শামীমা জামানের উপন্যাস ‘যুগল বন্দিনী’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২৩

রায়া শোনো, আমার কিন্তু একটা জিনিস ভালো লাগছে না।
রায়া নিপুণ হাতে ঘরদোর গুছাচ্ছিল। সুহৃদের কথায় কিছুটা চমকে গিয়ে কাজের বিরতি দিয়ে জিগেশ করল, কি জিনিস?
তুমি সেদিন বাইরে গেলে না? জয়া তখন তিন-চারটা ছেলেকে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ঘরে আড্ডা দিল। গান বাজনা নাকি সব হৈ-হুল্লোড় খানিক করে আবার বেরিয়ে পড়ল ওদের সাথে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। কি সব ব্যান্ড ফ্যান্ড হাবিজাবি করে।
তো? রায়ার চোখ-মুখ সপ্রতিভ। চোয়াল কিছুটা শক্ত হয়ে এসেছে।
না মানে ছেলেদের সঙ্গে মিশছে, সেটা নিয়ে আমি কোনো কমপ্লেইন করছি না। মিশতেই পারে। কিন্তু কথা হলো, ছেলেগুলোকে আমার ভালো লাগেনি।

 

একটার তো পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুল বেনী করা, রোমেল না কী যেন নাম। আরেকটা পুরা মাথা টাকলু, চোখে সানগ্লাস। ওইটার নাম শুভ।
রায় শক্ত ঠোঁটে ডান হাত উঁচু করে বলল, ব্যাস, আমি তোমার কাছ থেকে ব্যান্ড লাইনআপ জানতে চাচ্ছি না। ওরা ওর বন্ধু। সবাই ব্যান্ডের মেম্বার।
ভুলে যেও না, জয়া একটা মেয়ে। এভাবে যখন খুশি ছেলেদের সঙ্গে মিশে থাকা ভালো কথা নয়। এসবের পরিণতি কখনও ভালো হয় না। বন্ধু ভালো কথা, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ছেলেরা মা আর বোন বাদে সবার ওপরই ঝাঁপ দিতে পারে।
তোমার মতো গাধা ছেলেরা পারে। তার চেয়ে স্ট্রেইট বলে দাও আমার বোন তোমার অন্নধ্বংস করছে। এটা তুমি মেনে নিতে পারছ না। যে কিপটে রাজা তুমি।

 

দেখো সবসময় কিপটে কিপটে করবে না। ভালো লাগে না শুনতে। আমাদের স্বল্প আয়ের সংসার। একটু হিসাব না করলে চলবে কেন?
তুমি হিসাবি না, বখিল চিনো? তুমি হলে তাই। মানুষের যা নিত্য প্রয়োজন তা মানুষের লাগবেই। মানবেতর জীবন তো আর যাপন করা যায় না। তুমি আমাকে দিয়ে তাই করাচ্ছ। আমি বলে সহ্য করছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে অনেক আগেই বিদায় হতো।

বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত কি দিয়েছো তুমি আমাকে? গয়নাগাটি দূরে থাক, একটা দামি শাড়ি ও কোনো দিনই দাওনি। তোমার সংসারের এসে যত কষ্ট করেছি, আমার সারা জীবনে এত কষ্ট কোনো দিন করিনি।

 

এই পর্যায়ে সুহৃদ খানিক চুপসে গেল। একটু অভিভাবকত্ব ফলাতে গিয়ে এখন দেখি লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেল। মেজাজ নামাতে হবে। বাথরুমে চলে যাওয়া যেতে পারে। প্রতিপক্ষ সামনে না থাকলে যুদ্ধ হয় না। কিন্তু বাথরুমের সে কি করবে? পেচ্ছাবের চাপও অনুভব করছে না। অগত্যা সুহৃদ একটি কবিতার বই নিয়ে উচ্চস্বরে আবৃত্তি শুরু করে,

 

অংশ লেখা যেও না হোথা
বাতাস করে মাতলামি,
অংশ লেখা যেও না হোথা
আকাশটা যে নীল বেজায়,
অংশ লেখা যেও না হোথা
মনটা তোমার ঢের দামি
অংশু লেখা যেও না হোথা
মনটা যদি খোওয়াই যায়
যাওনি হোথা বলছ বটে,
কিন্তু তাকে সত্যি?
শাড়ি তোমার কত ছলের
চোরকাঁটায় ভর্তি

 

সুহৃদ নিজের কানকে নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কি আজকাল জাদুকর হয়ে গেল। মাত্র ক`টি লাইন শোনালো আর অমনি মূক বনে গেল ঝগড়াটে রায়া। কালক্ষেপণ না করে সে আবারও তার জাদু প্রয়োগ অব্যাহত রাখল আকস্মিক ঝড় থেকে নিরাপদ অবস্থানে থাকতে।

 

অংশু লেখা চেন কি ওকে ফর্সা মতো ছোকরা?
অংশু লেখা কি এত কথা ওর সঙ্গে?
অংশ লেখা বাগানের শোনো ডাকছে কাঠঠোকরা
ডাকছে বুকে ও কোন পাখি প্রেমেরই উৎসবে
যাওনি হোথা বলছো বটে কিন্তু তা কি সত্যি?
এই যে দেখো শাড়ি তোমার চোরকাঁটায় ভর্তি।

 

রায়া ক্ষীণ গলায় বলল, চা খাবে?
সুহৃদ বইয়ের মলাট দুটো একত্রিত করে বলল, তোমার যদি দয়া হয়।

 

জয়া অরণ্যকে ন্যকে নিয়ে ছাদে গেছে। ছাদে গেলে বাচ্চাটা কি খুশি হয়। যেন পুরো পৃথিবীটা তার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। অথচ ঘরকন্নার ব্যস্ততায় রায়ার কখনো সময় হয় না ওকে নিয়ে একটু ছাদে যায় কি পাশের বাসা থেকে একটু বেরিয়ে আসে। কি দমবন্ধ শৈশব এখনকার বাচ্চাদের। বাসার চার দেয়ালের বাইরে একচিলতে খোলামেলা বারান্দাও নেই। বারান্দা বলতে একজন মানুষ দাঁড়াতে পারে এরকম একটি কবুতরের খোপ। আহা, খুলনার তারা কত বড় বাড়িতে বড় হয়েছে। বাড়ির দুপাশে প্রশস্ত রাস্তা পেরিয়ে খোলা মাঠ। সেই মাঠে খেলতে আসত রেলওয়ে কলোনির ছেলেমেয়েরা। কত মানুষ কত গাছপালা কোনো কিছু কি আর বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখতে হয়েছে।

 

কত মাঠের পারে দূরের দেশ পেরিয়ে নিজেরাই দেখে দেখে জেনে নিয়েছে নাম-না-জানা কত ফুলের গন্ধ ফলের স্বাদ পাখির কলরব। অথচ অরণ্যর মুখস্ত বিদ্যা মাঝে মাঝেই ওদের হাসির খোরাক যোগায়। দোয়েল আমাদের জাতীয় ফল, দোয়েল আমাদের জাতীয় ফল... চায়ের কাপে চিনি মেশাতে গিয়ে রায়া মনে করতে পারলো না সুহৃদ কয় চামচ চিনি খায়। কী আশ্চর্য, প্রতিদিন সে চা বানায়। এ কথাতো মনে না করতে পারার কোনো কারণ নেই। সুহৃদকে কি জিজ্ঞেস করবে, তুমি যেন কয় চামচ চিনি খাও? শোবার ঘর থেকে সুহৃদের অব্যাহত আবৃত্তি ভেসে আসছে।

 

অংশ লেখা দুপুরগুলো প্রতারণার অকুস্থান
অংশ লেখা বিকেল এত ফিচেল যে তা বলার নয়।
অংশুলেখা, সন্ধ্যাগুলো বন্ধ্যা এত রাত্রিময়
নির্ঘুম নীল অশ্রুঝরা ব্যথায় বোবা মূহ্যমান।
তাই তো খালি শুধাই, হোথা তবুও যাবে সত্যি?
যেও না ওগো, করো না শাড়ি চোরকাঁটায় ভর্তি।

 

সুহৃদ কি কিছু আঁচ করতে পারছে? তার আর ইকবালের ব্যাপারে? হঠাৎ সে এই কবিতাটাই কেন আবৃত্তি করলো? এমন নয় যে, বিশ্ব বন্দোপাধ্যায়ের চোরকাঁটা কবিতাটি তার খুব প্রিয়। তার প্রিয় কবিতা জীবনানন্দের আট বছর আগের একদিন। সুহৃদ দুই হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলল, আহা দারুণ চায়ের গন্ধ বেরিয়েছে। এককাপ জয়াকেও দিও।

 

সুহৃদের পেছনে অরণ্য এসে বলল, আমাকেও এক কাপ দিও। আমরা ছাদে অনেক লাফালাফি করেছি তো, তাই এখন চা খেতে হবে।
সুহৃদ অরণ্যকে আহ্লাদে কোলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমার আব্বুটাকেও চা দাও।

 

বাবার আহ্লাদে অরণ্য খিলখিল করে হাসে। কাঁধ থেকে যেন বড় একটা বোঝা নেমে যায় রায়ার। না, সুহৃদ কিচ্ছু জানে না। জানলে এমন খোশমেজাজে সে থাকতে পারত না।

 

রায়া চায়ের ট্রে শোবার ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় পাশাপাশি গা ঘেঁষে সুহৃদ আর জয়া বসে আছে। জয়ার হাতে খবরের কাগজ। ভেতরের বিনোদন পাতাটি সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।

 

সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে রায়ার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। এতক্ষণ সুহৃদের আবৃত্তি শোনার পর থেকে তার ভেতরের বাঘ বেড়াল হয়েছিল। আবার যখন সে অজানা সন্দেহ ভয় থেকে নিশ্চিন্ত হলো, আপনা থেকেই সে বাঘ বেড়ালের খোলস ফেলে আপন হুংকার ছাড়তে উদ্যত হলো। চোখটা জ্বলজ্বল করছে জয়ার বেহায়াপনা আর সুহৃদের ছ্যাবলামি দেখে। হারামজাদা ব্যাটা মেয়ে মানুষ দেখলেই গা ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে হয়। তোর দুলা দুলা ভাব আমি বের করছি দাঁড়া। রায়া অবশ্য মুখে এসব বলল না। শুধু জয়াকে বলল, তোর পড়াশোনা নেই। চেহারা আর সাজগোজ দেখেই কি তোকে পাশ করিয়ে দেবে। চা খেয়ে অরণ্যকে নিয়ে পড়তে যা।

 

সুহৃদের দিকে এবার রায়া শুরু চোখে তাকালো। এই তাকানোর মানে হলো, তুমি যে চান্স নিতে চাচ্ছ সেটা তুমি মোটেও পাবে না আমি দারোগা ঘরে থাকতে। চলবে