
মারিয়া সালামের গদ্য ‘প্রত্যেক মানুষ গল্পের একেকটা চরিত্র’
প্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০২২
সালমান রুশদির দুইগালে
জুতা মার তালে তালে...
সালমান রুশদির চামড়া
তুলে নেব আমরা...
বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রাস্তায় মিছিলের চলে যাওয়া দেখতাম। মশাল জ্বেলে একেকটা ছোট ছোট মিছিল চলে যেত রাস্তার মাথায়। সবাই একসাথে যেয়ে মিলবে সাহেব বাজার মোড়ে। তারপর কোথায় যাবে, যেয়ে কী হবে, বা কেনই বা যাবে, সে প্রশ্নের উত্তর আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক খুঁজে পেত না।
উত্তর না পেলেও মিছিল দেখে দেখে খুব উত্তেজনা কাজ করতো আমার। ছেলেবেলায় ভাবতাম, জীবনটা ম্যাড়মেড়ে। কারো বিয়েতে যাওয়া নিষেধ, রাস্তায় খেলতে যাওয়া নিষেধ, বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ, টিভি দেখা নিষেধ, এমনকি গান শোনার জন্যও সময় বেঁধে দেওয়া ছিল। আমি সারাদিন বই পড়তাম আর ছাদে বা জানালায় দাঁড়িয়ে মানুষ দেখতাম। প্রত্যেকটা মানুষকে আমার গল্পের একেকটা চরিত্র বলে মনে হতো।
এই যে মিছিলে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের সবাই কোনো না কোনো গল্পের চরিত্র। যার ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে, সেই সালমান রুশদি কে? সেও কোনো একটা গল্পের চরিত্র। কোন গল্প?
বাপিকে জিজ্ঞাস করতেই বাপি কেমন একটা থতমত খেল। বিরক্ত হয়ে বলল, মহা মুশকিল। আমি জানি সে একজন লেখক। কি যেন লিখেছে, আল্লাহকে গালি দিয়েছে সম্ভবত। আর কিছু জানি না। না জেনে বলব কিভাবে?
সেই, না জেনে বলবে কিভাবে? কিন্তু, লোকটা এমন কি বলল যে, ফাঁসি হবে? লেখার জন্য ফাঁসি? আল্লাহকে গালি দিলে ফাঁসি? একের পর এক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তর দেওয়ার কেউ নাই। শের আলী আমার চার নম্বর মামা। সে প্রায়ই মিছিলের লিড দিত।
ওকে জিজ্ঞাস করলাম, আল্লাহকে গাল দিলেই কি ফাঁসি হবে?
খবরদার, নাস্তিকের মতো প্রশ্ন ক্যরবা না। যাও, যা বুলছি কর। আমার আলনা থ্যাক্যা ছিরা প্যান্টটা লিয়্যা আসো।
আমি মাথা দুলিয়ে চলে গেলাম।
সন্ধ্যা বেলাতেই বাড়ির উঠানে খড় দিয়ে একটা পুতুল বানানো হলো। তাকে বেশ যত্ন করেই শার্ট, প্যান্ট, টাই, জুতা, ইংলিশ টুপি এসব পরানো হলো। যন্ত্রণা বাঁধল মুখ আঁকতে যেয়ে। সাদা কাপড় দিয়ে গোল করে মাথা বানানো হয়েছিল, তার উপরে আলকাতরা দিয়ে চোখ-মুখ আঁকাতে হবে। কে আঁকাবে?
ভিড়ের মধ্যে থেকে ভয়ে ভয়ে হাত তুলে বললাম, আমি আঁকাবো?
আঁকাও, শের আলী হাতে পাটকাঠি ধরিয়ে দিল। পাটকাঠির মাথায় নরম কাপড় লাগানো, সেটা আলকাতরায় ডুবিয়ে আমি আঁকাতে শুরু করলাম। এরকম উত্তেজনাকর আন্দোলনের অংশ হতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হচ্ছিল। আমার সমবয়সী কেউ কিন্তু জটলার মধ্যে নাই, আমি বাদে বাকি সবাই অন্তত আমার দশ বছরের বড়। আমি খুব ভাব নিয়ে বললাম, লোকটা দেখতে ক্যামন? এমন অবস্থা যেন বলামাত্র হুবুহু সালমান রুশদির মতো করেই মুখ এঁকে ফেলব!
পাকামি বন্ধ করে, লক (চুপ) ক্যোর্যা মুখ আঁকিয়্যা ফেল, শের আলীর ভয়ে আমি আর কথা না বাড়িয়ে কাজ শেষ করলাম। তারপর সবাই সেই পুতুল নিয়ে হৈহৈ করে বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টে সালমান রুশদিকে ফাঁসিতে চড়াল।
অনেকদিন সালমান রুশদি বাড়ির সামনে ফাঁসিতে ঝুলে থাকল। আমি বিকাল করে ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে লোকটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। লোকটা লেখক, তার বই পড়া যাবে না? যে বইটাতে আল্লাহকে গালি দিল সেটা কোথায় পাব? প্রতিদিন এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেত, কিন্তু ভুলেও কাউকে জিজ্ঞাস করতে পারতাম না। আবার নাস্তিক বলে বকা দেয় কেউ!
যখন প্রথম সুযোগ হলো, সালমান রুশদির মিডনাইটস চিল্ড্রেন পড়ে ফেললাম। আমার জন্মের বছরে লেখা। পোস্টমর্ডান লেখা তখনও কিছু বুঝি না। সমরেশ, শীর্ষেন্দু পড়া লোক আমি, সালমান রুশদি বুঝি না, ইংরেজি তখনও সব বুঝি না। হতাশ হলাম, নিজের উপরে, লেখকের উপরে।
এরপর, বহুপরে হাতে পেলাম সেটানিক ভার্সেস। দ্রুত পড়তে থাকলাম, একটানে। আবার পড়লাম। কি ছিল এই উপন্যাসে? এটি সম্ভবত নবি মুহাম্মাদের (স.) জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। কারও কারও মতে, কুরআনের কিছু আয়াত ফেরেসতার রূপ ধরে শয়তান এসে বলে গিয়েছিল। শয়তান বলল, মুহাম্মাদের লোকেরা এখন থেকে তৎকালীন মক্কার পেগান দেবতা, লাত, উজ্জা এবং মানাতেরও পূজা করতে পারবে। বিষয়টা বুঝার আগেই শয়তানের কথার উপরে ভিত্তি করে প্রার্থনার সময় লোকেরা লাত, উজ্জা এবং মানাতের পূজা করে ফেলেছিল। সেই আয়াতগুলোকেই শয়তানের বাণী বলা হয়।
উপন্যাসটির যে অংশে শয়তানের বাণী সম্পর্কিত বিষয় আছে সে অংশটুকু প্রথম সহস্রাব্দের ইসলামি পণ্ডিত আল-ওয়াকিদি এবং আল-তাবরিরি-র সূত্র অনুসরণ করে লেখা হয়েছিল। ব্যস, মুসলমানরা এটা নিয়ে হৈহৈ শুরু করে দিল। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী ১৯৮৯ সালে সালমান রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করল আর দেশে দেশে শুরু হলো, রুশদি বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ফসলই হয়তো আজকের হামলা।
যখন সাহিত্য পড়ে মজা পাওয়া শুরু করলাম, তখন দেখি রুশদির লেখায় জাদুবাস্তবতা, ইতিহাস বা মিথের ব্যবহার, এগুলো আমাকে খুব টানে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, লেখকদের ওপরে লেখকদের প্রভাব নিয়ে রুশদি নিজেই বলেছিলেন, `কিছু লেখকদের পড়তে হয় এজন্য যে আমি তাঁদের মতো লিখতে চাই, যখন বুঝতে পারি এই চাওয়াটাই অসম্ভব চাওয়া, তখন অনুপ্রাণিত হয়ে লিখি।`
আমার লেখালেখি কিছু হয় না, আমার জ্ঞান খুব ক্ষুদ্র। তবু, লেখার সময় সালমান রুশদি, ইয়েস্তেন গার্ডার আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাইনগুলো চোখের সামনে ভাসে। আমি ক্ষুদ্র, সেসব ধারণ করলেও বহন করার শক্তি আমার নাই।
দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন লেখক, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক