মিনহাজুল ইসলামের গদ্য ‘অর্থনৈতিক ইতিহাস পাঠ’

প্রকাশিত : আগস্ট ০৯, ২০২২

ইতিহাস বিষয়ক পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ সেদিন থেকেই যেদিন মার্কসের লেখা পড়তে যেয়ে হোচট খেলাম আর বুঝতে পারলাম, ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া মার্কসের লেখা পড়া অসম্ভব, বোঝা তো বহ দূরের বিষয়। বিশেষ করে পুঁজিবাদ নামক যে বিষয়টি, কম করে হলেও ১২০ বছরে বুদ্ধিমহলে সম্ভবত সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। অল্পস্বল্প ইংরেজি জানায় দার্শনিক হেগেলের কিছু লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বিধায় সবকিছুকে ইতিহাসের জায়গা থেকে দেখার একটা বাতিক তৈরি হয়েছে৷ সেই বাতিক থেকে পুজিবাদকে পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক জায়গা থেকে দেখার আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টা অনেক দিন যাবত চলছে। অর্থনৈতিক ইতিহাস ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি সাংস্কৃতিক ইতিহাস বোঝাও দায়। মার্কসের মতে, The Conditions of Economic system is the most important materialist conception of history and society।

অ্যাডাম স্মিথের ভাষায়, Modern man merely an economic man। অর্থাৎ, আধুনিক জামানার মানুষ মাত্রই অর্থনৈতিক জীব৷ অ্যারিস্টটলের অমোঘ বাণী Man is a political animal কে স্মিথ সম্ভবত আরেকটু বাড়িয়েই বলেছে, Modern man is an Economical animal। স্মিথ সাহেব গ্রীক দর্শনের বড় পণ্ডিত। নীতিশাস্ত্র পড়াতেন। সেই হিসেবে Economical animal এর ধারণাটি তার আবিষ্কার। যেখানে সে দাবিই করেছেন, মানুষের অর্থনৈতিক সত্তা, যা কিনা উৎপাদন, বিনিময় ও ভোগ, এই তিনটি চক্রের মধ্যেই পরিচালিত, যেই সত্তার বিকাশ আদিম পৃথিবীতে হয়নি, কিন্তু আগামি পৃথিবীতে তাই-ই হবে। স্মিথের কথা মিথ্যা না হলেও, আংশিক সত্য। যতটুকু সত্য তা সবৈব সত্য, কিন্তু যতটুকু সত্য না অর্থাৎ অস্পষ্ট তাই হচ্ছে শুভংকরের ফাকি। স্মিথের কিছু বছর আগেই ফরাসি আরেক প্রতিভাবান দার্শনিক জ্যা জাক রুশো এই বিষয়টি আরো ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।

তার Discourse on Political Economy এবং তার শ্রেষ্ঠ রচনা The Social Contract এ তিনি এই যে আগমনী অর্থনৈতিক মানব, এর গঠন, গতি-প্রকৃতি এবং তার হালহকিকত কি হবে সেই বিষয়ে এক ধরনের জটিল আলোচনার উত্থাপন করেন। রুশোর মতে, অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যবাদ, কারিগরি শিল্প এবং কারাখানাবাদের মধ্যে দিয়ে মানুষের এক ভয়ংকর বিরাজনীতিকরণ হয়েছে, গণতন্ত্রের তলপেট থেকে সে সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভুত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা, যা তার নাগরিক সার্বভৌমত্বের নীতি ও ভিত্তির সাথে দ্বান্দ্বিক। রুশোর মতে, রাজনীতিবিদ নামক শ্রেণির সৃষ্টি তখন থেকেই এবং নাগরিক সমাজ Civil Society ও রাজনৈতিক সমাজ political society এর মাঝে বিভক্তির সূচনা তখনই ঘটলো যা মানবজাতির জন্য একটি অকাম্য ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা।

রুশো পুঁজিবাদ শব্দটি ব্যবহার করেননি। কারণ অবশ্য তখনো ফরাসি দেশের অর্থনীতি অ-পুজিবাদী কৃষিভিত্তিক-বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু রুশো ইতিহাসবিদের মতো ইতিহাস এবং সমসাময়িক ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই তিনি বুঝে গেছিলেন, ইংরেজ দেশের কারখানাবাদ, বণিকবাদ ও বাণিজ্যতন্ত্রের হাওয়া অতি শীঘ্রই ফরাসি দেশের সুমিষ্ট সাদা মদিরার গ্লাসের আশপাশ দিয়ে বয়ে আসতে শুরু করেছে। যার প্রমাণ হলো রুশোর মতে, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব ও সরাসরি সার্বভৌমত্ব চর্চা ও নাগরিক অধিবেশনের অবসান এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার আভাস। পুঁজিবাদ সম্বন্ধে বুঝার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের ইতিহাস বোঝা খুবই জরুরি। যার সাথে স্মিথের Economical Animal ধারণাটির সম্পর্ক অতি গভীর৷

বেশ কিছু বই পুস্তক কয়েক মাস নাড়াচাড়া করা হয়েছে পুঁজিবাদের ইতিহাসকে বোঝার ক্ষেত্রে। দার্শনিক জায়গা থেকে নয়, অর্থনৈতিক জায়গা থেকে। এবং কিছু বইপুস্তক পড়ারও সৌভাগ্য হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অ্যালান মেইকসিন্স উড Ellen Meiksins Wood নামক এক আমেরিকান-কানাডিয়ান অধ্যাপিকার The Origins of Capitalism: A longer View বইটি আমার এখনো পর্যন্ত পুঁজিবাদের ইতিহাস নিয়ে পড়া শ্রেষ্ঠ, বইটি পাঠ করছি এই মুহূর্তে। কিছু দিন আগে মিশেল বো এর পুঁজিবাদের ইতিহাস বইটা পড়া হয়েছিল৷ তাতে যতটা না তাত্ত্বিক আলোচনা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল পরিসংখ্যান ও গাণিতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। বইটির নাম পুঁজিবাদের ইতিহাস না দিয়ে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি দিলে অধিক যৌক্তিক হতো। কারণ মিশেল বো তাতে ঠিক পুঁজিবাদের বিকাশ কখন, কোন পর্যায়ে, কোন কারণগুলোর ভিতর দিয়ে বিকশিত হয়েছে তা বলেনি, বরং আলোচনা করেছেন পুঁজিবাদের বিকাশ ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠার ফলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ফলাফল নিয়ে এবং তাতে অধিক পরিসংখ্যানের উপস্থিতিও ছিল বটে৷

অর্থনীতিতে গণিতের ব্যবহারটা একসময় জরুরত ছিল। সেই ১৯২০ এর দশকে যখন অর্থনীতি একটি শাস্ত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পঠিত হওয়া শুরু হলো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মনে হয় অর্থনীতির কোনো আলোচনা মানেই সেখানে গণিতের ব্যবহার এবং গাণিতিক ভাষা ব্যবহার করা যেন এক প্রকারের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ফ্যাশনের চর্চা এখনো আছে। যার ফলে এই বিষয়টি তার উদ্দেশ্য থেকে হাজার মাইল দূরে চলে গেছে। এই কথাটি আমার নয়, বরং অর্থনীতিতে নোবেল স্মৃতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের কথা। ডক্টর সেনের আত্মজীবনীটি পড়লাম বেশ কিছুদিন হলো। উনাকে নিয়ে বাঙালি বামপন্থী ঘরানায় তুমুল আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ডক্টর সেন পিএইচডি করেছেন বিশ শতকের দুজন অন্যতম প্রভাবশালী ও প্রথম শ্রেণির মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদের নিকট। একজন হলেন Transitional Debate (transition from feudalism to capitalism) এই বিতর্কের একজন মহা প্রবর্তক মরিস ডব এবং আরেকজন ছিলেন বিখ্যাত ইতালিয়ান বিখ্যাত দার্শনিক ও মার্কসবাদী রাজনৈতিক আন্তনিও গ্রামসির বন্ধু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ পিয়েরে স্রাফার নিকট।

এমনকি জোয়ান রবিনসন যিনি অর্থনীতিতে গণিতের অতি ব্যবহারকে একদমই অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন, প্রথম অর্থনীতিতে নারী হিসেবে গ্রাজুয়েট ও শিক্ষক জোয়ান রবিনসন, যিনি ডক্টর সেনের পিএইচডি সুপারভাইজ করতে আগ্রহী ছিলেন অতি প্রবল। ডক্টর সেন উনার নিকট পিএইচডি করেননি সে ভিন্ন কারণ ছিলো অবশ্য। The origins of capitalism বইটিতে ভদ্রমহিলা শুরুই করেছেন পুঁজিবাদের ইতিহাস নিয়ে যে কয়েকটি তত্ত্ব এবং বিতর্ক একাডেমিয়াতে চালু আছে সেইগুলো সাবলীল ও সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে। পুঁজিবাদের ইতিহাস নিয়ে এত সুন্দর চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং দীর্ঘ অথচ স্পষ্ট লিটারেচার রিভিউ আমি পাইনি এখনো। বইটিতে উনি পুঁজিবাদের উৎপত্তি ঠিক কবে এবং কিভাবে হয়েছে এই প্রশ্ন নিয়ে যে খোদ বড় বড় মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদদের মাঝে তর্ক আছে তা নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেছেন৷ সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই বইটি পড়ার কালে আমি আরেকটি অসাধারণ বইয়ের সন্ধ্যান পেলাম। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন, যার নাম অনেকেই শুনেছেন। তার একটি বই আছে, Historical Capitalism, এই বইটি ঘটনাচক্রে খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করতে যেয়ে দেখি সম্ভবত এত সহজ এবং সাবলীল ভাষার পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতি, ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক নীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আর হতেই পারে না।

ওয়ালারস্টাইন ও পুঁজিবাদকে ঐতিহাসিক জায়গা থেকেই দেখেছেন। যেখানে তিনি পুঁজিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ঠিক মার্কসের ভাষাতেই। খুবই স্পষ্টভাবেই। অর্থাৎ পুঁজি মাত্রই মেশিন, কারখানা, টাকা এবং শ্রম নয়। পুঁজির অন্তর্ভুক্ত আরেকটি বিষয় আছে যার মূলত পুঁজিবাদের মূল নিয়ামক। তা হলো, Social property relation। অর্থাৎ সামাজিক সম্পত্তি-সম্পর্ক যার ধরণ আদিম কিংবা সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এক রকমের ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের উৎপত্তিই হয়েছে এই সম্পর্কের পরিবর্তনের মাধ্যমে৷ ওয়লারস্টাইন নিজেও সেই বিখ্যাত পরিবর্তনকাল সম্বন্ধে বিতর্কে Transitional debate অংশ নিয়েছিলেন রবার্ট ব্রেনার নামক আরেক প্রখ্যাত মার্কসবাদী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদের সাথে এক জোট হয়ে, আরেক ঘরানার মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে।

আমার মতে, অ্যালেন মেইকসিন্সের বইটা অনুবাদ হওয়া উচিত এবং অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। মার্কসের মতে পুঁজিবাদকে বুঝতে হলে তার বিবর্তনের ইতিহাস বোঝা জরুরি, ঠিক কি কি সে এনেছে এই পুরানো পৃথিবীতে, আগের পৃথিবীর সাথে তার পার্থক্য কোথায়, অর্থাৎ ইতিহাস, ইতিহাস এবং ইতিহাস। এজন্যই বিশ শতকের প্রখ্যাত মার্কসবাদীরা (অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ) এরকম তুমুল বিতর্কে জড়িয়েছেন, কারণ তারা প্রত্যেকেই পুঁজিবাদকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন এবং এই বিতর্ক এখনো জারি আছে, এই বিতর্কে আরো অনেক কিছু পরবর্তী তে যুক্ত  হয়েছে এবং হচ্ছে। স্মিথের সেই Economical animal এর ধারণা যার বিকাশ হয়েছে মূলত রুশোর সেই রাজনৈতিক নাগরিক সার্বভৌমত্বের ধারণাকে পিষেই। এবং ঠিক কি কারণে এই Economical man এর ধারণাই সর্বজনবিদিত হলো তা বুঝতে হলেও পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক বিবর্তন বোঝা জরুরি। ডক্টর সেন পুঁজিবাদ নিয়ে তার আত্মজীবনীতে তেমন কোনো বিশেষ আলোচনা করেননি। কিন্তু মার্কসের কিছু ধারণা নিয়ে সে প্রায় ৫০-৬০ পৃষ্ঠা খরচ করেছেন, যেখানে সে উৎপাদন ব্যবস্থাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে চাওয়ার যে বিষয়টি সেটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কেনো সে মার্কসের Labour theory of value মূল্যের শ্রমতত্ত্বকে নাখচ করে দিতে রাজি নন সেই বিষয়ে আলাপ করেছেন।

আত্মজীবনী পড়ার একটা বাতিক আমার আছে। সুযোগ পেলে আত্মজীবনী পড়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত করি না। বিশ শতকের আরেকজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নির্ভরশীলতা তত্ত্বের একজন অন্যতম প্রবক্তা অধ্যাপক সামির আমিনের আত্মজীবনী আজ আবিষ্কার করলাম। অর্থনীতির বইপুস্তক পড়া দায় হয়ে গেছে আজকাল। এত এত গাণিতিক ফ্যাশন এবং মডেলে লিপ্ত যে, মনে হয় পদার্থবিজ্ঞান কিংবা জ্যামিতিশাস্ত্র পড়ছি। যা সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে যায়। সেজন্য যদি ওইসব কাটখোট্টা অর্থনীতিবিদদের আত্মজীবনী পড়া যায় অন্তত আত্মজীবনীতে তাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে গণিতকে তারা আনবে না, এই চিন্তা থেকেই অর্থনীতিবিদদের আত্মজীবনী পড়ার একটা সুপ্ত বাসনা রাখি। ডক্টর সেনের আত্মজীবনী পড়া এদিক দিয়ে আমার জন্য সার্থক। যদিও তার আত্মজীবনীতে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক ধারণার আলাপ খুবই কম। কিন্তু বিশ শতকের অর্থনীতি বিষয়ক যত চিন্তাধারা ও বিষয়বস্তু এবং উদ্ভাবন হয়েছে তা নিয়ে বিস্তৃত অথচ সরল আলাপ করতে ডক্টর সেন একটুকুও কার্পণ্য করেননি। আশা করি, ডক্টর সামির আমিনের আত্মজীবনী পড়েও একই অনুভূতি লাভ করা হবে। তবে অ্যালেন মেইকসিন্সের বইটি আমি মনে করি চিন্তার মহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই বইটিই খোদ একটি মঞ্চের মতো যেখানে পুঁজিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কিত যত নাটক অর্থাৎ তত্ত্বকথা আছে, তার উপস্থাপনা রয়েছে। পাঠকমাত্রই উপকৃত হবেন এই বইটি পড়ার মাধ্যমে।