মমতায় ধরাশায়ী মোদি, বাড়লো রামশাসনের অপেক্ষার প্রহর

সোহেল রানা

প্রকাশিত : মে ০৪, ২০২১

খেলা দেখিয়েই ছাড়ল অনুব্রত মণ্ডলরা। পশ্চিমবঙ্গে দিদিই থাকছেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। আপাতত মমতার দল তৃণমূল পেয়েছে ২১৩টি আসন। হাঁকডাক দেয়া বিজেপির রথ থেমে গেছে ৭৭ এ এসে। বাম-সিপিএম শূন্য। কংগ্রেস শূন্য। সোশাল মিডিয়া মুখিয়ে আছে মাঠ গরম করা ভাইজানকে নিয়ে। আর এদিক দিয়ে কংগ্রেস একদমই টিভি স্ক্রিন থেকে লাপাত্তা।

আট দফার বিধানসভার ভোট যেদিন শেষ হলো, সেদিন রাতেই তৃণমূলের আকাশে দেখা দেয় বিজয়ের চাঁদ। মিডিয়াপাড়ায় হইচই, দিদিই আসছে। দিদিই আসছে। বুথফেরত জরিপগুলোর ফলাফল এমনই সিগনাল দিচ্ছিলে। আর রোববার স্পষ্ট হলো, জরিপের ফলাফল বৃথা যায়নি। মমতা দিদিই এলেন। ঘাসফুলের ত্রিসীমানায় এসে নেতিয়ে পড়েছে পদ্মফুল আর গেরুয়া ঝড়। সাত সপ্তাহেরও বেশি সময় পর হুইল চেয়ার ছেড়ে মমতাকে হাঁটতে দেখল গোটা ভারতবাসী। ভোটের লড়াইয়ে তিনিই এখন জয়ী। দুশোরও বেশি আসন তার হাতের মুঠোয়। বিপরীতে গেরুয়া শিবির দুই অংকের ঘরেই পড়ে থাকলো।

কিন্তু মমতার টিকে থাকা কি এত সহজ ছিল? নরেন্দ্র মোদি যখন হেলিকপ্টারে/বিমানে উড়ে এসে ডজনের বেশি সভা করে গেছেন, দিদিকে ছুড়ে ফেলার ডাক দিয়েছেন, মমতা তখন হুইল চেয়ারে বসেই বিজেপির বিশাল নির্বাচনী ক্যাম্পেইন আর প্রোপাগান্ডা মোকাবেলা করেছেন। ভাড়াটে বিজেপি নেতাদের গালমন্দ ক্ষিপ্রতার সাথে উড়িয়ে দিতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েকে। ১০ মার্চ নিজের নির্বাচনী এলাকা নন্দীগ্রামের বিরুলিয়ায় আহত হন মমতা। তারপর থেকে তার নিত্যসঙ্গী হুইল চেয়ার। রোববার ফল ঘোষণা শুরুর পর আগের সেই পরিচিত ভঙ্গিমায় দেখা যায় মমতাকে। কারণ তার লোকজন ততক্ষণে খেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে তাহলে রামশাসনের অপেক্ষা আরো দীর্ঘতর হলো!

ভোটের লড়াইয়ে মমতা বাস্তবেই ছিলেন একা। কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকা বিজেপিকে মোকাবেলা করতে মমতার যখন শক্তিশালী সহযোদ্ধা দরকার ছিল, তখন তাকে একা ছেড়ে দিয়ে দলের অনেকেই ভিড়েছেন গেরুয়া শিবিরে। এ তালিকায় একপাল অভিনয় তারকাও ছিলেন। ফলে পরিস্থিতি যা দাঁড়ালো, একদিকে হুইল চেয়ারে বসা মমতা, অন্য দিকে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ। এ যেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই। আসাম ও ত্রিপুরা করায়ত্ত করে পশ্চিমবঙ্গকে লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন মোদী। এবারের বিধানসভা নির্বাচনটি ‘মোদী বনাম মমতা’ লড়াইয়ে রূপ নেয়ার কারণও এটি।

মোদির নির্বাচনী বহরে আরো ছিলেন সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথ, ধর্মেন্দ্রপ্রসাদ, কৈলাস বিজয়বর্গীয়। পশ্চিমবঙ্গে এরা সবাই বহিরাগত, ভাড়াটে নেতা। এই বহিরাগতের দল যাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে দিদিকে গদিছাড়া করতে চেয়েছিল সেই দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের এখন মাথায় হাত। গেরুয়া রথ বুঝি আর এগোবেই না? কী লাভ হলো মোদিকে দিয়ে দেড় ডজন সভা করিয়ে? অমিত শাহের অর্ধশতাধিক পথসভা আর জনসভার প্রাপ্তিই বা কী?

বিজেপির তরফে বলা হচ্ছিল, এবার মমতাকে বিদায় নিতেই হবে। এমনকি বাক্সপেটরা গুছিয়ে নীলবাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতিও নিতে বলা হয় মমতাকে। কীসে গেরুয়া শিবির এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল? আসলে তাদের আশান্বিত করেছিল গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পদ্মফুল ২৯৪টির মধ্যে মাত্র ৩টিতে জিতলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দারুণ চমক দেখায়। জাতীয় নির্বাচনটিতে তারা জিতে নেয় ১৮টি আসন। সেই হিসেব ঠিকঠাক থাকলে এবারের বিধানসভার ভোটে অন্তত শতাধিক আসনে জেতার কথা তাদের, যদিও স্বপ্ন ছিল দুইশো আসনের ঘর পূরণ করবে। কিন্তু গেরুয়া শিবির দুই অংকের ঘর ডিঙাতেই পারল না। আকাশে ওঠার সেই স্বপ্ন থেকে তাদের মাটিতে নামিয়ে আনলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। দিদি এখন গোটা ভারতের প্রধান বিরোধী মুখ।

মূলত মমতাই ছিলেন গেরুয়া রথীদের মূল টার্গেট। আর সেকারণেই আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালাসহ আরো চারটি রাজ্যে নির্বাচন হলেও বিজেপি তার পূর্ণ শক্তি লেলিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। ধর্মীয় বিভাজন আর বাংলাদেশ বিরোধী সেন্টিমেন্ট তারা ছড়াতে চেয়েছে রাজ্যজুড়ে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তাই রীতিমত অংক কষে ভোট দিতে হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে বাঙালি হিন্দুরা যেভাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, এবার ভোটের ফলাফলই বলছে তারা আগের মত ভোট দেন নি৷ বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের প্রচার যেভাবে তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম ভোটারদের এক করেছে, বিপরীতে হিন্দুদের তাদের পক্ষে এক করা যায়নি। বিজেপি ঠেকানোর এই নিশানায় বাম আর ফুরফুরা পীর সাহেবের ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) ভোটও গেছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের বাক্সে। ক্ষমতার রশি টানাটানিতে বিজেপি পড়ে গেছে খাদে। এত এত নায়ক-নায়িকা, শিল্পী ও অভিনেতাকে লালসা দেখিয়ে দলভারী করে কী লাভটা হলো? তৃণমূল থেকে যারা বিজেপিতে ভিড়েছিলেন তাদের এখন কপাল চাপড়ানোর পালা।

রোববার হুইল চেয়ার ছেড়ে মমতা যখন প্রকাশ্যে এলেন, ততক্ষণে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি শিবির পুড়ে ছারখার। তবে নন্দীগ্রামে তিনি জিততে পারেননি। অবশ্য প্রথমে জানা যায়, ১২০০ ভোটে নন্দীগ্রামে জয়ী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও পরে উল্টো খবর আসে। মমতা নয়, শুভেন্দু অধিকারীই ওই কেন্দ্রে জিতেছেন। কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশে মমতা সেদিন বললেন, এই জয় আপনাদের জন্য এসেছে। বাংলার জয়ে ভারত বাঁচলো।

কিন্তু এই জয়ের সমীকরণ মেলাতে এখন ব্যস্ত মিডিয়াগুলো। নির্বাচনী বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন কংগ্রেস এমনকি বিজেপির একটা অংশের ভোটও গেছে মমতার ঝুলিতে। তাজ্জব ব্যাপার। বিজেপি যেখানে তৃণমূল আর বাম নেতাদের একজন একজন করে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে, সেখানে নিজেদের ভোটাররা যে মমতার ছাতার নিচে ঠাঁই নিয়েছে তারা সে খবর রাখেইনি। বিজেপি যখন রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচার চালায়, মমতা তখন মধ্যবিত্ত, মহিলা আর সংখ্যালঘু ভোটারদের একত্রিত করে ফেলেছেন।

লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই গেরুয়া দাপট শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। শেষমেশ বিরোধী দল হিসেবেই বিজেপির যাত্রা সাঙ্গ হলো। গেরুয়া খুঁটি মজবুত করতে ভোটের আগে বারবার রাজ্যে ছুটে এসেছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি শিবিরের বড়-ছোট প্রায় সব নেতাই। গরম গরম আওয়াজ আর প্রতিশ্রুতির বান্ডেলে বুঁদ করতে চেয়েছিলেন ভোটারদের। কিন্তু একাই তাদের আটকে দিতে সফল হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝিয়ে দিলেন, বিজেপি অপরাজেয় নয়। এই মুহূর্তে বাংলার রাজনৈতিক নাড়ি-নক্ষত্র বুঝতে তার জুড়ি নেই।

বাংলা বরাবরই ছিল বিজেপির নাগালের বাইরে। তবে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর। নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস ভোট কার্যত মুঠোবন্দি করার পরেই বাংলা দখলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেন মোদী-অমিত শাহ। কিন্তু গেরুয়াদের হতাশ করলো ভোটাররা৷ তবে দল জিতলেও নিজের আসনে হেরেছেন মমতা ব্যানার্জি। তাই প্রশ্ন সামনে এসেছে মমতার ভাগ্য কী হবে? তিনি কি টানা তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন?

ভারতীয় মিডিয়া বলছে, তাদের সংবিধানে এমন সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্য মমতাকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হবে । সংবিধানে বলা আছে, কেউ হেরে যাওয়া সত্ত্বেও তার দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং দলের নতুন বিধায়কেরা তাকে নেতা বা নেত্রী নির্বাচিত করেন, তাহলে ওই প্রার্থীর মুখ্যমন্ত্রী হতে কোন আইনি বাধা নেই। তবে তাঁকে ওই পদে বসার দিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রত্যক্ষ ভোটে জিতে আসতে হবে।

তার মানে, মমতাকে নির্বাচনের পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে যে কোনো একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে আসতে হবে। আর এজন্য তৃণমূলের কোনো একজন নির্বাচিত বিধায়ককে পদত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। উপনির্বাচনে জয় পেলে মমতা অনায়াসে পাঁচ বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাতে পারবেন।

আচ্ছা, মমতা দিদি তো তাহলে থেকেই যাচ্ছেন। বিজেপিও হাঁকডাক দেবার মত কিছু আসন পেলো। কিন্তু কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গ দাপিয়ে বেড়ানো বামদের কী হলো? আহ সিপিএম! কোথায় হারিয়ে গেলে? কংগ্রেসেরই বা কী খবর? চলুন এবার তাদের একটু খোঁজ নেওয়া যাক।

এবারই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দেখতে চলেছেন এমন এক বিধানসভা, যেখানে বামপন্থীদের কোনও আসন নেই। ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা বামরা তাহলে ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে মরে ভূত হয়ে গেলো? সিপিএম-সহ রাজ্যের বামপন্থী দলগুলির কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবেনা বিধানসভাতে। বামপন্থীদের নিয়ে গড়া সংযুক্ত মোর্চার থালায় ভাতের টান পড়েছে,আরেক বড় শরিক কংগ্রেসেরও হাল হয়েছে তাই। শুধু রাজ্য বিধানসভা নয়, লোকসভা, রাজ্যসভা-সহ কেন্দ্রীয় আইনসভাতেও এই মুহূর্তে অস্তিত্বহীন পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম।

এই শূন্যতা মমতার কণ্ঠকে আরো কতটা তেজি আর ক্ষিপ্র করে তুলবে সে দুশ্চিন্তায় তৃণমূল বিরোধীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবার কথা। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির কট্টর জাতীয়তাবাদের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের জাতীয়তাবাদ আরো পোক্ত হচ্ছে না তো? একঝাঁক তরুণ এসে বামদের নুইয়ে পড়া খুঁটি ধরে নাড়াচাড়া করার পরও কেন এমন হাল হলো?

১০ বছর আগেই পশ্চিমবঙ্গে লাল দুর্গ ভেঙে পড়েছে। বামদের জায়গায় এসেছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস।  এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনে ২৬টি আসন পেলেও বিরোধী দলের মর্যাদা হারায় সিপিএম। তারপর বামদের কপালের ঘা কতটা ঘ্যানঘ্যানে হলো, সেটি আপনারা গ্রাফেই দেখে নিন।

ভালো কথা, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশিদের আগ্রহ বেশ প্রেরণাদায়ক। কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাক্কা যেখান থেকে আসার কথা, সেই আসামের নির্বাচনের খোঁজ খবর আমরা রাখছি তো?