতে হলো। একইভাবে ইউনিভার্সিটিও ছাড়তে হলো। তারপর কর্মজীবন। বাড়িকেও হারিয়ে ফেলতে হলো। বাড়ি থেকে বহু দূরে সরে গেলাম। চলে গেলাম কর্মস্থলে। বাড়ি হারানোর বেদনাকে ভোলার জন্য নিজেকে তখন সান্ত্বনা দিই, বাড়ি নাই, চাকরি তো আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য তো আছে। ভাবি, সারাজীবন এভাবেই কর্ম করে যাব। চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্য করে যাব। অথচ দেখা গেল একদিন চাকরি থেকেও আমাকে অবসর নিতে হচ্ছে। চাকরিটা হারিয়ে ফেলাম। ব্যবসা-বাণিজ্যেও আর মন দিতে পারছি না। কোনো কিছুই আর টানছে না আমাকে।

ভেবেছিলাম সন্তানরা আমার। চিরকাল তারা আমারই থাকবে, কখনো হারাবে না। অথচ দেখা যায়, ধীরে ধীরে তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বিয়ে করছে, সন্তানাদির জন্ম দিচ্ছে, আমার কাছ থেকে আরও বেশি দূরে সরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারা গড়ে তুলছে অন্য এক জগত, যেভাবে একদিন আমি গড়ে তুলেছিলাম। একদিন জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীকেও হারিয়ে ফেললাম। আমারই চোখের সামনে সে শূন্যে মিলিয়ে গেল। হায় হারানো! হায় বেদনা!

জীবনে এভাবেই আমরা একের পর এক হারানোর মুখোমুখি হই, বেদনার মুখোমুখি হই। অমিয়ভূষণ একে বলেছেন ট্রমা। তিনি বলছেন, এই ট্রমার থেকে এসকেপ করার জন্য মানুষ সাহিত্য-কাব্য-কলা ইত্যাদি সৃষ্টি করে থাকে। সাহিত্য কী দেয়? অমিয়ভূষণ বলছেন, ব্রহ্মস্বাদ সহোদরম। ব্রহ্মস্বাদ দেয়। ‘সহোদরম’ অর্থাৎ প্রায় একই রকম। যোগী যখন ধ্যানে মগ্ন হন, তার যখন সমাধি অবস্থা, তখন তার ওরকম হয়। গর্ভস্থ ভ্রুণের মতো অবস্থা। সময় নেই, স্পেস নেই, কিছু টানছে না তাকে, সে ব্রহ্মকে আস্বাদ করছে। সমাধি অবস্থা। ব্রহ্মস্বাদ সহোদরম। সাহিত্যও মানুষকে এই সমাধিস্থ অবস্থায় নিয়ে যায়। ট্রমা থেকে দূরে নিয়ে যায়, বেদনা থেকে দূরে নিয়ে যায়।

২৮.১০.২০২৩