ভবঘুরে আদনানের গদ্য ‘ধর্ম ও ধর্মব্যবসা’

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২২

ধর্ম নয়, অথচ ধর্মের নামে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে অর্থ উপার্জন ও স্বার্থ সিদ্ধি করাকেই ধর্ম ব্যাবসা বলে। বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ীদের এখনও স্বর্ণযুগ চলছে। আমার ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে ফরিদপুর ভ্রমণের পর।

ডিসেম্বরের শীতের রাত। মধ্যরাতে আমি আর সফওয়ান হাঁটছি ঢাকার আড়িয়াল বিলের বুকের ওপর দিয়ে। নানা গল্পের মধ্য দিয়ে জানলাম, ওর ফুফুর বাড়ি ফরিদপুরে। ঢাকার খুব কাছেই। অথচ এই শহরে আমার যাওয়া হয়নি কখনো। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা হলো, আগামীকাল ভোরে আমরা ফরিদপুর যাব। বাউণ্ডুলে হিসেবে হুটহাট বের হয়ে যাওয়ার এ অভ্যাস আমার খুবই পুরনো।

পরদিন কুয়াশাঘেরা ভোরে আমরা বাইক নিয়ে রওনা দিলাম। শীতে ড্রাইভ করতে কষ্ট হবে বটে, কিন্তু পুরো ফরিদপুর একদিনে ঘুরে আসতে চাইলে এর চেয়ে উপকারী কোনো মাধ্যম নেই। নারিশা ঘাটে পৌঁছে বাইক ট্রলারে উঠিয়ে নিলাম। পদ্মা পাড়ি দিতে হবে ট্রলারে। পদ্মায় ভাসতে ভাসতে কয়েকটি চর দেখলাম। সেই ভোরবেলাতেই কৃষক কাস্তে হাতে গরুর পাল নিয়ে বের হয়ে গেছে। ক্ষেতে কাজে লেগে পড়েছে সাদা দাড়িঅলা দাদা ভাই। আবহমানকাল ধরে চলে আসা পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবনচিত্র এমনই।

তিন ঘণ্টা নদীভ্রমণ শেষে শয়তানখলী ঘাটে এসে নামলাম। জায়গাটার নাম এত অদ্ভুত কেন, এই নিয়ে বিরাট কৌতূহল কাজ করলেও নামকরণের শানে নুযুল উদ্ধার করতে পারিনি। যেহেতু আমাদের প্রথম টার্গেট আটরশি তথা মহাপবিত্র (!) বিশ্ব জাকের মঞ্জিল। তাই সেদিকেই এগুতে থাকলাম।  রাস্তা ভয়াবহ ভাঙা হওয়ায় আমাদের টার্গেটের চেয়ে সময় অনেক বেশি লাগলো।

যখন জাকের মঞ্জিলে পৌঁছলাম,  ততক্ষণে কুয়াশা কেটে রোদ উঠে গেছে। গেটে ঢুকতেই তিন গার্ড এসে বাধা দিয়ে বলল, দরবারে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে। অবাকই হলাম বেশ। ভেতরে না সিমেন্টের আস্তরণ, না টাইলস। সাধারণ মাটির রাস্তা, ঘাস আছে বিভিন্ন জায়গায়। আবার মুরগি, কুকুর, বিড়ালও দেখছি হাঁটাহাঁটি করছে। জুতা খুলে প্রবেশের মানে বোধগম্য হচ্ছে না।

পালটা প্রশ্ন করলাম, জুতা খুলেই কেন প্রবেশ করতে হবে?
তারা জানালো, জুতা নিয়ে প্রবেশ করা দরবার শরিফের শানের খেলাফ।

বললাম, যেখানে কুকুর, বিড়াল, আর মুরগির মতো প্রাণী হেঁটে বেড়াচ্ছে, সারাজীবনে তিন দিনও গোসল করে না এগুলো। তাতে দরবারের শানের খেলাফ হয় না? আর কুত্তা তো আইনুন নাজাস তথা মজ্জাগত নাপাক।

শেষমেষ জুতা খুলেই ঢুকলাম আমরা। গেইট দিয়ে ঢুকতেই দৃষ্টিনন্দন এক মসজিদ। সাদা রঙের ওপর রোদের আলো পড়ে সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের মতো আরও অনেকেই দেখতে এসেছে দরবার শরিফ। যাদের প্রায় সবাই বিশ্বঅলি আটরশি বাবার বাইয়াতপ্রাপ্ত মুরিদ বা ভক্ত। ক`জনকে জিজ্ঞাসা করলাম,  আপনারা মুরিদ হয়েছেন কেন? কেউ উত্তর দিতে পারল না। আর না পারারই কথা। বেশভূষায় তাদেরকে শিক্ষিত মনেও হয়নি। বেশিরভাগই ভেতরে একটা অন্ধবিশ্বাস লালন করে। তাদের ভাবনা হলো, পিরবাবা অলৌকিক কিছু করতে পারে। তার ইশারায় অনেক কিছুই হয়। যেমন পেটে বাচ্চা, ছেলে সন্তান জন্ম, সংসারে আয়, রোগমুক্তি, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া ইত্যাদি।

সাধারণদেরকে ধর্মের নামে অন্ধত্ব শেখায় মূলত কিছু শিক্ষিত চতুর খলিফা (পিরের বাইয়াতপ্রাপ্ত মুরিদ ও বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী!), যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে মূলত গদিনশীন পিরবাবা। তাদের হাতেগোনা অল্প কিছু সাহিত্যকর্ম আছে; যা শিক্ষিত মুরিদানরা পাঠ করে অধর্ম শেখে ও সাধারণ জনতাকে শেখায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. শাহ সূফী হযরত ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত।
২. ওলিদের কারামত।
৩. বিশ্ব জাকের মনজিল।
৪. আহলে বায়াত পাকপাঞ্জতন।
৫. খাজাবাবা ফরিদপুরীর কারামত।

যাই হোক, এই তাত্ত্বিক আলাপ বেশি হলে আবার ভ্রমণ রিভিউ পড়ার ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে সবাই। আমরা মসজিদ থেকে পূর্বদিকে কিছুক্ষণ হেঁটে গিয়ে দেখতে পেলাম, মাজার শরিফ। যেখানে শায়িত আছে খাজাবাবা ফরিদপুরী। আমরা প্রবেশ করলাম। সুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। ঝকঝকে পরিবেশ। চোখ ধাঁধানো সুন্দর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কবর।

কবরের কাছে কারও যাওয়ার সুযোগ নেই। গ্রিল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে চারপাশ। ভেতর থেকে কড়া গন্ধ আসছে। আগর পুড়ানো গন্ধ। ক্যামেরা নিষিদ্ধ হলেও আমরা কায়দা করে একটা ছবি তুলে নিলাম। বের হওয়ার সময় সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো কয়েকজন। বলতে  লাগলো, পেছন ফিরা বাইর হন। এমনে সোজা বাইর হইলে বাবার শানে বেয়াদবি হয়।

হোয়াট দ্যা ফাউ কথা ম্যান! সোজা হয়ে হেঁটে আসলে যদি বেয়াদবি হয়, তাইলে উলটো হয়ে হাঁটলে বাবার সাথে মশকরা হবে না কেন? মক্কা, মদিনা কিংবা আল আক্বসার মতো পবিত্র স্থানেও এমন নিয়ম নেই। হায়রে মানুষ-পূজা!

ওখান থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম আরও উত্তর-পূর্ব দিকে। উল্লেখ্য যে, প্রায় একটি গ্রামের সমান জায়গা এই জাকের মনজিলের সম্পত্তি। সেখানের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই রয়েছে শালা। অর্থাৎ মুরিদরা বাবার দরবারে যে হাদিয়া নিয়ে আসবে সেগুলো এখানে রাখার স্থান। যেমন মুরগিশালায় থাকবে শুধুই মুরগি। হাসশালায় হাস। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম তাদের গরুশালা দেখে।

একটি হাঁটের সমান মাঠ কেবল গরু রাখার জন্য। ওরসের সময় মুরিদানরা এত পরিমাণ গরু নিয়ে আসে যে, এই মাঠে নাকি জায়গা হয় না। আমরা যখন গেলাম তখনও নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অন্তত ৫০টা নানা সাইজের গরু। শুধুই কি গরু? হরিণ, মহিষ, ছাগল, পাঁঠা, মোরগ, উট, দুম্বা ইত্যাদি নানা প্রাণীর কিছুর জন্য আলাদা আলাদা দেয়াল করে জায়গা বানিয়ে রেখেছে তারা। আবার এসব দেখভালের জন্য কয়েক শ্রেণির কর্মচারীও আছে।

আমরা আনুমানিক একটা হিসেব করার চেষ্টা করছিলাম যে, প্রতিদিন মুরিদদের থেকে কী পরিমাণ অর্থ এই দরবারে হাদিয়া হিসেবে আসে। পালের বড় গরু, বড় মাছ, গাছের প্রথম ফল বাবার দরবারে নিয়ে দান করা মহাপূন্যের কাজ বলে শেখানো হয় ধর্মান্ধ মুরিদদের। আর তারাও এখানে উচ্ছ্বাসের সাথে দান করে। পকেট ভারি হয় পিরবাবার পরিবারের। মনে মনে ভাবছিলাম, পৃথিবীতে ধর্মব্যাবসার মতো বিনা পুঁজিতে এত প্রফিটেবল বিজনেস বোধহয় আর একটাও নেই।

সকালে নাস্তা না করায় ততক্ষণে বেশ ক্ষুধা পেয়েছে আমাদের। দরবারের নিজস্ব ক্যান্টিনে এসে খেয়ে নিলাম। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তবে খাবারের পরিমাণের চেয়ে দাম অপেক্ষাকৃত কম।  নাস্তা শেষে আমরা বের হয়ে গেলাম ধর্মব্যাবসার অন্যতম কেন্দ্রভূমি জাকের মনজিল থেকে।

এরপর ছুটে গেলাম ফরিদপুরের বিখ্যাত বাইশরশি জমিদার বাড়িতে। আটরশি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই এর অবস্থান। ১৮০০ শতকের দিকে এই বাইশরশি জমিদার বাড়ি তৈরি করে এক হিন্দু ধনকুবের। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার বিচারে এটির বয়স খুব একটা বেশি না হলেও যত্নের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থা। ৫০ একর জায়গা জুড়ে জমিদারদের বসবাসের জন্য ১৪টি অট্টালিকা তৈরি করা হয়েছিল এখানে। ৫টি শান বাঁধানো ঘাটলা তৈরি করা হয়েছিল।

বাড়ির সামনের ঘাটলাটিতে আমরা বেশ কিছুক্ষণ আরাম করে বসে রইলাম। এখনও পানি আছে সেটিতে। তবে জমিদার বাড়ির অন্যান্য স্থাপনার বেশিরভাগই এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। বাড়ির ভেতরেটা অনেকটা ধ্বংসস্তূপের মতো হলেও একটা সময় যে এই বাড়িতে বসবাসরত মানুষজন বেশ শৈল্পিক মননের ছিলেন, তা বাড়ির ক্ষয়ে যাওয়া কারুকার্য দেখেই উপলব্ধি করা যায়।

আমরা বাড়ির ভেতর দিকের একটা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা এক ধরনের ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বাড়িজুড়ে। সরকারি উদ্যোগের অভাবে স্থানীয়দের দখলে চলে গেছে ভবনগুলো। কেউ বসতি না বানালেও গাঁজার আড্ডা যে জমে, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমরা ছাদে যেতেই কয়েকজন তরুণ সতর্ক অবস্থানে গেল। বরাবরের মতোই আমার তখন আফসোস হচ্ছিল, এত চমৎকার বাড়িগুলো ক্রমশ চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছে অযত্নে। শুধু এটাই নয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ জমিদার বাড়িই নিষ্ঠুর অবহেলার শিকার।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমরা জমিদার বাড়িকে বিদায় জানালাম। এবারের গন্তব্য ভাঙা উপজেলার পাতরাইল মসজিদ। ভাঙা-মাওয়া ৪ লেনের সড়ক পেয়ে আমাদের দু`পায়ের পাগলা ঘোড়া দৌড়ে ছুটলো। ৪০ কিলোমিটার দৌড় শেষে আমরা মসজিদ প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছলাম। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ১৩৯৩ হতে ১৪১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। এ ঐতিহাসিক মসজিদের দক্ষিণ পাশে চির নিন্দ্রায় শায়িত আছেন মহান আউলিয়া খান। মসজিদের আঙিনায় আছে মস্তান দরবেশ নাজিমদ্দিন দেওয়ানের মাজার।

জনশ্রুতি আছে, অত্র এলাকায় প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা নিরসনকল্পে ও ইবাদতের জন্য মসজিদের পাশে ৩২.১৫ একর জমির ওপর একটি দিঘি খনন করেন গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। লাল ইটের পুরোনো মসজিদ। দারুণ সব কারুকার্য মুগ্ধতা এনে দেবে। এই মসজিদের ডিজাইনের সাথে রাজশাহীর ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদের কিছুটা মিল আছে। আমরা মসজিদের চতুষ্পার্শ্ব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পদ্মার তীরঘেঁষা ফরিদপুরে এসে যারা এমন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ তৈরি করেছিল, সেইসব মহা নায়কদের দেখার খুব সাধ জাগলো। যদি সম্ভব হতো...

এবার আমাদের যাত্রা পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের বাড়ি অভিমুখে। যদিও আমাদের পরিকল্পনা ছিল সাতৈর মসজিদে নামাজ পড়ব এবং কানাইপুর জমিদার বাড়িতেও কিছুক্ষণ থাকব। কিন্তু সকালে ট্রলারে ৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় হওয়াতে সেই সুযোগ আর থাকল না। আপাতত আমরা এই দুটি জায়গা স্কিপ করে কবির বাড়ির দিকে ছুটে চললাম। পাতরাইল মসজিদ থেকে কবির বাড়ির দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। হাইওয়েতে উঠে বাইকের অ্যাকসেলেটর সবটুকু বাড়িয়ে দিয়ে শা শা করে ছুটতে থাকলাম। অর্ধেকটা পথ সর্বোচ্চ গতিতে রান করালেও পরে রাস্তার দূরাবস্থার কারণে গতি কমাতে হলো।

পল্লীকবির বাড়িটি একেবারে নদীর কূল ঘেঁষে। আমরা যখন কবির বাসায় পৌঁছলাম, তখন সেখানে কোনো ভিড় নেই। পর্যটক বলতে কেবল আমরাই। দুপুর হওয়ার কারণে এই হলো সুবিধা। কবির বাড়িতে রয়েছে পুরাতন ৪টি টিনের চালাঅলা ঘর। কবির ঘরটি বাড়ির পূর্বদিকে। কবি সেখানে বাসর করেছিলেন। বাসররাতে টিনের দেয়াল কেটে ঘরের সব আসবাব চুরি করে নিয়ে ইতিহাস রচনা করেছিল চোর। বসতবাড়ির সব ঘরেই রয়েছে তার ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। আমরা সবগুলো ঘর ঘুরে দেখলাম। সবখানেই শোভা পাচ্ছে প্রিয় কবির সৃষ্টিকর্ম। ১৯০৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত দীর্ঘ জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় তিনি এখানেই কাটিয়েছেন।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ছিল কবি জসিম উদ্দীনের গলায় গলায় খাতির। কাজীদা ছিলেন জসীম উদ্দীনের অনুপ্রেরণা। জসীম উদ্দীন কবি হয়ে ওঠার পেছনে নজরুলের ভূমিকা ছিল সবার ঊর্ধ্বে। কবি নজরুল বাংলায় এলে সুযোগ হলেই জসীম উদ্দীনের বাড়িতে আসতেন। জসীম উদ্দীনকে কবি নাম ধরেই ডাকতেন। পদ্মার পাড়ে গানের আসর বসাতেন আড্ডাবাজ প্রিয় নজরুল। আমরা যেখানে হাঁটছিলাম, বসছিলাম ঠিক সেখানে কয়েক বছর আগেও পদচারণা করেছিলেন  প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল এবং আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি জসীম উদ্দীন। ভাবতেই কেমন অচেনা এক অনুভূতি ভেতরে দোলা দিয়ে গেল।

বাড়ির উত্তরে রাস্তার পাশেই কবির কবরস্থান। তার দাদির কবরের পাশেই তিনি শায়িত। সেই ঐতিহাসিক ডালিম গাছের তলে। যেখানে কবি রচনা করেছিলেন বিখ্যাত কবিতা—
এইখানে তোর দাদীর কবর
ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি
দুই নয়নের জলে।

কবির বাড়ির নিচে তথা নদীর সামনে বিশাল জায়গায় রয়েছে আগত দর্শনার্থীদের জন্যে বসার স্থান। আমরা সেখানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। নদীর পানি ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস এসে আমাদের ক্লান্তিকে নিমিষেই তাড়িয়ে দিল। আমরা যেখানে চা খাচ্ছি সেখানে কি জসীম উদ্দীনও চা খেতেন? বসে গান ধরতেন, আমায় ভাসাইলি রে আমায় ডুবাইলি রে...
অথবা, আমার হাড় কালা করলাম রে...
কিংবা, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে...
অথবা নজরুল কি এইখানে বসেই বাঁশির সুর তুলতেন?

অনেকটা বিকেল জসীম উদ্দীনের বাড়িতে কাটিয়ে আমরা এবার বের হলাম। দুপুরে খাবারের সময় চলে যাচ্ছে। এখান থেকে ৩২ কিলো দূরে সদরপুর উপজেলায় সফওয়ানের ফুফু বাড়িতে গিয়ে খেতে হবে। আমাদের পাগলা ঘোড়া আবার ছুটে চলল। আমাদের পেয়ে বাড়ির লোকজনের সে কী উচ্ছ্বাস! কিন্তু সমস্যা বাধল অন্য জায়গায়। অতি আদরে খেতে খেতে আমাদের খানিকটা দেরি হয়ে গেল।

যেই ঘাট দিয়ে আমরা ফরিদপুর এসেছি সেখানের ট্রলার ঢাকা তথা দোহারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ৫টায়। এরই মধ্যে ট্রলার ছেড়ে চলে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, চরভদ্রসন উপজেলার গোপালপুর ঘাট দিয়ে যাব। সেখানের ট্রলার নাকি অপেক্ষাকৃত দেরিতে ছাড়ে। অচেনা রাস্তা, গুগল ম্যাপের সাহায্যে এগুতে থাকলাম। হঠাৎ মাঝরাস্তায় বাইক বন্ধ হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও স্টার্ট দিতে পারলাম না।

কী মহা বিপদ! যে কোনো বিপদকে হাসিমুখে বরণ করে সেটাকে আরও আনন্দঘন করা অভ্যাস আমাদের আছে। একদম রিল্যাক্সমুডে বসে রইলাম। প্রকৃতি হয়তো আমাদের ছাড়তে চাইছে না। তাই আজ রাত এখানেই থেকে যাব। কিছুক্ষণ পর বেখেয়ালিভাবে কিক করার পরে স্টার্ট হলো বাইক। লক্ষ্যপানে ছুটতে থাকলাম।

ট্রলার ঘাটে এসে শুনি, এখানের ট্রলারও কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। ব্যাপার না। পাশেই চায়ের দোকান আছে। সারারাত চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ঘাটে বসে গল্প শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে পেছন থেকে একজন ট্রলার চালক আমাদেরকে ডেকে নিল। ওনার ট্রলার রিজার্ভে যাচ্ছে। আমাদেরকে ওইপাড়ে নামিয়ে দেবে। তবে কিছু বেশি টাকা গুণতে হবে। আমরা বাইক ট্রলারে ওঠালাম।

ট্রলারের ছাদে শুয়ে আছি। মাথার ওপরে চাঁদ জোছনা বিলিয়ে দিচ্ছে। জল ও জোছনার কী অসহ্য সুন্দর মেলামেশা! পদ্মার বুক চিরে এগিয়ে চলছি আমরা। ছোট ছোট ঢেউগুলো শব্দ তুলে আমাদের জানান দিচ্ছে— আলবিদা, আলবিদা।